রবীন্দ্রনাথ- ১৬০ বছর পরেও যে তাঁর অন্ত নাহি হেরি
রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১৬০ বছর পর ২৫শে বৈশাখ সকালে ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার…’গানটি শুনে এই সব ভাবনা ঘনালো..
তাঁর কর্মকান্ড: বোলপুরের ঊষর প্রান্তরে শান্তিনিকেতন- শ্রীনিকেতনের বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী, যাতায়াত যখন অতি দুরূহ- সেই কালে পৃথিবীর মনীষীদের শিক্ষাদানের জন্য সেখানে টেনে আনার পাশাপাশি অজস্র গান-কবিতা-নাটক, রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ নিয়ে গভীর ও ব্যতিক্রমী চিন্তা, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রাখীবন্ধনকে একটি একতার প্রতীক করে তোলা, ভারত, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা-এমন কি শান্তিনিকেতনে শিক্ষিত আনন্দ সমরাকুন রচিত শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতেও তাঁর প্রভাব – এত সব এবং আরো অনেক কিছু যার একটি ছোট খন্ড উজ্জ্বল আর সদর্থক করতে পারে আমাদের জীবন – দেখে শরৎচন্দ্রের ভাষা ধার করতে হয়,”তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।”
এখনও… রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের আশি বছর পরেও ‘জারজ’ আখ্যা একটি শিশুকে মার্কা মেরে দেওয়া, তাকে অচ্ছ্যুৎ করে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। অথচ কতকাল আগে উপনিষদ খুঁজে রবীন্দ্রনাথ সেরকম একটি শিশুকে হৃদয়ে অশ্রুজল টেনে আনা ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতায় গুরু গৌতমের মুখে বলেন, “তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত”। তাঁর শান্তিনিকেতন তিনি প্রাচীন গুরুকুলের মত প্রকৃতির কোলে গড়ে তুললেও সেখানে জাতি- ধর্ম-ভাষার ভেদ না রেখে তিনি শিখিয়েছেন কী করে প্রাচীনকাল আর সমকালের ভাল জিনিসগুলো মিলিয়ে নিতে হয়। কেন যেন মনে হয়, শান্তিনিকেতন না থাকলে বাঙলা সাহিত্যের দিকপাল মুজতবা আলি আর ভারতীয় স্থাপত্যের যুগপুরুষ রামকিঙ্কর বেইজকে আমরা পেতাম না।
অর্থের অভাব ছিল না। মনে করতেন স্বচ্ছলতার কারণেই বোধ হয় পৃথিবীর একটা বিরাট অংশ তাঁর কাছে যেন অধরা থেকে যাচ্ছে। এত সফল হওয়া সত্ত্বেও বিনয়ী মানুষটি নিজেই ঐকতান কবিতায় শুরুতে লেখেন, “বিশাল বিশ্বের আয়োজন, মন মোর জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এক কোণ।“আর ঐ কবিতার অন্ত্যভাগে উচ্চারিত “যে আছে মাটির কাছাকাছি সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।“ অথচ, তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে দেখি, কত বিচিত্র মানুষের কথা ফুটে উঠেছে সেখানে। দিনমজুরের মেয়ে জননীর প্রতিনিধি ‘অতি ছোট দিদি’ থেকে ডাকঘর-এর অসুস্থ অমল অথবা মুক্তি কবিতায় সাধারণ যে মেয়েটি যে ঘরের কোণে দশের মুখের কথার ভরসায় দিন-মাস-বছর কাটিয়ে জীবনপথের প্রান্তে এসে তার অসাধারণত্বের প্রথম ছোঁয়া পায়, বলে ওঠে, “আমি নারী, আমি মহিয়সী, আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী। আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যা হত কাননে ফুল-ফোটা।“ সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ বিসর্জন কবিতার মল্লিকা যখন গল্পকথায় বিশ্বাস করে সন্তানকে সুস্থ করার আশায় গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে মা গঙ্গা তাকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দেবেন বলে। মায়ে্র শংকাময় আর্তি, ‘দিবি নে ফিরায়ে’-র পর রবীন্দ্রনাথ শুধু লেখেন “মর্মরিল বনভুমি দক্ষিণের বায়ে।“ সহায়সম্বলহীন মল্লিকা যে তার নিজের জীবন দিয়ে বাচচাটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল প্রায় অজান্তেই আমরা তার অসহায় মাতৃহৃদয়ের বেদনার শরিক হয়ে পড়ি। দেবতার গ্রাস কবিতা মনে করুন- মৈত্রমহাশয় নিজের কুসংস্কারবশতঃ একটি বালককে জলে বিসর্জন দিতে বাধ্য করার পরমুহূর্তেই সেই অতি নিষ্ঠুর কাজের অসারতা বুঝতে পেরে ছেলেটিকে বাঁচানোর চেষ্টায় নিজের প্রাণও বিসর্জন দেন।
কবি-দার্শনিকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ হল দৃষ্টির ব্যাপ্তি। তাঁদের কাছে একটি শিশু শিশুমাত্র। বাবা-মায়ের কোন গুণ বা দোষ দিয়ে তাঁর বিচার করা অন্যায়। তাই শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেন-এর ধনীদের শিশুর প্রতি বিরাগ দেখে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লেখেন, “মানুষকে মানুষ বলিয়া বেদনা বোধ করিতে হইবে – সে ধনীর ঘরে জন্মগ্রহণ করিলেও।“
পাঠকের ধৈর্যচ্যূতির ভয়ে তাঁর নাটক, গল্প, প্রবন্ধে আজকের সময়ের জন্যও যে আত্মিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পথনির্দেশ আছে তা অনুচ্চারিত রেখে যেটুকু বলা হল তাতেও ভাবনা আসে, আমাদেরই মত মানুষ রবীন্দ্রনাথ এত কিছু করে দেখিয়ে গেলেন একজনের পক্ষে কতটা করা সম্ভব। তবুও কাজে, চিন্তার বিবিধতায় ও বিস্তারে আমরা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারি না কেন- ঈশ্বর কি তাঁকে বিশেষভাবে, অসাধারণ করে তৈরী করেছেন?
আস্তিক ভাবনা বলে, ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আমাকে না দেবার মত বড় অবিচার করেন নি- আমার “স্রষ্টা কুমোর গড়তে গিয়ে দেননি ফাঁকি”। নাস্তিক মন বলে মহত্ব যত বড়ই হোক না কেন, তার পিছনে একটা পদ্ধতি (মেথড) কাজ করে। কত বড় হবে তুমি তার আভাস তোমার ভাবনায়।
‘হে নূতন’ গানটি আবার শুনি। রবীন্দ্রনাথ এটি লিখেছিলেন নিজের জন্মদিন নিয়ে। প্রতি ২৫শে বৈশাখে তিনি পুরনোকে বিদায় দিয়ে তিনি আবার নবীন হ’ন, নিজেকে বলেন, “হে নূতন.. তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন, সূর্যের মতন.. ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়..”
অসীমকে অবাক করে দেবার উচ্চাশা আর স্পর্ধা যার, সে মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠবে..উঠবেই।
অন্যদের সাথে, আমাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের তফাৎ সৃষ্টিকর্তার অবিচারে নয়, মস্তিষ্কে নয়। আমরা তাঁর থেকে আলাদা স্বপ্নের সীমাবদ্ধতায়, স্পর্ধার অক্ষমতায়।
২০শে মে, ২০২১ -অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা। কবিকে আমার নিবেদন
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ
ধূলার তলে। ” বর্তমান লেখককে আমার শুভেচ্ছা ।
tynbhqwNHEXjlef
IRYFxmZUsjMO
PpoEKdrxsXGIgAZj