(পৃর্ব-পকাশিতের পর)

পর্ব – 4
(1757 – 1800)

(উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা
সূর্য‍্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে
চঞ্চল পাখনায় উড়ছে…)

আমরা আগের পর্বে দেখেছি যে আমাদের দেশের পলাশীর যুদ্ধের সময় পযর্ন্ত ইউরোগের নানা জায়গায় যেমন ইটালি, ফ্রান্স, ইংল‍্যান্ড, পোল‍্যান্ড, জার্মানি ইত‍্যাদি জায়গায় ইলেকট্রিসিটি নিয়ে যা কাজ হয়েছে তা সবই হয় একলা স্টাটিক ইলেকট্রিসিটি নিয়ে, নয়তো একলা ম‍্যাগনেটিসম নিয়ে। দুটোকে একসাথে করে আজকের flowing current electricity ধারণাটা তখনও নাগালের বাইরে। তবে রহস‍্যের পর্দাটা ধরে জোর আলোড়ন চলছে, পর্দার আড়ালে কি কি আছে তা জানার জন‍্য।

ইউরোপে রেনেশাঁর জ্ঞান আহরণের জোয়ারে তখন অনেক বিজ্ঞানী একই সময় জুড়ে কাজ করে যাচ্ছেন ইলেকট্রিসিটির ওপর, তার নানা অজানা দিগন্ত উন্মোচন করতে। জোসেফ প্রিস্টলি (1733 – 1804), জন ক‍্যান্টন (1718 -1772), উইলিয়াম ওয়াটসন ( 1715 -1787), টিমোথি লেন (1734 – 1
807), ক‍্যাভেন্ডিশ (1731 -1810)

 

Timeline of a few 18th century Scientists. Their productive periods were around a broad common span.

 

ইংল‍্যান্ডের উইলিয়াম ওয়াটসন (1715 – 1787) পেশায় ডাক্তার ছিলেন, সারা জীবন লন্ডনেই কাটিয়েছেন। পেশার বাইরে বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তিনি FRS নির্বাচিত হন।
তিনি 1746 সালে লেইডেন জার-এর ইলেকট্রিক চার্জ ধরে 1 ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবার কৌশল বের করেন। তাতে স্ট‍্যাটিক ইলেকট্রিসিটি নিয়ে পরীক্ষা” নিরিক্ষার কাজ আরও সূগম হয়।

ইলেকট্রিসিটির তখনকার প্রচলিত চার্লস ডুফে’র ভাবনার (Vitrious আর Resinoys fluid) বদলে তিনি বললেন যে ওটা একই তরলের সারপ্লাস (+ charge) বা ডেফিসিয়েন্সি (-ve charge)। তিনি এটাও বললেন যে ইলেকট্রিসিটি আর ম‍্যাগনেটিজম সমগোত্রিয়। ইনি আমেরিকার বেঞ্জামিন ফ্র‍্যাঙ্কলীনের বন্ধু ছিলেন, একে অন‍্যের গবেষনার খবর রাখতেন।

সমসাময়িক ইংল‍্যান্ডের জন ক‍্যান্টন (1718 -1772) স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় সূর্য‍্যঘড়ি বানাতে গিয়ে নিজের গ্রামের ল‍্যাটিচিউড প্রথম বার সঠিক নির্ধারণ করে নজরে এসেছিলেন। পরে তিনি লন্ডনে স্কুলের শিক্ষকতাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। সাথে অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাথে জুড়ে ছিলেন। তিনি কৃত্রিম ম‍্যাগনেট বানিয়ে ফেললেন 1750 সালে, কোন প্রকৃতিক ম‍্যাগনেটের সাহায‍্য ছাড়াই। সেটা পরে গিয়ে ইলেকট্রিসিটির খোঁজের ব‍্যাপারে কাজে লাগে।

John Canton (1718 – 1772)

 

ইংল‍্যান্ডেরই টিমোথি লেন (1734 -1807) পেশায় ছিলেন লন্ডনের এক ফার্মাসিস্ট যাকে তখন বলা হতো অ‍্যাপোক‍্যাথিয়ারি। সাথে তিনি বিজ্ঞান-চর্চাও করতেন।1760 সালে তিনি লেইডেন জারে ধরে রাখা চার্জের তীব্রতা মাপার এক যন্ত্র বের করেন – Lane’s Electrometer. এতে পরবর্তী গবেষকদের সুরাহা হলো।

একই সময়ের ইংল‍্যান্ডের যোসেফ প্রিস্টলী ( 1733 – 1804) ছিলেন একাধারে পলিম‍্যাথ, নানা বিষয়ের শিক্ষক, পাদ্রী এবং একই সাথে মুক্ত-চিন্তক। তার কর্মক্ষেত্র লন্ডন ছিলো না, ছিলো ওয়ারিংটন যাকে এথেন্স অব নর্থ অব লন্ডন বলা হতো। তার নামের সাথে আমাদের সকলের পরিচয় হয়েছে স্কুলের পাঠ‍্য বইতে, অক্সিজেনের আবিস্কারক হিসেবে। প্রিস্টলীর দার্শনিক চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজন্মের বিখ‍্যাত দার্শনিকদের (বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, হারবার্ট স্পেন্সার) চিন্তাধারার উৎসস্রোত হয়েছে।

তার বিপুল কর্মকান্ডের পরিসরে তিনি প্রায় 150 খানা বই বা প্রবন্ধ লিখেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। তার অনেক বইয়ের মধ‍্যে একটা ছিল 1761 সালে লেখা ইংরেজি গ্রামারের (প্রচলিত ল‍্যাটিন গ্রামারের বাইরে গিয়ে লেখা) এক বই । (তুলনায় আমরা বাংলা গ্রামারের প্রথম বই পাচ্ছি 1778 এ, হুগলিতে বসে সেটা লিখলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন থেকে আসা কর্মচারী নাথানিয়েল ব্রাসলি হ‍্যালহেড। দু বছর পর 1780 তে আসবে প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র আইরিশম‍্যান হিকির The Bengal Gazette, বেরোবে কলকাতা থেকে, যা দুবছর পরেই বন্ধ হয়ে যাবে ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে মামলায় হিকির হার হয়ে জেল হলে। রাজশক্তি যখন আকন্ঠ দুর্নীতির রণপা’য়ে দাঁড়িয়ে, তখন রাজশক্তিকে চটিয়ে সংবাদপত্র চালানো 250 বছর আগেও বেশ মূস্কিলের কাজ ছিলো !

 

First Bangla Grammer (1778)

 

First Newspaper in India (1780)

 

সেই প্রিস্টলী 1767 তে লিখলেন 1766 অবদি একত্রিত হওয়া ইলেকট্রিসিটির ওপর প্রাপ্ত যাবতীয় জ্ঞানের এক প্রামাণ‍্য ইতিহাস History of Present State of Electricity। এ বই এর পরে প্রায় 100 বছর ধরে এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে থাকবে যা থেকে পরে কুলম্ব, ভোল্টা, ক‍্যাভেন্ডিশ, ফ‍্যারাডে এবং ম‍্যাক্সওয়েল প্রভাবিত হবেন এবং নিজেদের গবেষণার জন‍্য রসদ সংগ্রহ করবেন।

Joseph Priestley (1733 – 1804)

 

Cover of Priestley’s book on Electricity (1767)

 

এ সবই ছিল ইলেকট্রিসিটির অজানা গন্তব‍্যের দিকে ছোট ছোট আলাদা আলাদা পদক্ষেপ।

ইংল‍্যান্ডের ক‍্যাভেন্ডিশ (1731 – 1810) ছিলেন ধনী ইংলিশ অ‍্যারিস্টোক্রাসি বংশের। তিনি সারা জীবন লন্ডনে বসে বিজ্ঞানের নানা যুগান্তকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। (তার বিশেষ ভাবে উল্লখযোগ‍্য পরীক্ষা – পৃথিবীর ওজন মেপে বের করা। 1798 সালে তিনি নিজেরই ডিজাইন/ফ‍্যাব্রিকেট করা এক ডিভাইস দিয়ে (টরশন ব‍্যালেন্স), নিজের ম‍্যানশনেই একটা বিশেষ ঘর বানিয়ে তাতে পরীক্ষা চালিয়ে তার ফলাফলের ভিত্তিতে আর 100 বছর আগে বের করা নিউটনের মাধ‍্যাকর্ষনের সৃত্র ধরে বের করলেন পৃথিবীর ওজন। অবিশ্বাস‍্য ভাবে, সেই কালে, সেই অপরিশীলিত জোগাড়-যন্ত্র দিয়ে মাপা পৃথিবীর ওজন আজকের দিনে মেনে নেয়া ওজনের মাত্র 1% তারতম‍্যের মধ‍্যে)।

 

Henry Cavendish ( 1731 -1810) in the famous experiment of weight of Earth.

 

সেই ক‍্যাভেন্ডিশ ইলেকট্রিসিটির ওপর অনেক পরীক্ষা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেসব পরীক্ষার ফলাফল তিনি প্রচার করেন নি। তাই তার খোঁজ করা নতুন জ্ঞান লোকের অগোচরেই থেকে গেছে। ক‍্যাভেন্ডিশের এই কাজ 1770 নাগাদ। এর প্রায় 100 বছর পর 1878 এ রয়াল সোসাইটির পুরোনো নথি ঘেঁটে ম‍্যাক্সওয়েল বের করলেন যে 100 বছর আগেই ক‍্যাভেন্ডিশ কাজ করে গেছেন ইলেকট্রিক পোটেনশিয়াল নিয়ে, সেটার সাথে কারেন্টের যোগাযোগ নিয়ে (যেটা পরে ওহমস ল বলে পরিচিত হয়ে গেছে), প‍্যারালাল সার্কিটে কারেন্টের বন্টন নিয়ে, ইলেকট্রিক ফোর্স আর দূরত্বের ইনভার্স স্কোয়ার নিয়ম নিয়ে ( যেটা পরে কুলম্ব’স ল বলে পরিচিতি পেয়ে গেছে)

 

চার্লস অগাস্টিন ডা কুলম্ব

(ভাসা ভাসা ধারণা থেকে মাপ-জোকের ছন্দবন্ধনে)

চার্লস অগাষ্টিন ডা কুলম্ব (1736 -1806) জন্মেছিলেন ফ্রান্সে। পড়াশোনা শেষ করে 25 বছর বয়সে তিনি ফ্রেন্চ আর্মীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। তিনি দুর্গের স্ট্রাকচারাল বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু অনেক অন‍্য বিষয় নিয়েও তিনি মূল‍্যবান গরেষনা করেছেন, যেমন ফ্রিকশন ও ইলেকট্রিসিটি। ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে 1789 এ তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে দেন এবং নিজের শহরে গিয়ে নিরিবিলিতে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় মন দেন। পরে বিপ্লব সফল হলে নতুন সরকারের আমন্ত্রণে তিনি আবার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন 1802 সালে।

এতদিন অবদি ইলেকট্রিসিটির ওপর যা কাজ হয়েছিল তা সবই তার আকর্ষণ ধর্মের চমৎকারি প্রভাবটা নিয়ে, সেটার নানা বিভিন্নতা নিয়ে। এই প্রচলিত কেরামতি দেখানোর ধারাতে কুলম্ব এসে একটা মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।

তিনি এই আকর্ষণের ফোর্সটাকে মাপার কথা ভাবলেন। ব্রাপারটাকে শুধু ‘আকর্ষন করছে’ না ভেবে ‘এভাবে কম আকর্ষণ করছে’ বা ‘এভাবে বেশী আকর্ষন করছে’ র ধারণার সূত্রপাত করলেন। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেই আকর্ষনের কম বা বেশীটা তিনি তুলনামূলক ভাবে দেখালেন টরশন ব‍্যালেন্স এর সাহায‍্যে। আর সেসব পরীক্ষার ফলাফলকে তিনি বেঁধে ফেললেন কিছু সূত্রে। সেগুলোকেই বলা হলো Coulomb’s Law.

1785 থেকে 1788 এর মধ‍্যে কুলম্ব তার ইলেকট্রিসিটির ওপর করা কাজ নিয়ে 6টা মেমোয়ার প্রকাশ করেন। তাতে ইলেকট্রিসিটির অন‍্যান‍্য নানা ধর্মের ওপর আলোকপাত করা ছাড়াও কুলম্ব দেখালেন যে Magnitude of the Electric Force between 2 point charges is directly proportional to the product of the Charges and inversely proportional to the square of distance between them. এটাই এক কথায় Coulomb’s Law. এটা পরবর্তীতে কাজে আসবে Theory of Electromagnetic Induction তত্ব বের করার সময়।

ইলেকট্রিক চার্জ মাপার ইউনিট (যার ধারণা অনেক পরে আসবে) এর নাম পরে দেওয়া হয়েছে কুলম্ব – এঁর সম্মানে। 1 Coulomb = Charge delivered by a 1 amp (পরে বের হয়েছে) constant current in 1 sec. একশো বছরেরও বেশী সময় পরে, 1910 এ এই Coulomb ইউনিটের মান নির্ণয় করবেন আমেরিকান বিজ্ঞানী মিলিকান।

Charles Augustine De Coulomb (1736 – 1806)

Sketch of Torsion Balance, used by Coulomb to determine the force of attraction.

 

কুলম্বও কিন্তু আকর্ষণের কারণ ব‍্যাখ‍্যা করেছিলেন ইলেকট্রিক ফ্লুইড তত্ত্ব দিয়েই। তার পরীক্ষাও আকর্ষণের মধ‍্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মানে, তখনো অবধি ইলেকটিসিটি বলতে Static Electricity ই বোঝাতো যা ঘর্ষন থেকেই তৈরী হয়। Continuous flow of charge এর ধারণাটা যেটা আজকের জানা ইলেকট্রিসিটি(flow of electron তত্ত্ব) আসতে তখনো দেরী আছে। কিন্তু কুলম্ব প্রথম এই আকর্ষণের ফোর্সটা তুলনামূলক ভাবে মেপে, কিছূ নতূন সূত্র তৈরী করে বিষয়টার ওপর quantitave study র সূত্রপাত ঘটালেন। চর্চাটা emperical observation এর ঘেরাটোপ ছেড়ে যেন অসীমের দিকে যাত্রা করলো। পরবর্তী বিজ্ঞানীদের জন‍্য একটা নতুন ধারা উন্মোচিত হলো।

তখন হয়তো কুলম্ব’স ল’এর সুবিশাল পরিধিটা আঁচ করা যায় নি। কিন্তু পরে এটা অ‍্যাটমিক ফিজিক্সের একটা গোড়ার তত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায় যেটার ওপর ভিত্তি করে অনেক পরে রাদারফোর্ড বা নিলস বোর তাদের পরবর্তী চিন্তাধারাগুলোকে দাঁড় করান।

(পরের সংখ‍্যায় :
ইলেকট্রিসিটি – নতুন খাতে )