শেষবেলা
……..ভোরের একটা হালকা ঝিরঝিরে হাওয়ার ঝলক গাল ছুঁয়ে গেলো দেবযানীর। ভাস্কর জানলাটা খুলে দিয়েছেন। শরৎকালের আকাশটা দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। সাদা তুলোর তৈরি মেঘ গুলো কেমন করে উড়ে উড়ে যায়! কিন্তু তার জন্য তো ঘাড়টা ওদিকে ঘোরাতে হবে। একটু গলায় শব্দ করলো সে। ভাস্কর তখন অন্য দরজা জানালা তালা চাবি খুলে সকালের জন্য তৈরি করছেন নিজেকে। আজ আবার শান্তনা আসবে না। ওর কার যেন খুব অসুখ। তাই গ্রামের বাড়ি যাবে দুদিনের জন্য। দেবযানী এবার একটু জোরে শব্দ করলেন। ভাস্কর একটা গুনগুন সুর ভাঁজছিলেন। কানে আওয়াজ যেতে বেডরুমে প্রবেশ করে গলায় বেশ একটা ফূর্তি ভাব এনে বলল,
……” কি হুকুম মহারাণীর?”
দেবযানী ঘাড়টা নাড়িয়ে ইশারা করলেন ভাস্কর আস্তে আস্তে দেবযানীকে জানলার দিকে পাশ ফিরিয়ে দিলেন। পর্দাটা ভালো করে সরিয়ে দিতেই অনেকটা আকাশ এখন দেবযানীর চোখে উন্মুক্ত। আজ সেই সাদা মেঘ গুলো নেই। বদলে, চলে যাওয়া বর্ষার রেখে যাওয়া দু এক টুকরো কালো মেঘ। তারাও কোথায় জানি হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো! জানলার পাশে গেটের কাছটায় যে পিচ রঙা অ্যালামান্ডাটা খুব শখ করে লাগিয়েছিল দেবযানী নিজের হাতে, তাতে এখন ঝাঁপিয়ে ফুল। ঝিরঝিরে হাওয়ায় তিরতির করে দুলতে দুলতে তারা বিছানায় শুয়ে থাকা দেবযানীকে দেখতে থাকে রোজ।
ভাস্কর দুধ আর কাগজটা নিয়ে জায়গায় রাখেন। কাগজ খুললে আজকাল শুধু খারাপ খবর। তাই সকাল সকাল আর মেজাজ বিগড়ান না কাগজ পড়ে। ওটা দুপুরের জন্য তোলা থাকে। আজ অনেক কাজ। বেডরুম থেকে শব্দ আসে। ভাস্কর গিয়ে হাগিজটা পাল্টে দেন। আজ শান্তনা না থাকায় তাকেই তো সব করতে হবে। মুখ চোখ পরিস্কার করিয়ে, গরম জলে স্পঞ্জ করিয়ে, একটা নতুন ম্যাক্সি পড়ানো হয়ে গেলে, ভাস্কর খুব সাবধানে দেবযানীকে আধ শোয়া করে বসিয়ে দিলেন। কোমরে আজকাল লাগে বেশ, দেখতে দেখতে তাঁরও তো বয়স কিছু কম হলো না। চা করে এনে দুজনে সংসারের টুকিটাকি দরকারি কথাবার্তা সেরে নিতে থাকেন
….”বুঝলে, এবার রিনিরা আসার আগেই ছাদের রিপিয়ারিংটা করিয়ে নিতে হবে। কাল আবার মাইক্রোওয়েভটা গন্ডগোল করছিল খাবার গরম করার সময়, কে জানে আজ চালাতে গিয়ে হয়তো দেখবো তিনি দেহ রেখেছেন! গ্যাসে খাবার গরম করা বড় ঝক্কির।…..শান্তনা তো দেখলাম প্রায় চারদিনের মত রান্না করে রেখে গেছে। এতোদিন না আসলে কি করে হবে কে জানে! তোমার ওষুধ টাও তো সেদিন পাওয়া গেলো না। আজ যেতে বলেছে দোকানে। আমি যাবো আর আসবো বুঝলে? কাল অমর এসে ইলেকট্রিক বিল আর টাকাটা নিয়ে গেলো। তোমায় ছেড়ে এতক্ষণ সময় বাইরে থাকবো কি করে! ছেলেটা বেশ ভালো বুঝলে। সব সময় বলে, কাকু হেল্প চাইলে বলবেন।”
চা বিস্কুট খাওয়া হয়ে গেলে এবার দেবযানীর ব্যায়ামের সময়। হাত পা ঘাড় নাড়ানোর এই সামান্য কটা ব্যায়াম করাতে বেশ বেগ পেতে হয় ভাস্করের। আগে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট আসতো। কিন্তু এতো খরচই বা কতদিন চালানো যায়! তাই ভাস্কর শিখেই নিয়েছেন কায়দাটা।
…..” হাত তোলো, ওয়ান…. টু…. থ্রিই…. ফোর…. ফাইভ….এই তো , গুড গার্ল। বাহ্! বেশ হচ্ছে। এইভাবে করতে থাকলে তুমি তো খুব শিগগিরই দৌড়োবে দেবী! আমারই কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে তোমার ব্যায়াম দেখে!….ভেরি গুড গার্ল।”
পুরো ব্যায়ামটাই ভাস্কর ধরে ধরে করিয়ে দেন। দেহটাকে এক চুলও নাড়াতে পারে না দেবযানী। তাও এই সব বলে সাহস যোগান ভাস্কর। কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিজেই হাঁপিয়ে পড়েন। শান্তনা মুড়ি গুঁড়ো করে রেখে গেছে। দুধ দিয়ে পাতলা করে মেখে ওর মধ্যে একটা কলা চটকে নিলেন ভাস্কর। তারপর চামচে করে খাইয়ে মুখটা মুছিয়ে আবার শুয়ে দিলেন দেবযানীকে। এই সব করতে করতেই বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে দেখে কোনোরকমে নিজে একটু খেয়ে দরজায় তালা দিয়ে ওষুধটা আনতে গেলেন তিনি।
দেবযানীর সামনে তখন বেডরুমের দেওয়াল। তার বানানো একটা সূচী শিল্প বেশ সুন্দর ফ্রেম করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ভাস্কর। বউ এর হাতের কাজ নিয়ে বেশ গর্বিত স্বামী। আগে যখন জীবনটা আর পাঁচ জনের মতোই সহজ সরল ছিলো তখন মাঝে মাঝেই বন্ধু আর আত্মীয়রা নিমন্ত্রিত থাকতো এই বাড়িতে। দেবযানীর হাতের রান্না আর কারুকাজ সবাইকে দেখিয়ে তাক করে দিতেন ভাস্কর। দিনের শেষে সবাই চলে গেলে বেশ একটা আত্মতৃপ্তি উপভোগ করতেন। খুব যে সুন্দরী দেবযানী তা নন । কিন্তু স্বভাবে চরিত্রে ঘরকন্নায় তিনি অনায়াসে সবার মন জয় করার ক্ষমতা রাখতেন। দেওয়ালে একটা ছবিও ঝুলছে দুজনের। বিয়ের পর স্টুডিওতে গিয়ে বেশ সাইড করে বসে পোজ দিয়ে ছবিটা তুলিয়েছিলেন তারা। সেই থেকেই ঝুলছে ওখানে। দেওয়ালের রঙ পাল্টে পাল্টে গেছে মাঝে মাঝে শুধু এই যা!
দেবযানীর জল তেষ্টা পায়। এখনও দরজা খোলার শব্দ পায়নি সে। ভাস্কর এতো দেরি করছে কেন? আজকাল এইরকম একা হয়ে গেলে ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে দেবযানী। ভয়ে পেয়ে যান ভীষণভাবে। প্রেশার বেড়ে যায়। তাই তাকে কখনও একা রাখা হয় না। কিন্তু আজ উপায় ছিলো না ভাস্করের। ওষুধটা না পেলেই নয়।
দুপুরে ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে দেখেন যথারীতি মাইক্রোওয়েভ টা চলছে না।
…” ধুস্! এখনই খারাপ হতে হলো!”
বিরক্তি লাগে গ্যাস জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে তাঁর। অফিসের দিন গুলোতে তো দেবযানী এক গ্লাস জল ও নিয়ে খেতে দিতো না। সব কিছু হাতে হাতে পেয়ে বেশ অভ্যাস খারাপই হয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে আয়েস করে বসে সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো রোমন্থন করতে করতে দুজনের চা খাওয়ার সময়টা বড় মিস করেন ভাস্কর। শান্তনার বানিয়ে যাওয়া চিকেন স্ট্যু দিয়ে নরম করে ভাত মেখে খাইয়ে দেন দেবযানীকে। আজকাল আর খেতেই চায় না সে। খালি মুখটা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। পারে না। ঠোঁটের পাশ থেকে পরে যেতে থাকা খাবারটা চামচ দিয়ে তুলে নিতে নিতে কোনো কোনো সময় অধৈর্য হয়ে পড়েন ভাস্কর। মুখে হাসি টেনে সমানে বলতে থাকেন…..
” এই তো আর একটুখানি আছে। খেয়ে নাও তো আমার গুড গার্ল এর মতো!”
খেয়ে উঠে দেবযানীর সব কিছু গুছিয়ে কাগজ খুলে বসেন বারান্দায় গিয়ে। কাগজ এর এক পাতা জোড়া বিদেশ ভ্রমণের বিজ্ঞাপন। ইউরোপের হাতছানি। ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কত কি ঘুরবেন ভেবেছিলেন। যখনই বেড়ানোর কথা তুলেছেন দেবযানী অমনি বলেছেন …” দাঁড়াও তো ! বাড়িটা আগে কমপ্লিট হোক”…..অথবা…. ” মেয়ের বিয়ে টা আগে দিই ঠিকঠাক করে! ”
তাও প্রতি বছর ফ্যামিলি নিয়ে দেশের নানান জায়গায় ঘুরতে যাওয়া বাঁধাধরা ছিলো। রবিবার গুলো কখনও নিজেরা যেতেন কারো বাড়ি অথবা লোকজন বাড়িতে আসলে বেশ হইচই করেই কাটতো দিনটা। গানে, গল্পে, বেড়াতে যাবার প্রোগ্রাম করে বেশ হইহই করেই কাটছিলো জীবন।…..একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাস্কর গিয়ে দেবযানীর পাশে শুয়ে পড়লেন। আজকাল দেবযানী যেন একটু বেশিই ঘুমায়। জেগে থাকলে দুটো কথা বলা যেতো। এতো নিস্তব্ধতা চারিদিকে! ভাস্কর উঠে পরে বাথরুমে যান। ….হঠাৎ আচমকা পা টা স্লিপ করে……কোমর দিয়ে সজোরে পড়েন একেবারে বাথরুমের মেঝেতে। কদিন ধরেই কোমরটা ব্যথা ব্যথা ছিলো তাঁর। উঠতে গিয়েও উঠতে পারলেন না। হঠাৎ বুকটা ধকধক করতে লাগলো ভাস্করের। যেভাবে পড়েছেন কোমরটা ভাঙলে দরজা খোলার লোকও নেই বাড়িতে। ওভাবেই পড়ে থাকেন কিছুক্ষণ। নড়তে না পারা যে কি ভীষণ মানসিক কষ্টের সেটা এই কয়েক মূহুর্তেই অনুভব করেন। আগে ভাস্কর কত ফিট ছিলেন….কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রিপোর্ট জমা দিতে হতো। কতবার ভেবেছেন সাথে দেবযানীর চেক আপটাও করিয়ে নেবেন। কিন্তু ছটফটে, প্রাণবন্ত, বাইরে থেকে ফিট দেবযানী চেক আপ করাতেই চায়নি। ভাস্করও জোর করেনি তখন। সেইদিন গুলোতে যদি একটু জোর করে দেবযানীর চেক আপ গুলোও করিয়ে নিতেন তবে আজ এইদিনটা আসতো না! একটা সেরিব্রাল অ্যাটাক পুরো জীবনটাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে দিলো তাঁদের।……
ধড়াম করে পড়ার আওয়াজটা দেবযানীও শুনেছেন। ভিতরের দরজার দিকেই পাশ ফিরিয়ে শুয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ভাস্কর। দেবযানী শব্দ করেন। ভাস্কর চেঁচিয়ে বলেন….
” দাঁড়াও। চেঁচিও না। উঠতে পারছিনা। একটু সময় দাও।”…..সময় চলে যায়। কোমরটা ভেঙেছে মনে হচ্ছে! দেবযানী শব্দ করতে থাকেন। জোরে আরও জোরে……তার গোঙানির আওয়াজ কানে যায় পাশের বাড়ির গগনবাবুর….অমরের বাবা তিনি। ছেলেকে ডেকে বলেন…
” দেখ তো! ওবাড়ির গিন্নি এতো চেঁচাচ্ছে অথচ কেউ সাড়া করছে না! কি হল ব্যাপারটা! ”
অমর পাঁচিল টপকে জানলা দিয়ে এসে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। ডাকাডাকি করে বুঝতে পারে সব। ছাদে উঠে দরজা ভেঙে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে তুলে আনে ভাস্কর কাকুকে।
দেবযানীকে মনে মনে ধন্যবাদ দেন ভাস্কর । সারাজীবন সে তাঁর সুবিধা অসুবিধা দেখে এসেছে, যত্ন করেছে যতটা পেরেছে….আজও নিজের সামর্থ অনুযায়ী তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো দেবযানী। তার এই সাড়া দেওয়া দেখে একটু যেন আশাবাদীও হলেন ভাস্কর। একদিন হয়তো আবার দেবযানী আগের মতো ঘরকন্নায় ব্যস্ত থাকবে আর দুজনে বেড়াতে যাবেন ইউরোপের সেই ছবির মত শহর গুলোতে…..ভাস্কর যখন এই সব ভাবছিলেন ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। পাশের বাড়ির কমলা গিন্নি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন দেবযানীর ব্যাপারে …..অমর আর গগনবাবু চললেন হাসপাতালে তাঁর সাথে।…..
About The Author
লেখিকা পরিচিতি : উজ্জয়িনী বন্দোপাধ্যায়…..একটি গভর্নমেন্ট স্পনসরড হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা। ভালোবাসার বিষয়…. বেড়ানো, ছবি তোলা, ছবি আঁকা, আড্ডা, গাছপালা, বই, রান্না ইত্যাদি ইত্যাদি অন্তহীন সব শখ আল্হাদ।