ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কার

 

অমিতাভ মৈত্র
মাধব কুমার পাল

 

গল্পের শূরুর কথা

 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ‍্যায়ের গল্পের মতো এক বিচ্ছু ছেলে একবার রাত্তিরে পড়ার সময়ে ঝিমোতে ঝিমোতে ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করেছিলো – মহাভারতে পান্ডবদের যিনি মাস্টারমশাই ছিলেন, সেই দ্রোণাচার্য‍্য কি রাতেও ছাত্রদের পড়াতেন ? তখন তো ইলেকট্রিকের আলো ছিলো না। তাহলে রাতে কিসের আলোতে পড়াতেন ?

ভাববার মতো কথা বটে ! এ ছেলে সেই লেখকের পথ বেয়ে সম্পাদ‍্যের অপকারিতা থেকে ইলেকট্রিক আলোর অবিমৃশ‍্যকারিতার কথা ভেবে ফেলেছে।

মহাভারতের কালটাকে যদি আন্দাজে 2500 BCE ধরা যায় তাহলে সে আজ থেকে প্রায় 4700 বছর আগেকার কথা। আমরা সিরিয়ালে দেখেছি, সে সময়ে রাত্তিরে আলোর জন‍্য রাজ-দরবারে জ্বলতো মশাল আর বাড়িতে জ্বলতো তেলের প্রদীপ। সময়টা যদি আরও 2500 বছর এগিয়ে নিয়ে আসা যায়, মানে 1 AD র কাছাকাছি সময়ে – তখনও আলোর ব‍্যবস্থা কিন্তু একই রকম, হয় তেলের প্রদীপ নয়তো তেলের মশাল। বড়োজোর মোমবাতি। ক্লিওপেট্রা বা বেনহুরের মতো পিরিয়ড মুভি আমাদের সবার হয়তো মনে আছে।

সুইচ টিপে আলো জ্বালা তো এই সেদিনের কথা – 1880-90 এর ঘটনা। তাই ক্লিওপেট্রার সময় থেকে প্রায় 1900 বছর লেগে গেল মানুষের, সেই সুইচ টিপে আলো জ্বালানোর কেতাটা রপ্ত করতে। তার পর থেকে আজ অবদি আরও প্রায় সোয়াশো বছরের জয়যাত্রা এই ইলেকট্রিসিটির – অগুন্তি ধারায় এবং অভাবনীয় পথে। আমাদের আজকের গল্পটা মোটামুটি এই 2000 বছরের।

 

ইলেকট্রিসিটির প্রাক-কথন

প্রকৃতি পঞ্চভূতে মিলিয়ে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব‍্যোম) এক সুবিশাল সম্পদের ভান্ডার আমাদের দিয়েছেন। মাটিতে নানা খনিজ, জলে নানা লবণ, আগুনে এনার্জি, হাওয়ায় নানা গ‍্যাস আর মহাশূণ‍্যে তরঙ্গ। সে সবই আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ‍্য।

এগুলোর সাথে সাথে ভগবান ইলেকটিসিটিও (বিদ‍্যুত) দিয়েছেন। সেটা আছে তামার মধ‍্যে, অন‍্য ধাতূর মধ‍্যে বা বা আরও অন‍্য কিছুর মধ‍্যে। কিন্তু সেটা দেখা যায় না, ধরাও যায় না বা আলাদা করে তৈরি করে মজুদও করে রাখা যায় না। তা থাকে লুকিয়ে, কায়দাটা জানলে তাকে পলকের জন‍্য বের করে আনা যেতে পারে, পলকের মধ‍্যেই তাকে ব‍্যবহার করা যেতে পারে। পরের পলকেই তিনি আবার বিলীন। সেটা যে ভেতরে লুকিয়ে আছে তা জানা, ক্ষণকালের পরিসরে সেটাটাকে ভেতর থেকে টেনে বের করে আনা আর সেই মুহূর্তেই তাকে কাজে লাগিয়ে ফেলার কেরামতিটা শিখে ফেলা – সে এক চমকপ্রদ গল্প যেটা আমরা বলতে চলেছি।

 

প্রাচীণ যুগের অভিজ্ঞতা

সময়টা 2750 BC নাগাদ।
আফ্রিকা ভূখন্ডে মিশরে (Egypt) ইজিপশিয়ান সভ‍্যতা পিরামিড তৈরী করছে।
এশিয়া ভূখন্ডের পশ্চিমে মেসোপটেমিয়ায় (Iraq) সুমের সভ‍্যতা হয়তো তৈরি করছে পৃথিবীর প্রথম লিপির ট‍্যাবলেট।
এশিয়া ভূখণ্ডের আরও পূবে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোয় তখন শহর তৈরীর রমরমা।

Pyramid at Giza, Egypt 2600 BC

 

Earliest written script, 3200 BC (Sumerian Civilisation),

 

Remains of a lost city. Mohenjo daro, now in Pakistan, It was a flourishing city in around 2700 BC

 

সেই সময় মিশরীয় সভ‍্যতার লোকেরা নজর করলো যে সেখানকার নীল নদে পাওয়া এক মাছকে ছূঁলে মানুষের গায়ে এক তীব্র ঝনঝনানির মতো অনুভূতি হয়। তারা সেই ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেছিল, অজানা জিনিসকে ভালভাবে জানার স্বাভাবিক অনূসন্ধিৎসায়। আর সেই ঝনঝনানিটাকে তারা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলো মানুষের বাত বা মাথাব‍্যাথা জাতিয় উপসর্গের উপশমে। মানুষের ইতিহাসে এটাই প্রথম রেকর্ড – ইলেকট্রিসিটি সংক্রান্ত বিষয়ে। সেই মাছগুলোর আজকের নাম ইলেকট্রিক রে বা ইলেকট্রিক ইল।

 

ক্ল‍্যাসিকাল এন্টিক‍্যুইটির অভিজ্ঞতা

থ‍্যালেস (Thales) ছিলেন গ্রীক সভ‍্যতার ক্ল‍্যাসিকাল অ্রান্টিকুইটি সময়কালের এক মহা জ্ঞানী ব‍্যক্তি। তিনি জন্মেছিলেন আজকের তুরস্কে (Turkey), সেটা তখন ছিলো গ্রীক সাম্রাজ‍্যের অংশ। সময়টা প্রায় 600 BC, পিথাগোরাস – সক্রেটিসেরও আগের জমানা। তাঁকে বিজ্ঞানের জনক (Father of Science) হিসেবে ধরা হয়। তিনিই প্রথম পৃথিবীর প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে দেবতাদের লীলা হিসেবে না ভেবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন। তার ভিত্তিতে তিনি সেই সময়কার এক সূর্রগ্রহপের সঠিক পূর্বাভাষ দেন।

সমসাময়িক কালে ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ভগবান মহাবীর (b. 599 BC) ও গৌতম বুদ্ধ (b. 564 BC) আবির্ভুত হয়েছেন। তারা দূজনেই দুই নতুন ধর্মমতের প্রবর্তন করবেন (জৈন এবং বৌদ্ধ)। ভারত ভূখন্ডে তখন যে পূর্ব-প্রচলিত ধর্মমত – উপনিশদ, বেদ, মুর্তি পূজা, অগ্নি-আহুতি সম্বলিত হিন্দু ধর্ম – তার বাইরে গিয়ে এক নতুন অহিংস পথের সন্ধান দেবে এই সদ‍্য আসা ধর্মমত। এই ধর্মের প্রভাব ক্রমে ছড়িয়ে পড়বে গৌটা এশিয়া ভূখন্ড জুড়ে।


Thales, Turkey, Greek Civilisation, 628 BC – 548 BC

Lord Mahavira, India, 599 BC

Lord Buddha, India. 564 BC

 

আদ‍্যিকাল থেকে নাবিকরা সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের সময় দিক নির্ণয়ের জন‍্য এক ঝোলানো পাথর ব‍্যবহার করতো। তার নাম ছিলো Lodestone. পুরোনো ইংরেজিতে Journey ছিলো Lode, সেই থেকে Lodestone। আর সেই পাথর পাওয়া যেত তুরস্কের ম‍্যাগনেটা অঞ্চলে, থ‍্যালেসের বাড়ির কাছাকাছি। এই পাথরের নাম পরে হয়েছিল ম‍্যাগনেট, জায়গার নাম অনুসারে।

থ‍্যালেস এই লোডস্টোনের প্রতি লোহার আকর্ষণের ওপর নানা পরীক্ষা চালান।
আর সে সময়ে লোকে এটাও খেলাচ্ছলে জানতো যে শুকনো অ‍্যাম্বারকে ঘষলে সেটা কিছু পলকা জিনিসকে আকর্ষন করে ( পালক, খড়, কাগজের টুকরো)
থ‍্যালেস এটার ওপরেও পরীক্ষা চালান।

তিনি এই দুই আকর্ষণের মূলগত প্রভেদটা অনুধাবন করতে পারেন। প্রথমটা ঘর্ষন ছাড়াই হচ্ছে, দ্বিতীয়টা ঘর্ষন-জনিত।

থ‍্যালেস তখন কারণটা ধরতে না পারলেও পরে আমরা জেনেছি যে প্রথমটা Magnetism আর পরেরটা Static Electricity.

এই ভাবেই জানার পথ চলা শুরু। এই জানা যে বাড়তে বাড়তে, ফুলে ফেঁপে একদিন মহীরূহ হয়ে 2500 বছর পরে ইলেকট্রিসিটি হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে সেটা তখন স্বপ্নেরও বাইরে ছিল।

তারপর কত শত মনিষী কত সময় ধরে কত ছোট বড়ো অংশে আলোকপাত করে করে জ্ঞানের নুড়িগুলি জড়ো করলেন। তাদের কেউ বিজ্ঞানী, কেউ গণিতজ্ঞ, কেউ আবিস্কারক, কেউ এঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রকৌশলী বা আর কিছু। কিন্তু তারা সকলেই এই সূত্রে বাঁধা – তারা সকলেই নতুন সত‍্যের খোঁজে। তারা সকলেই Natural Philosopher। আগেকার দিনে যখন Physicist, Chemist, Mathmetician জাতিয় কাজের স্পেশালাইজড বিশেষণ ছিলো না তখন সবাই ছিলেন Natural Philosopher – প্রকৃতির নানা রকম সত‍্যের খোঁজে লিপ্ত।

তারপর সেই নুড়ি জমে জমে ক্রমে পাহাড় হলো। তারপর হয়তো সেই পাহাড় থেকে বেরিয়ে এলো মানব সভ‍্যতার কোন কাজের জিনিস। ইলেকট্রিসিটি, নিউক্লিয়ার পাওয়ার সবই এরকম সত‍্য খুঁজে বেড়ানোর ফল। একটা নতুন জিনিস পাবার পর আবার নতুন সত‍্যের খোঁজ, নতুন কিছু আবিষ্কারের খোঁজ। তাই বোধহয় আজকের ডক্টরেট উপাধিটার পুরোটার নাম Doctor of Philosophy (Ph.D) – প্রকৃতির সত‍্য অনুসন্ধানের সাথে সাযুজ‍্য রেখে।

(এর পর পরের সংখ‍্যায়)

About the author

Amitabh Moitro

Amitabh Moitro, age 67 years, had worked in a nationalised bank for long years. He has since retired and lives in Goa

 

Madhab Kumar Pal

Madhab Kumar Pal (67 yrs) is an Electrical Engineer. After spending his entire working life with SAIL at it’s various units, he is now spending his retired life at Kolkata. He regularly writes for various magazines.