*ইয়ে যো দেশ হ্যায় তেরা* (১০০০ শব্দ)

বেলপাতার মতন ১৫ই আগস্ট তিনটে পাতায় বিছিয়ে আছে। বোঁটার প্রথম পাতায় ছাত্রীবেলা। তখন স্বাধীনতা দিবস মানে রিহার্সাল। আমরা যারা, ব্যাঙের বিজ্ঞানসম্মত নাম বলতে পারি নি,সুদকষার অঙ্ক মেলাতে পারি নি, রিহার্সাল আমাদের বাঁচিয়ে দিত। ক্লাস ভর্তি মেয়েদের সামনে চিড়বিড়ানি লজ্জা থেকে তফাতে রাখত। ভালো ছাত্রীরা রিহার্সালে সময় নষ্ট করে না। দিনের দিন ওদের পারফর্ম করার ব্যবস্থা থাকত। আমাদের অত এলেম ছিল না। ঘষেমেজে তৈরি হতে হত। তৈরি হতে হতে আমরা জেনে যাচ্ছিলাম, আঁটসাঁট পাঠ্যক্রমের বাইরে অনেক অনেক hidden curriculum-এর সংকেত। নাচ গান করা মেয়েরা পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে। উঁচু ক্লাসের ডানপিটে দিদি,যে কাচ্চাবাচ্চাদের শাসনে রাখছে, দিদিটা অমুক দাদার সঙ্গে প্রেম করে। প্রেম করা খুব খুব বাজে। জুনিয়র বোনের খাতা দেখে গানে গলা মেলাচ্ছি। ঐ বোনটা টিফিন আনে নি। ওর মদ্যপ বাবা মাকে পিটিয়েছে। সহপাঠী বন্ধু মলাটে সচীন তেন্ডুলকরের ছবি। আমারও ওরম লাগবে। আর এক এক গান, পাঠ বছর বছর শুনতে শুনতে মুখস্থ। ‘ সকল সহা সকল বহা, মাতার মাতা’ থেকে মানে বের করছি— দিদা। মাতার মাতা মানে তো দিদাই হল! দিদা তারমানে সব সহ্য করে নেবে। চালাও জুলুম দিদার ওপর। কিংসফোর্ডকে খতম করবে ব’লে ক্ষুদিরাম মুজাফফরপুরে এলেন,কী থেকে কী হল- সব মগজস্থ। কলেজের স্বাধীনতা দিবস অনেকটাই গুরুগম্ভীর। মিশনারী কলেজ বলে আরো ভারী। প্যারেড-পতাকা-পাঠসমেত প্রগল্ভতা-বর্জিত পরিবেশ। এ পর্যন্ত আমাদের ঘিলুর শুধু ইনকামিং হয়েছে। শিখছি,জানছি- ধকল ধমক ছাড়াই। ‘Learning without burden’ যাকে বলে।

 

এবার ২নং পাতা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেকার তক্। তোলপাড় করা সময়। পাটে পাটে ভাঙছে পাঠ্যক্রম। টিভিতে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। দেশাত্মবোধক সিনেমা। পাড়ার ক্লাবে জাতীয়তাবাদী গান। অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। গোলামী না করলে যে ভিখ পায় না, বুঝে নিচ্ছি। তাহলে কী ছাতার মাথা স্বাধীনতা দিবস!!!! মানে কী এই স্বাধীনতা দিবসের??? জেরবার হচ্ছি ভেতরে ভেতরে। আত্মীয় স্বজন,পাড়া পড়শী তখন খুব তৎপর হয়ে যায়, অবিবাহিত মেয়েদের বিয়ে দিতে। কন্যাদানের মতো মহৎ কাজ করার লোভ সামলানো খুবই কঠিন। আমার বাবার তো তার মধ্যে ভি আর এস নেওয়া। এমতাবস্থায় কী করে বিয়ে না করে বসে আছি,এ্যাঁ!!! ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ। কী স্পর্ধা!!!! ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’ ছুড়ে মারছি ওদের মুখে। রাষ্ট্র, রাজ্য, নেতা মন্ত্রী সবাইকেই পারলে অনেক কিছু ছুঁড়ে মারার ইচ্ছে। কিন্তু পারি না। পরাধীন। দাসত্ব আমাদের মজ্জাগত। গোটা দেশ,রাজ্য, জেলা,পাড়া,পাড়ার বাড়ি— সবটাই একটা ছাঁচ। প্রতিটা পরিবারের একা একজন সদস্য দিয়েই যে শুরু হয় আদমশুমারি, আমরা মনে রাখি না। স্বাধীনতা খাতায় কলমে পেয়ে ঐ টায়ে টায়ে পাস করে গিয়েই মোক্ষপ্রাপ্তি হয়ে গেছে। উপেক্ষিত ব্যক্তিমানুষ। অলৌকিক সংবিধান আর লৌকিক বাস্তবতার ঠোক্কর দেখছি। শ্লোগানে শ্লোগানে নিজেকে অবিচল রাখছি। রক্তাক্ষয়ী সংগ্রাম সামনাসামনি দেখি নি। নিজের জন্য নিজের লড়াইকেই বানিয়ে নিলাম ‘ স্বাধীনতা সংগ্রাম’।

তিন নম্বর পাতায় এসে দেখছি, তাগড়াই মাপের দেশভক্তি নেই। বাধ্যতামূলক দেশপ্রেম দেখাতে যতটুকু নাটক করতে হয় করি। সত্যি বলতে কি, বর্ডার সিনেমা দেখে পাকিস্তান কে শত্রু ধরে নেওয়া বা গল্প উপন্যাসের গাঁথা মোটেও দেশপ্রেম দেয় না। দৈবক্রমে কোনো বিপ্লব দেখা হয় নি। ফলে ১৫ই আগস্টের পালনীয় অনুষ্ঠানে আমাদের ঘুম পায়, প্রোগ্রাম শেষ হলে কোন ট্রেন ধরতে পারব হিসেব করি, বাড়ি গিয়ে কোন সিরিজটা শেষ করবো, ঐ ম্যাডাম শাড়িটা কত উঁচুতে পরেছে— এসবের মধ্যেই থেকে যায়। সরকারী নিয়ম পালন-ও হল, সামাজিকতাও হল। কিন্তু ভেতরের আত্মনীতি!!!! স্বয়ংক্রিয় আত্মনৈতিক বোধের ঘর যে ফাঁকা। শূন্য। ‘শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ, পথে পথে’ হাত শূন্য,পা শূন্য,চোখ কান নাকসমেত একাদশেন্দ্রিয় শূন্য। পরাধীন। দেহগতভাবে প্রথমেই আমরা পরাধীন। দেহাতীত অথচ সজাগ যে অন্তরেন্দ্রিয়- মন, সেই মন তো মুক্ত হতে পারত। স্বাধীন। ‘দেহগত-সমাজগত আমি’ আর ‘মনোগত আমি’-র মিহি আড়াল সরিয়ে দেখা যেত কী অফুরন্ত স্বাধীনতা আছে। স্বাধীনতার সিন্দুক আছে অথচ চাবি গেছে হারিয়ে। তবু হাল ছাড়ি না। হারিয়ে খুঁজে পাওয়া হারাধন বড় মূলধন। সেইসব সংগ্রামী মানুষের ইচ্ছেরা এখন-ও ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সেই নির্ভিক,লক্ষ্যে অবিচল মানুষদের জাগরস্বপ্ন। ” লোহার শিকের ওপর হাত, তিনি তাকিয়ে আছেন অন্ধকারের দিকে/ দৃষ্টি ভেদ করে যায় দেয়াল,অন্ধকার-ও বাঙ্ময় হয়/ সূর্য সেন পাঠালেন তার শেষ বাণী, / ” আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম?/ শুধু একটি মাত্র জিনিস,/ আমার স্বপ্ন সোনালী স্বপ্ন,/ এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম এই স্বপ্ন‌ দেখেছিলাম।” /সেই সব স্বপ্ন এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায়/শোনা যায় নিঃশ্বাসের শব্দ/ আর সব মরে স্বপ্ন মরে না/ অমরত্বের অন্য নাম হয়…” ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সেই সব স্বপ্ন)

খতিয়ে দেখলাম, একা মাস্টারদার স্বপ্নশক্তিতে বহু মানুষ সেসময় প্রভাবিত। আর এখন? স্বপ্ন যদি অমর হয়, এখনও কী সেই স্বপ্ন সমান জোরালো? কখনো সখনো ভাবি, ইংরেজদের সময় প্রতিপক্ষ একটি। এখন এই অযুত লক্ষ নিযুত কোটি প্রতিপক্ষের কার কার সঙ্গে লড়াই করব? এককে সাথ এক মুফৎ-এর চক্করে স্বাধীনতার সঙ্গে ফ্রি পেয়েছি দেশভাগ। সাম্প্রতিক রাজনীতি রসাতলের সেই স্মৃতিকে উস্কানি দিচ্ছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধে তখন দেখতে পাচ্ছি, সত্যিই সেই আশ্চর্য স্বপ্নেরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ২০২০-র ডার্বি ম্যাচে সেদিন দেখা গেল বিশাল ব্যানার, তাতে লেখা-” রক্ত দিয়ে কেনা মাটি,কাগজ দিয়ে নয়”। ঠিক সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দেশকে ভালোবাসলাম। কুর্নিশ করলাম ঐ ব্যানারবার্তার বিবেচক মনকে। ভণ্ড রাজনীতি কাদায় ফুটে ওঠা পদ্মফুল। জাতীয় ফুল। বটগাছের জাতীয় ছায়ায় ঠাঁই পায় সবাই। গাছ কখনও মানুষ বেছে বেছে ছায়া দেয় না। দুর্যোগের গোবর্ধনগিরি যে মাথা পেতে নিয়ে সকলকে আশ্বস্ত-আশ্রয় দেয়, সেইই ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’। বিধাতার খেলা এমন চমৎকার, ভারতের ভাগ্যে ‘জয় হে’ শোনার মর্যাদা দিল তেইশ বছরের তরুণ। নীরজ কাপুর। তেরঙ্গা পতাকা গায়ে জড়িয়ে, মাস্কের আড়ালে চকচকে চোখে গেয়ে গেল জাতীয় সঙ্গীত। বর্শার ফলায় ছিঁড়ে যাক পরাধীনতা। দূর হোক রাজভয়। স্বচ্ছ চিন্তায় বিচারে ভারত হোক ‘স্বচ্ছ ভারত’। ক্যালেন্ডারের লাল কালির দিন থেকে ১৫ই আগস্ট বের হয়ে আসুক দিনের ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডে। আশা আর স্বপ্ন ছাড়তে নেই। আমার ৩নং পাতার বিন্যাস চলবে, যদ্দিন বাঁচব,তদ্দিন। আশায় বেঁচে থাকব। বারবার মনে রাখব _”এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে/এই নিত্য অবনতি,দণ্ডে পলে পলে/এই আত্ম-অবমান,অন্তরে বাহিরে/এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নতশিরে/সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার/মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার/এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে/চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে/ মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে/ উদার আলোকমাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।।

(সমাপ্ত)

লেখিকা পরিচিতি: কুন্তলা ভট্টাচার্য। মেজাজে বাঙাল,চলনে ঘটি। পুরনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শখ। গান অন্ত প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ,স্বামী বিবেকানন্দের সময়কার কোলকাতা দেখার ভীষণ ইচ্ছে। উত্তর কোলকাতার বিশেষ ভক্ত। বর্তমানে শিশুকন্যার মা হিসেবে নিজেকেও তার সমবয়সী ভাবতে সাহস রাখে। পেশা: পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী স্কুলে দর্শনের শিক্ষিকা।