সম্প্রতি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখাটি লিখছি।

 গতবছর থেকে কোভিডের সংক্রমণে ‘ ত্রাহি ত্রাহি’ করছি। এবছর পরিস্থিতি আরও ভয়ানক। তবু এর মধ্যে নিজেদের প্রয়োজনে স্বাস্থবিধি পালন করে আক্রান্ত যাতে না হৈ,সে ব্যাপারে সচেতন থাকছি। আরেকটু খোলাসা করে বললে, মহামারীর ভয়টা কাটাতে তৎপর হচ্ছি। ‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ জপে যাচ্ছি। কারণ একটি চারবছর হতে চলা শিশুকন্যার মনে ভয় ধরিয়ে দিতে নারাজ।

 অতিমারীর প্রকোপ শিশুকে সঙ্গে করে সামাল দেওয়া মুখের কথা নয়। ওরা প্রথম থেকে দেখছে, মুখে মাস্ক পরে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে হয়, বাইরে থেকে এসে সোজা স্নান, বারবার স্যানিটাইজার ঘষতে হয়,আর কেউ যদি বাড়িতে আসে তাহলে সে চলে যাওয়ার পর ঘর মুছতে হয়। মানে, সহজ মেলামেশায় ওরা অভ্যস্ত হচ্ছে না। খুব কষ্টকর, দুঃখজনক-ও।

নিয়ম অনুযায়ী, আমার মেয়ের এখন প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে পড়ার কথা। একই সঙ্গে মা হয়েছেন, এমন পরিচিতরা তাদের সন্তানদের জন্য এই পবিত্র কাজটি করে ফেলেছেন। জানছি,এই তিন চার বছরের বাচ্চাদের টানা চার ঘণ্টা অনলাইন ক্লাস চলছে। দ্বন্দ আসছে এখান থেকেই। আমার সন্তান কী তাহলে পিছিয়ে থাকছে? পরক্ষণেই ভাবছি,কৈয়ের ঝাঁকে সামিল করিয়ে ‘বিদ্যার্জন’ এভাবে কী আদৌ কিছু শেখাতে পারে? প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ই হল— শিশুর সামাজিকীকরণ, socialization. পরিচিত পরিবেশের বাইরে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় স্কুল। সেখানে সে নিয়মকানুন শেখে। স্কুল ইউনিফর্ম,প্রার্থনা, সময় নির্দিষ্ট ক্লাস এগুলো সব শিশুমনে গড়ে দিতে থাকে,নিয়মনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। অনুকরণপ্রিয় শিশুরা পাশাপাশি অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে শিখতে শিখতে তাদের মনে তৈরি হয়— সহযোগিতা, সহমর্মিতা, অংশগ্রহণ এসব গঠনমূলক গুণ। অনলাইন ক্লাসে এসব অভিজ্ঞতা তাদের হচ্ছে না। সে জানছে, স্কুল মানে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ। স্কুল সম্পর্কে সঠিক ধারণাই প্রাক-প্রাথমিক শিশুর থাকছে না। শিশুর মনোযোগের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, দীর্ঘ সময় ধরে দূরবর্তী শিক্ষা তাদের আরো অস্থির করছে। আগ্রহ হারাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা যখন স্কুলে যাবে, তখন তাদের পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতা ও সদ্যপ্রাপ্ত অভিজ্ঞতার সংঘাত হবে,হবেই। তাই বলে কী শিক্ষা বন্ধ থাকবে???

উপায় পরামর্শ হতে পারে এইরকম— সপ্তাহে দুদিন একঘন্টা ক্লাস হোক। A for apple, B for ball, অআকখ, তোমার বাবার নাম কী, পাঁচটি ফুলের নাম ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হোক স্কুলের ছবি। উঁচু ক্লাসের দাদাদিদিরা কোভিডের আগে যেমনভাবে স্কুলে পড়ত, দুষ্টুমি করত,শিখত সেসবের ছোট ছোট ক্লিপিং। এতে করে আর কিছু নয়, শিশুদের কাছে অন্তত এই বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়া হবে যে, আমরা একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কঠিন সময়। সময়টা কেটে গেলে আবার আমরা ‘ আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এ ফিরে যাব। ফেরাটা হবে, ভবিষ্যতের দিকে ফেরা।

আতঙ্কিত শৈশবে থাকা এই শিশুগুলোকে উত্তরণের দিশা দেখাতে হবে আমাদেরকেই। জীবনভিত্তিক পাঠ্যক্রম দিয়ে তাদের পাঠ শুরু হোক। নামকেওয়াস্তে পড়াশোনা করানোর অছিলায় ওদের শৈশবকে আরো দুর্বিষহ করার ভুল যেন না হয়। নজর করে দেখুন,ঐ অপাপবিদ্ধ মুখগুলো আপনার আমার দিকে তাকিয়ে বলছে — ” আমরা ঘাসের ছোট ছোট ফুল/ হাওয়াতে দোলাই মাথা/ তুলো না মোদের দোলো না পায়ে/ ছিঁড়ো না নরম পাতা”

 

About the Author

লেখিকা পরিচিতি: কুন্তলা ভট্টাচার্য। মেজাজে বাঙাল,চলনে ঘটি। পুরনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শখ। গান অন্ত প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ,স্বামী বিবেকানন্দের সময়কার কোলকাতা দেখার ভীষণ ইচ্ছে। উত্তর কোলকাতার বিশেষ ভক্ত। বর্তমানে শিশুকন্যার মা হিসেবে নিজেকেও তার সমবয়সী ভাবতে সাহস রাখে। পেশা: পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী স্কুলে দর্শনের শিক্ষিকা।