Original Bangla version

*হায়াৎ খান লেন থেকে রামায়ন*আমাদের শৈশবে মধ্য-কলকাতার হায়াৎ খাঁ লেন পাড়াতে এক সাফাইকর্মী ছিল।
সেকালে অবশ্য ‘জমাদার’ বলবার চল ছিল, তাতে কেউ কিছু মনে করত না।কালো গাট্টাগোট্টা চেহারার অবাঙালী এক মানুষ ছিল সে, বয়স বিশ- ত্রিশ যা কিছু হতে পারে।  পরনে নেংটির মতো টাইট করে পরা ধুতি বা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, কোমরে গামছা জড়ানো। গলার স্বরটি ছিল তার একটু বেশি রকমেরই কর্কশ। ডান ভুরু উপরে একটা আঁচিল! কুচি কুচি করে কাটা কালো চুল মাথায়।সক্কালবেলাতেই তার দু’টি মস্ত ঝাড়ু নিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে আসত সে। সে কাজটা  হয়ে গেলে পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে তাদের কলতলা, স্নানের ঘর, পায়খানা (এখনকার ভাষায় ‘টয়লেট’) সব ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিত, বালতি করে করে তাকে জল ঢেলে দিতে হতো এ’জন্য, সঙ্গে মাঝে মাঝে চুন বা ব্লিচিং পাউডারও। এই বাবদ বাড়ি বাড়ি তার    হফতা-হিসেব করা থাকত হয়ত, আমরা ছোটরা তখন জানতাম না অতশত।নামটি তাহার রতন !
আমাদের শেখানো  হয়েছিল তাকে ‘রতন-দা’ বলে ডাকতে, আমরা ছোট ভাইবোনেরা তা-ই ডাকতাম। আর সে আমাকে আদর করে ডাকত ‘ছোঁটেবাবু’ !    দু’চারটে রং-পেন্সিল উপহার দিলে বড্ড খুশি হতো সে। ঠাকুমা মাঝে মাঝে তার হাতে আলগোছে মুড়ির মোয়া তুলে দিতেন।রতনার বাবা ছিল ‘পচা’। বুড়ো লোক। সে কম আসত। আর তাকে ‘পচা’ বলে ডাকলে অখুশি হতো। তার ভালো নাম নাকি ‘প্রচেত’। তাকে ‘প্রচেত’ বলেই ডাকতে হবে। ঠাগমা   মুখ ঝামটা দিয়ে বলতেন, ‘এঁ নেই ওঁ আছে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন! বাড়ির কত্তার নাম দু অক্ষরের মহাদেবের নামে, আর জমোদারের নাম প্রচেত ! পারি না বাপু!’
আমার ঠাকুর্দার নাম ছিল ‘শিব’ (সেকালের স্ত্রী-রা স্বামীর নাম মুখে আনতেন না)।রতনের কিন্তু একটা বদনাম ছিল!পাড়ার বড়োরা বলাবলি করত, আমরা ছোটরা জনান্তিকে শুনে ফেলেছিলাম।
সে নাকি আসলে ডাকাত!
সকালে সাফাই এর কাজ করলেও রাতের বেলা শিয়ালদহ রেল-ইয়ার্ডে সে নাকি ওয়াগান-ব্রেকারদের দলে ভিড়ে যায়। ওপর মহলে সব সড়  করা আছে বলে এই সব করেও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে !
বোঝো কাণ্ডখানা!এরপর একদিনের ঘটনায় সব কিছু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল।
সে গল্পই বলতে বসেছি আজ।তখন  ভরা বর্ষাকাল।
আমার প্রাণের বন্ধু উদয়ের জন্মদিন বিশে  জুলাই। ওর মা আমাকে বললেন, ‘বাছা রামু, কাল রাতে তুই আমাদের এখানে খাবি। তোর কাকাবাবু ইলিশ মাছ আনবেন বলেছেন।’ইলিশ ! তায় আবার প্রিয় বন্ধুর জন্মদিনে!
বিকেল হতে-না-হতেই তাই এক বাক্স ক্যামেলের রঙ পেন্সিল উপহার কিনে নিয়ে চললুম আমি বন্ধুর বাড়ি। আরও দু’এক জন পাড়ার  বন্ধু এসেছিল সেখানে , উদয়ের মামাতো ভাইবোনেরাও এসেছিল। খুব হৈ হুল্লোড় হল।গল্পটা   সেখানে নয়, গল্প টা শুরু হল সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটা থেকে যখন শুরু হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি!জমিয়ে ইলিশ খাবো কী, মনে ভয়, কী করে বাড়ি ফিরব, যদিও বেলেঘাটা থেকে শিয়ালদহ এমন কিছু দূর নয়।রাত যখন সাড়ে নয়টা, উদয়দের বাড়ির সামনে এক হাঁটু জল।
আমি প্রায় কান্না জুড়ে দিয়েছি। বাড়ি ফিরব কী করে? জ্যাঠামশায় খুব বকবেন এতো রাত করে বাড়ি ফিরলে! শেষটায় বৃষ্টি একটু ধরতে এগিয়ে এলেন উদয়ের মামাবাবু।  বললেন, ‘চল্, তোকে আমি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসছি।’চমৎকার মানুষ এই মামাবাবু।  ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। মিষ্টি কণ্ঠস্বর। খুব ভালো সেতার বাজান।   ‘আকাশবাণী’-তেও শোনা যায় শ্রীনারদ বিশ্বাসের বাদন। নাম আছে।মেইন রোডটি তখন  ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ভাগ্যিস মামাবাবু  সঙ্গে ছিলেন, নৈলে কেলাস এইটের সেই অধম ছাত্রটির মুরোদ হতো না এই অন্ধকারে  জল ঠেলে একা বাড়ি ফিরবার।একটা ভুল কিন্তু মামা করে ফেলেছিলেন।   রাস্তা শর্টকাট করতে রেল ব্রিজ থেকে নেমে কোণাকুণি কেটে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন লাইন টপকে। সেইখানেই ঘটে গেল  ঘটনাটা।রেল লাইন বরাবর কিছু দূর হেঁটেই খেয়াল করলাম যে কয়েকটি ছায়ামূর্তি আমাদের ফলো করেছে। ধপ্‌  ধপ্‌ করে তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে পিছনে । বৃষ্টিটা তখন একেবারেই থেমে গেছে, আর এই উঁচু জায়গাটাতে জলও জমে নেই।হঠাৎ মামা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে পাশের এক ভাঙাচোরা ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন, বললেন, ‘শ শ শ শ…..আমরা ভুল করে খুব বিপজ্জনক একটা  জায়গায় চলে এসেছি রে!  এটা ওয়াগান-ব্রেকারদের আড্ডাখানা। তুই চুপ করে বসে থাক্‌।’বলতে বলতে শুনি ঝুপড়ির ঠিক বাইরে কয়েক জন লোকের কণ্ঠস্বর, হিন্দিতে বলাবলি করছে, ‘কোথায় গেল? কোথায় গেল? এই তো এখানেই ছিল’।
নেশাগ্রস্ত কণ্ঠস্বর।
আমি ভয়ে গুটিসুটি মেরে ঝুপড়ির আরও ভিতরের দিকে ঠেসে গেলাম। পাশেই মামা।
কিন্তু পরক্ষণেই ওঁর সাদা পাঞ্জাবীর খুঁট টা ধরে একটা লোক ওঁকে হিড়্ হিড়্ করে টেনে বের করল ঝুপড়ি থেকে।’খোল্‌ হাতঘড়ি। পকেটে আর কী আছে বের কর্‌।’ হিন্দিতে বলছে। আরও কয়েকটি গালিগালাজও করল।’দিচ্ছি। দিচ্ছি।’ মামা, শুনলাম বেশ তেজের সঙ্গে বললেন,  ‘ ঘড়ি দিচ্ছি। টাকাও দিয়ে দিচ্ছি।  গায়ে হাত দেবে না একদম।  গালি দিচ্ছ কেন? বলো রাম রাম, বলো বিষ্ণু বিষ্ণু’!’কেয়া বোলা?’ একটা অতি কর্কশ স্বর ভেসে এলো ওদের মধ্যে থেকে। গলাটা আমার খুব চেনা লাগল।
‘রাম রাম বলো। বলো শ্রীবিষ্ণু শ্রীবিষ্ণু।’ উচ্চৈঃস্বরে বললেন মামা , বেশ তেজের সঙ্গে।
ঝুপড়ির মধ্যে বসে আমি কাঁপছি ভয়ে ঠক ঠক করে। এই বোধহয় দিলে ভোজালির এক কোপ!মামাবাবু কিন্তু অকুতোভয়। বললেন, ‘বল্‌ ব্যাটাঃ   শ্রীবিষ্ণু  শ্রীবিষ্ণু! ‘
‘সিরি বিষেণ। সিরি বিষেণ।’ বললে সেই কর্কশ স্বর।
আমি ঝোপড়ির মধ্যে থেকে শুনছি সেই চেনা স্বর, কিন্তু গলা বাড়িয়ে দেখবার সাহস নেই।
‘না, বলো  শ্রীবিষ্ণু শ্রীবিষ্ণু!’
‘সিরি বিষেণ। সিরি বিষেণ।’
‘পারছিস না? বল্‌,  রাম রাম রাম রাম!’
‘মরা মরা মরা মরা!’হো হো করে হেসে উঠলেন মামাবাবু এই বিপদের মধ্যেও, ‘মরা কি রে, ব্যাটা ?! বল্‌, রাম রাম রাম রাম।’আবার এক দফা বৃষ্টি ঝেঁপে এলো।  উপশ্রান্তি বৃষ্টিতে আমরা সকলে ভিজে ঢোল।সেদিন যে কোন্‌গুরুবলে অক্ষতদেহে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছিলাম সে আমিই জানি!

(এর পর পরবর্তী সংখ্যায়)

 

 English translation

Hyaat Khan Lane
(English translation)During our teens, in our moholla of central Calcutta in Hyatt Khan Lane, we had seen a Safai Karmachari, whose name was Ratan. In those days, they were generally called as ‘Jamadars’ and nobody took that as derogatory. Even the addressees also.He was a very dark man with a stout build – anything between 20 -30 years of age. He wore a dhoti or a lungi, gathered in a skin hugging style like a loin cloth. A ganjee was his attire for torso and a gamcha was tied around his waist. He sported a thick crop of short hair. On his right eyebrow, a big mole was very prominent. He had a signature harsh voice.Every morning in early hours, he will come with his two big brooms to sweep the streets. On completing that, he will come to various moholla households to clean their bathrooms and open hand-pump area. House members have to pour water themselves(to save hand pump and buckets free from jamadar’s touch). He would be paid some money for this extra job.His name was Ratan – we had been taught to call him Ratan – da. We, all the siblings, addressed him thus. He caressingly called me Chotey Babu. He got escatic if I had given him some colour pencil sometime. My granny sometime gave him homemade goodies, after ‘saving’ herself from his touch.Ratan-da’s father was Pocha. He was an old man, rarely coming to sweeping duties. He used to become sore when addressed as Pocha. He had another name – Prochet, a name which he loved to be called by. My granny grumbled – lo, our head of family has a simple name (Shiv) while our jamadar can have such an fancy name !
( She had never uttered the word Shiv as in those days wives were restrained to utter the name of their husbands).This Ratan carried an infamy that he is dacoit under the surface. Seniors talked about it in hushed tones – we, the youger brigade, had just overheard it. Ratan does sweeping job in day time. But during nightly hours, he joins wagon-breakers’ team at Sealdah rail yard. He has his network with proper authorities. That’s why he can roam about as a free man.One day an incident happened which removed the shroud of such hearsay. I will be telling that story now.It was middle of a full blown monsoon. My friend Uday had his birthday. His mother invited me to their place for dinner. A treat of Ilish (a fish delicacy) was tempting enough to not missing the occasion. Uday’s friends from the mohalla had also dropped in and we had a gala time enjoying ourselves.Now the suspense of the story started. Before dinner, rain started pouring in full glory. The pleasure of dinner was much dampened by the worry of returning home after dinner in this incessant weather at this hour. When the dinner was over, the road was water-logged in knee-dip water.I was about to cry on the looming hazard of returning home. Then Uday’s mama came forward and volunteered to drop me home. He was a nice person, very good-looking in a traditional way, had a nice voice. He was also a renowned sitarist, giving programs from Akashvani (radio)We two set out in that darkness to the water-logged road. My own courage would certainly have fallen short to undertake such a trip alone.Mama tried to make a short cut by crossing rail tracks. It happened then.For some time we were sensing some are following us. The thumping of their footsteps was within our earshot, though none was visible in the darkness. All of a sudden Mama gave me sudden twitch and pulled me inside a dark, empty roadside shanty. ‘S…h…., remain absolutely silent. We had entered in a dangerous den of wagon breakers’.With this we heard some tipsy voice outside – where they have gone ? They were here only. In raw fear, I slumped into a corner holding Mama’s kurta. At that instant, somebody has spotted us and he pulled Mama out from the shanty in the open.They hollered with abusive slangs – remove your watch. Take out all you have in your pocket.But mama had put up a brave facade. Fearlessly he countered them, Yes. I am giving you all. But don’t dare to hit. And why are you uttering slangs ? Say Rama Rama Vishnu Vishnu for penance.
[10/06, 11:00 am] 77580 71790: A particularly harsh voice sprang up from the group, keya bola ?Say Rama Rama Vishnu Vishnu, undaunted Mama ordained spiritedly. Inside the shanty, I was frozen in fear of Mama falling prey to their brutality. But Mama has overcome his fear and continued his yelling in authority, Tell you fool. Tell Shri Vishnu, Shri Vishnu.A faint sound arose in that harsh voice – Siri Bishen, Siri Bishen.
– No. Tell Shri Vishnu – thundered Mama.
Again response came – Siri Bishen, Siri Bishen.
– Well, is it becoming difficult ? Then simply tell Rama Rama.
A feebly reply came, Mara (dead), MaraIn that looming life threat, Mama burst into a laughter, You rascal, what is Mara ? Tell Rama.There was a fresh lash of shower and all got drenched.On that day, how I returned home unharmed is beyond my expression.

(To be continued)

About the author

Dipankar Choudhuri (born 1961) is a Kolkata based author. He had his schooling at Hindu School and Presidency college. He had been working with a bank and travelled extensively. He regularly writes science fiction stories for teenagers which are published in various magazines. He has 2 books to his credit. Post retirement (from bank), he plans to devote his full time in writing.