(A story of the bygone times that we all had passed through)

” স্মৃতির পাতা “

কলমে-নন্দিতা সোম

সূর্য্য তখনো উদিত হয় নি। শুধু রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পুব আকাশে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া। আরাত্রিকা এক কাপ চা নিয়ে এসে বসলো বারান্দার একপ্রান্তে বেতের চেয়ারে। সামনে রাখা একটি বেতের টেবিল। বারান্দার এই কোণটি আরাত্রিকার খুব পছন্দ।
কাল রাতে একটুও ঘুম হয়নি। আজ সকাল থেকেও ভীষণ মন খারাপ। অথচ কারণ বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে। এই এক রোগ হয়েছে। ওকে নিশ্চয় বাহাত্তুরে ধরেছে। পুরানো কথা মনে আছে। অথচ এখনকার কথা ভুলে যায়। মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে।
এই বাহাত্তুরে ধরার কথায় ওর ১৯৭১ সালের একটি ঘটনা স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করে উঠলো।
উত্তর কলকাতার মেয়ে আরাত্রিকা। কলেজ ছিলো দক্ষিন কলকাতায়। স্নাতক পরীক্ষার শেষ পর্ব এগিয়ে আসছে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়েছে। তিনদিনের পরীক্ষার সময় ধার্য হয়েছে— দুপুর দেড়টায় ওর ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী।
কলকাতা শহর তখন উত্তাল নকশাল আন্দোলন ঘিরে। রোজ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ– আর মারামারি ও মৃত্যুর খবর চারিদিকে। প্রাণ হাতে নিয়ে বেরোনো। ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন। সকাল থেকে পাড়া থমথমে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে আজ পাড়ায় পুলিশের আক্রমণ হতে পারে। আরাত্রিকাদের পাড়ায় অনেক ছেলেই নকশাল মন্ত্রে দীক্ষিত। আর সবকটি ছেলেই বেশ সুন্দর দেখতে ও পড়াশুনায় খুব ভালো।। সেই কারণেই বোধহয় ও নিজেও ওই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলো–তবে মারামারি ছাড়া।
মা সকাল থেকে বলতে শুরু করেছেন এই গণ্ডগোলে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না। কিন্তু তা হবার জো নেই। কারণ ফাইনাল বলে কথা। বাবার আশ্বাস বাণীতে মা একটু শান্ত হলেন। আরাত্রিকার কোনো চিন্তা নেই। ওর ভাবটা হচ্ছে যা হবার হবে।বাবা ওকে তাড়াতাড়ি কলেজ যেতে বললেন। যদি নির্দিষ্ট সময়ে কেউ না আসে তবে পরীক্ষার সেই গ্রুপে প্রিন্সিপালকে অনুরোধ করে পরীক্ষায় বসতে পারবে। কথাটা আরাত্রিকার মনে ধরলো।
বাবার কথায় আরাত্রিকা তাড়াতাড়ি কলেজ পৌঁছনোর সিদ্ধান্তে রাজী হয়ে রওনা হলো। পৌঁছে দেখে প্ৰথম গ্রুপ শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় গ্রুপের ( সাড়ে এগারোটা ) খবর নিতে গিয়ে দেখে দুজন আসেনি। বাবার কথামতো অধ্যক্ষার কাছে গিয়ে সব বলে অনুমতি নিয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করলো।
পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। একটু শঙ্কা হলো। ম্যাডাম বললেন— আরাত্রিকার বাবা ফোন করে জানিয়েছেন পাড়ায় পুলিশ এসেছে, গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। আরাত্রিকা বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা না করে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি চলে যায়। পরে বাড়িতে যেনো ফোন করে দেয়। রাজি হয়ে আরাত্রিকা কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ী যাবার বাস। একটুও দ্বিধা না করে বাসে উঠে পড়লো। কারণ ওর মন পড়ে আছে পাড়ার ধুন্ধুমার কাণ্ডে। আর কোনো একজনের জন্য বুকের কোণে একটু ধুকপুকানিতো আছেই।
বাস বাড়ির কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছে। হঠাৎ বাসের চালক বাস একটু ঘুরিয়ে সোজা ডিপোতে নিয়ে এলেন। আরাত্রিকা বুঝলো গণ্ডগোলের কারণে বাস ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। কোনো পরোয়া নেই। দুই মিনিটের জায়গায় সাত মিনিট হাঁটবে। চলতে শুরু করতেই পিছনে বাবার কন্ঠস্বর। ” তোকে প্রিন্সিপাল কিছু বলেন নি। আমি তো ফোন করেছিলাম”। বাবাকে কি সব বলা যায়। বাবা তখন অফিসগামী। আশ্বাসের সুরে বললো –বাবা, তুমি চিন্তা না করে অফিসে যাও— আমি সাবধানে যাবো ও তোমায় পরে ফোন করবো। বাবা শুধু বললেন– সাবধানে যাস আর প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্য নিস।
আরাত্রিকা চলতে চলতে দুই একবার গুলির আওয়াজ পেলো। ওর মন এসবের সাক্ষী থাকার জন্য উদগ্রীব। আর সেইসঙ্গে ধুকপুকানির চিন্তা।
বাড়িতে ঢোকার গলির আগেই আচমকা একটি দৃঢ় বলিষ্ঠ হাত ওকে আচমকা টেনে অন্য গলিতে ঢুকিয়ে নিলো। আরাত্রিকা থতমত খেয়ে, ভয়ে হাতের অধিকারীর দিকে তাকালো। আরে বাপ— আর কেউ নয়— ওর ধুকপুকানি শুভম বসু। কর্কশ স্বরে আরাত্রিকাকে ধমকে বলে উঠলো—” সাহস বেশী, গুলির আওয়াজের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যাচ্ছ?? তোমাদের গলির মুখে গুলি চলছে। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে। আর তোমার কোনো পরোয়া নেই??” হায় ভগবান– আরাত্রিকা যে সুন্দর মোলায়েম কন্ঠের কবিতা গানে মুগ্ধ– তার এতো দৃঢ় কর্কশ স্বর!!!! হঠাৎ কোথা থেকে পাড়ার আরো দুটি ছেলে উপস্থিত। বলে উঠলো “শুভম দা, তুমি ওকে পেয়ে গেছো– মাসিমার চিন্তার অবসান। তুমি ওকে বাড়ি পৌঁছে দাও। আমরা বেরিয়ে গেলাম। ” এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ওরা পালালো। আর শুভম ওকে টেনে নিয়ে ঢুকলো কারুর বাড়ির বসার ঘরে।
আরাত্রিকা গলিটা চিনতো। কিন্তু ওয়াকিবহাল ছিলো না। সেই বসার ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এবার প্রবেশ আর একটি বাড়ির রান্নাঘরে। আরাত্রিকা পুরো ঘটনায় নির্বাক। কথা হারিয়ে গেছে। রান্নাঘরে আসতেই এক ভদ্রমহিলা বললেন পিছন ফাঁকা আছে। তোরা এখান দিয়ে যা। ওখান থেকে বার হতেই সামনে ছাই গাদা। তার পরেই ওদের বাড়ী। মা আর ভাই বারান্দায় দাঁড়ানো। আরাত্রিকা বুঝলো এসব মায়ের কাজ। রাগও ধরলো— সারাক্ষণ বাউন্ডুলে বলে বকাবকি ওদের। আবার সাহায্য চাওয়া ওদের কাছেই।
এতক্ষণে শুভম মহাশয় ওকে প্রশ্ন করলেন—লাফাতে পারবে তো? হ্যাঁ বলে দিয়েই ভাবলো— শাড়ী পরে তো জীবনে লাফায় নি। কতোটুকু লাফাতে হবে কে জানে? সাহসে বুক বাঁধলো। ওদের বাড়ির পাঁচিল ছোটো,, কিন্তু তার ওপর ভাঙা কাঁচ লাগানো। হঠাৎ দেখে একটি ছোটো মই দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে শুভম ওকে মইতে তুলে দিলো। হাতের ব্যাগ পাঁচিলের ওদিকে ভাইয়ের হাতে চালান করে দিয়ে সাবধানে ওকে মই থেকে পাঁচিলের ওপারে লাফাতে বললো। ভাই প্রস্তুত ছিলো,, দিদিকে ধরে ফেললো। শ্বাস নিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে মই ও উদ্ধারকারী উধাও।
রাত্রে ভাই খবর আনলো শুভম ও আরো পাঁচজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। শুভম হাতে পায়ে গুলির আঘাত পেয়েছে। আরাত্রিকাকে পৌঁছে দিয়ে পালাবার সময় পুলিশ ধরে। পুলিশের হাতে থেকে পালাবার সময় ওর গুলি লাগে। সবার প্রচন্ড মন খারাপ। আরাত্রিকা খালি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করলো। পুরো ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হলো। জানা গেলো শুভমের পাঁচ ও অন্যদের দুইবছরের জেল হয়েছে।
পাঁচবছর অনেকটা সময়। আরাত্রিকার অপেক্ষায় বাবা মা ছেদ টানলেন ওর বিয়ে দিয়ে। আর তাছাড়া কার জন্য অপেক্ষা করবে? শুভমের কাছে ওর পরিচয় কি তাতো ও জানে না। ওর মনের কোণে শুভম মৃদু স্পন্দনের মতো রয়ে গেলো। পাঁচবছর পরেও কেউ ওর খবর জানে না। শুধু জানে শুভম ছাড়া পেয়ে কোথাও চলে গেছে।
বেলা বাড়ছে, রোদের তেজ কড়া হচ্ছে। আরাত্রিকা ওর চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে পড়লো। আর তখনই আগের দিনের টেবিলে রাখা খবরের কাগজে চোখ পড়লো। কাগজের এক কোণে ছোট্ট কয়েক লাইনের একটি সংবাদ—- নকশালযুগের নামকরা নেতা শুভম বসু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হিমালয়ের পাদদেশে একটি ছোট্ট গ্রামে স্কুলশিক্ষক ছিলেন। গ্রামের কিছু লোক ছাড়া শেষ সময়ে মৃতদেহের পাশে আর কেউ ছিলো না।
গ্রামের লোকেরাই শেষকৃত্য করেন। অজান্তে আরাত্রিকার চোখের কয়েকফোঁটা জলে খবরটি স্নান করে শুদ্ধ হলো। আরাত্রিকার নিজের মন খারাপের কারণ মনে পড়লো।।।

 

About the Authoress

_লেখিকা পরিচিতি, লেখিকার মুখবন্ধ থেকে : বাবার ইচ্ছে ছিল আমি সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করি এবং খাতা কলম আমার সাথী হোক। কিন্তু অত্যন্ত অলস ছিলাম তাই বাবার ইচ্ছে পূর্ণ করতে পারিনি। গৃহবধূ, স্ত্রী ও মা হয়ে সংসার সমুদ্র সাঁতরে কিনারায় পৌঁছে দেখি নিজের একান্ত বলে কিছু নেই। একটা অপূর্ণতার অভাব আমায় ঘিরে ধরেছে। সেই অপূর্ণতা দূর করে নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য হাতে তুলে নিলাম কাগজ, কলম বাবার আশীর্বাদ সাথে নিয়ে।