অরিজিৎ কথঞ্চিৎ/ অরিজিতের কলম

আ(হা) মরি বাংলা  ভাষা

ভীতির পৃষ্ঠভূমি– ইদানীং বাংলা ভাষা টিঁকবে কি না সেই ভয় আবার চাগাড় দিচ্ছে। ভয়টা বেশী যাঁরা কোন কারণে বাংলার বাইরে আছেন তাঁদের মধ্যে। এমন কি যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে আছেন, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তাঁদেরও ভীতি ক্রমবর্ধমান।

ভয়টা কিন্তু অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কোলকাতার রোটারি ক্লাবের পদস্থ আমার এক আত্মীয় ক্লাবের কমপিউটার ও সফটওয়্যার কিনে দেবার জন্য অনেক সরকারী স্কুলে যান। তাঁর কাছে শুনেছি কোলকাতার বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে ছাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাইমারী থেকে বারো ক্লাস অব্দি সাকুল্যে শ’দেড়েক ছাত্র। এক জন শিক্ষকের মতে বাংলা স্কুলে পড়তে আসতো বস্তির ছেলেমেয়েরা, বস্তি’র জায়গায় ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে যাওয়ায় তারা দূরে চলে গেছে। শহরে কোনক্রমে যারা টিঁকে আছেন, তাঁরাও বাচ্চাদের ইংরাজী স্কুলে পাঠাতে মরীয়া।

তাই পশ্চিমবঙ্গের শহুরে মানুষজনের বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আর চিন্তিত প্রবাসী বাঙ্গালীরা। তাঁরা বাইরে এসে একটু সম্পদের মুখ দেখলেও বাচ্চারা আবোল-তাবোল, টেনিদা, ফেলুদা, অপু-অমলের সাথে সম্পর্ক পাতাতে পারছে না, তা ছাড়া বাঙ্গালীর আজও প্রধান গর্ব রবীন্দ্রনাথের বই-ও পড়তে পারছে না, তখন সন্তানের জন্য ভয় ভাষার জন্য ভয়ে পরিণত হয়।

একটু ভাবলে কিন্তু মনে হয় এখনকার বিশ্বের প্রধান একটি ভাষা বাংলা’র সম্পর্কে এই ভয় অমূলক। নীচের ছবিটা দেখুন। বাংলা এখন পৃথিবীর ষষ্ঠ বহুল ব্যবহৃত ভাষা। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে তার জায়গা হিন্দীর পরেই। আন্তর্জাতিক স্তরে শুধু তিনটি ভাষা, ইংরাজী, মান্দারিন আর স্প্যানিশ বাংলার বেশ ওপরে। লক্ষ্য করে দেখুন, আরবীর সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বাংলা একদা বিশ্বজোড়া উপনিবেশ অধিকার করা পোর্তুগীজ, ফরাসীদের ভাষার ওপরে বাংলা।

 

‘ভয় ভাঙা সেই না’য়ে’- সত্যি কথা বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের শহুরে লোকেরা বাংলা ভাষা ত্যাগ করলেও, তার ব্যবহার থাকবে গ্রামে ও মফস্বলে। আপাততঃ, সেখানে ইংরাজী শেখানোর লোক নেই। এই বিষয়টা পরে আবার  ফিরবো।

বাংলার আসল জোর কিন্তু বাংলাদেশে। ভাষার প্রতি ভালবাসায় অনেক রক্ত আর বেদনায় সে দেশের সৃষ্টি। পাকিস্তানের কর্তারা প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় প্রভাবিত বাংলা মোটামুটি বর্জন করে উর্দু গ্রহণ করার কথা বলেন, তাতে কাজ না হওয়ায়  ১৯৪৯ সালে ভাষার ইসলামীকরণের চেষ্টায় বাংলা ভাষা আরবী হরফে লেখা শুরু করার কথা হয়। ১৯৪৮ সালে বাংলাভাষার সম্মানের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা যে আন্দোলন শুরু করেন, তা দীর্ঘ তেইশ বছর পরে বাংলাদেশের জন্ম দেয়। উর্দুর জায়গায় বাংলা-মা’কে বসিয়ে যে ভুল হয় নি তা এখনকার বাংলাদেশ পাকিস্তান, এমন কি ভারতের চেয়েও নানা বিষয়ে এগিয়ে গিয়ে তা প্রমাণ করেছে।

তাহ’লে পশ্চিমবঙ্গের কি উপায় (‘সুরের খাদ্যে জানো তো মা বাণী, নরের মিটে না ক্ষুধা’)-  যাঁরা চিন্তিত তাঁরা একটু পিছিয়ে দেখলে বুঝবেন, তাঁরা অনেকেই বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়েছেন। ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়তেই হবে এমন পাগলামি তখন ছিল না। সেটা শুরু হয় বাংলা স্কুলগুলিতে প্রাথমিকে ইংরাজি তুলে দেওয়া এবং ওপরের ক্লাসগুলিতেও ওই ভাষাটির গুরুত্ব কমিয়ে দেবার পর থেকে। কলেজে ঢুকলে ইংরাজিকে এড়িয়ে চলা অসম্ভব। বারো ক্লাস থেকেই রেফারেন্স বই থাকে ইংরাজীর। তার সাথে কুস্তি করতে গিয়ে বাংলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব অসুবিধে হয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে আমার চেনা দুটি মেধাবী ছাত্রকে এই কারণে কলেজ ছাড়তে দেখে আমার দুঃখ এখনও উজিয়ে ওঠে প্রায়-ই।  যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মেধা বেশী বয়সে ইংরাজি শিখতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা কিছুতেই পরবর্তী প্রজন্মকে ইংরাজী স্কুলের বাইরে রাখবেন না। ব্রিটেনে ইংরাজ মাত্র ছ’ কোটি, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা মিলিয়েও ইংরাজি মাতৃভাষা এমন জনসংখ্যা চল্লিশ কোটির বেশী হবে না, তবুও তার প্রায় একশ’ কোটি বেশী লোক কষ্ট করে ইংরাজী শিখছে তার কারণ ভাষাটি পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে দেয়, চাকরীর সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তোলে অনেক গুণ। এ ব্যাপারে বাস্তববুদ্ধির একটি আধুনিক উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া। দেশটি প্রধানতঃ ডাচ (ওলন্দাজ) কলোনি ছিল। সেখানকার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সেখানকার বেশীর ভাগ স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরাজী প্রাথমিক স্তর থেকেই পড়ানো হয়, ডাচ প্রায় কোন স্কুলেই পড়ানো হয় না।

দেশনেতাদের বুঝতে হবে, মানুষকে ‘উচিৎ’ বলে কিছদিন আটকে রাখা গেলেও তারা বাস্তবের সুখ আর স্বস্তির খোঁজে ফিরবেই। তারা জানে,

“যত পারো থাকো পাখী আকাশ উপরে

ধরায় নামিতে হবে আহারের তরে।।“

এই লেখকের ধারণা বাংলা মাধ্যম স্কুলে ইংরাজীকে একটি বিষয় হিসেবে পড়িয়ে ঐ ভাষায় কথা বলা শিখিয়ে দিলে লোকে আর বাংলা স্কুল, বাংলা ভাষা ত্যাগ করবে না। বাংলাদেশ তাই করেছে। ১৯৯২ সালে তাঁরা ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরাজি চালু করে খুশি হন নি, ১৯৯৬ সালে শুকনো ব্যাকরণভিত্তিক পাঠ্যক্রম বদলে তাঁরা যোগাযোগভিত্তিক (communication based, শুধু লেখা নয়, কথা বলায় গুরুত্ব) করতে প্রয়াসী হ’ন।

বাংলা ভাষা শেখার লাভের দিক শুধু সাহিত্য পাঠেই ফুরিয়ে যায় না, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ২৭ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে সিঙ্গাপুর আর পশ্চিম ইউরোপের এক বিশাল অংশে বাংলা জানা এক আলাদা সুবিধে দেয়। ‘বাঙালি কিন্তু বাংলা জানি না’- খুব সুবিধের একটি অবস্থান থাকছে না আর। প্রবাসী বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর জন্য Duolingo-র মত অ্যাপ পাওয়া যাবে নিশ্চয়। নিজের ফরাসী আর জার্মান শেখার চেষ্টায় দেখছি Duolingo নেশা ধরিয়ে দেয়।

আমাদের কলেজের সহপাঠিনীদের অনেকেই ‘রান্না জানি না’ বলতে যে রকম গর্ব অনুভব করতো, এখনকার আধুনিকা আর তাদের পুরুষবন্ধুরা সে কাজটি ‘জানি’ বলতে প্রায় এক-ই রকম গর্ব বোধ করে। বাংলা ভাষা কি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে?

তবু যে ভরে না চিত্ত- শুধু একটি ভাষার কথা বলে কি পৃথিবীর গল্প ফুরোয়? বাংলার কথা বুঝলাম, কিন্তু, ভারতে তো বাইশটি সরকারী ভাষা। ২০১৮ সালে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতে ব্যবহৃত ১৯৫০০ মাতৃভাষার মধ্যে ১২১টিতে ১০০০০-এর বেশী মানুষ কথা বলেন। অন্য দেশে  আরও বহু মাতৃভাষা আছে, তাদের কি হবে? কঠিন প্রশ্ন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের উদ্যোগে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার সময় কোফি আন্নন বহু মাতৃভাষা লুপ্ত হবার কারণে চিন্তা ব্যক্ত করেন। ভাবলে দেখা যায়, আমাদের চোখের সামনে কিন্তু হয়তো চেতনার অগোচরে ভাষা লুপ্ত হচ্ছে। মঙ্গলকাব্যের  বাংলা আমরা বুঝি না, আর আধুনিক ব্রিটিশ মানুষ শেক্সপিয়রের ভাষা বোঝে না। আগে শান্তিপুর, মুর্শিদাবাদ বা মালদা’র ভাষা চট্টগ্রামের ভাষার মত আলাদা করে চেনা যেত, এখন তারা প্রায় এক জামা পরে নিয়েছে।  ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চমস্কি এজন্যই বলেন, ‘ভাষা বিবর্তিত হয় না, বদলে যায়’ (Languages don’t evolve, they get changed)। মানুষ, মানুষের ভাষা কালের গতিপথে বদলে যায়। আমরা তা মেনে নিই যতক্ষণ না কেউ জোর করে পরিবর্তন চাপিয়ে দিতে চায়। এই কথাটি শাসককুল বুঝলে হয়তো পাকিস্তান ভাগ হ’ত না, কিন্তু নিয়তি কে-ই বা এড়াতে পারে। আজ এটুকুই…

 

 

 

About author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.