অরিজিৎ কথঞ্চিৎ/ অরিজিতের কলম

ওই যে ওদের নানান নামের দিনগুলি

অলীক (কু)নাট্য রঙ্গ:  কয়েক বছর আগে যখন বিষয়টা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছিল, বন্ধু মালয়ালি ক্রীশ্চান ববি থাট্টাচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোরা ভ্যালেন্টাইন ডে কিভাবে পালন করিস?’ ‘আরে ইদানীং হইচই হওয়ার আগে দিনটার অস্তিত্ব সম্পর্কেই জানতাম না।‘- ববি’র উত্তর। আমাদের ছোটবেলায় এত দিন ছিল না। বছরে মাত্র স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, শিশু দিবস আর শিক্ষক দিবস মনে পড়ে।  এখন প্রায় প্রতি মাসে একটা- দুটো দিন উজিয়ে আসে। বাবাদের দিন, মায়েদের দিন, বয়স্কদের দিন, ভাষা-র দিন,পরিবেশের দিন, পরিচ্ছন্নতার দিন, এমন কি বিশ্ব নারকোল দিবস। বিশ্ব যুক্তি দিবস (১৪ই জানুয়ারি), ইহুদি সংহার দিবস (২৭শে জানুয়ারি), একসাথে শান্তিতে বেঁচে থাকা দিবস (১৬ই মে), দারিদ্র্য নিরাকরণ  দিবস (১৭ই অক্টোবর) ইত্যাদিও আছে। দিবসের ক্রমবর্ধমান দাবী সামলাতে এক দিনে এক জোড়া বা তার চেয়ে বেশী দিন পালন করতে হচ্ছে।

এসব দিবসের মেলা ডিজিটাল মিডিয়া-র হাত ধরে আমাদের কাছে আসছে। আমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। তাতে কোন ক্ষতি হচ্ছে কি না ভাবার সময় করি একটু। আমাদের পৌষের পিঠে ভুলে যাচ্ছি। একসাথে শান্তির দিন কাটাতে গিয়ে দেখতে ভুলে যাচ্ছি, চারপাশে ঘন হয়ে ওঠা অশান্তির বাষ্প কেমন ঘিরে ধরছে, গিলে ফেলছে আমাদের।

ভুলে গিয়ে ঈদ-বিজয়ার প্রাণের কোলাকুলি,

বন্ধুদিনে হোয়াটসআ্যপে হাওয়ায় গলাগলি।

 

প্রাচ্যের প্রেক্ষিতে দুরকম সমস্যা দেখতে পাচ্ছি- ভুলে যাওয়া আর অন্তঃসারশূন্যতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা। বাবা দিবস, মা দিবস, ভাই-বোন দিবসে শুভেচ্ছা পাঠাতে পাঠাতে আপাত বিশ্বে (ভার্চুয়াল) বিচরণশীল তৃপ্ত ও ব্যস্ত মানুষ মা’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার সময় পাচ্ছে না। হলোকস্ট মনে পড়লেও এক-ই সময় ঘটে যাওয়া মানুষের সৃষ্টি বাংলার দুর্ভিক্ষ মনে পড়ে না।

পৃথিবীময় মল (Mall)-সংস্কৃতি ছেয়ে যাওয়ায় বেড়ানোর আনন্দ- যা ছোট ছোট স্থানীয় দোকান-বাজারে ঘুরে পাওয়া যেত, তা অনেক কমে গিয়েছে। আমরা সবাই যদি এক-ই রকম ব্যবহার করি, তাহ’লে নতুন মানুষ দেখার আনন্দ- ও বাঁচবে কি? অন্যের শ্ত্রুতা মানুষের আসল সংকট নয়, আসল সংকট হ’ল আত্মবিস্মরণ-বাইরের মুগ্ধতায় নিজের হৃদয়বৈভবকে অবহেলা। ভাল জিনিষ অবশ্যই নেওয়া ভাল, কিন্তু তার সাথে ফাউ হিসেবে ওদের পক্ষে খারাপ নয় কিন্তু আমাদের পক্ষে অপ্রয়োজন, তেমন কিছু নির্বিচারে গ্রহণ করা কি ঠিক?

দূরের দেশের প্রথা এ সব- ‘দিবস-পালন’,

তাদের পক্ষে ভাল, ফিকে যাদের আকর্ষণ।

 

রিও-ডি-জেনিরোতে (অফিসের কাজে গিয়ে) মাঝরাতে প্লেন থেকে নেমে আমরা প্রথমে খাওয়ার জল কিনতাম, কারণ ওখানে হোটেলের ঘরে খাবার জল থাকত না। জাকার্তায় হোটেলের লবি-তে একটি ফুলদানি-র মত পাত্রে যার ইচ্ছে নেওয়ার জন্য আপেল রাখা থাকত। সারাদিনের মিটিং-এও অতিথি সৎকারে ঐ রকম তফাৎ দেখেছি। অস্ট্রেলিয়ায় কারো জন্মদিনের নেমন্তন্নে গিয়ে খাবার কিনে খেতে হয়। জার্মানি আর ফরাসী শিক্ষার আসরে চলে এ রকম কথোপকথন-

– তুমি তোমার বাবা-মা’র সাথে দেখা কর কি

– হ্যাঁ, রবিবারে একটা রেস্টুরেন্ট-এ দেখা করতে যাই।

 

স্বদেশের রত্ন ফেলি:  এ’সব দেখে আর পড়ে বিন্দু’তে সিন্ধুদর্শনের অভিজ্ঞতা হয় যেন। ভয় হয়, আমরা হয়তো দিবস-নামক কয়েকটি বিন্দু’র জন্য এক পরিমণ্ডলকে ত্যাগ করতে চলেছি। আমাদের বাবা-মা, বন্ধু-প্রতিবেশীদের জন্য ভাবনা ‘ফুলের মতন, হাসি’র মতন, কুসুমগন্ধ-রাশির মতন, অদৃশ্য একটি ভরসা’র আশ্রয় হয়ে সবসময় আমাদের ঘিরে থাকে। আমাদের সাথে আত্মীয়-বন্ধুর আলাপচারী সপ্তাহান্তে নয়, প্রতিদিন, সময় বেঁধে নয়, সময়বিহীন।

আমাদের বন্ধুপ্রীতি দিবস দেখে নয়,

সান্নিধ্য জড়িয়ে থাকে সারা বছরময়।

সবাই মিলে এই দেশেতে ঘেঁষাঘেঁষি থাকি,

অসময়েও প্রশ্ন করি, ‘ভাল আছ নাকি?’

 

ব্যাপারটা কি এই রকম? ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা যে অনুচ্চারিত একাকীত্বের জন্ম দেয়, তার থেকে বেরোনোর চেষ্টায় যখন পশ্চিমী দুনিয়া সচেতনভাবে অনেকানেক বিন্দু জুড়ে (connecting the dots) একটি আরামের চাদর তৈরি করতে চাইছে তখন আমরা পৈত্রিক চাদরটি ডাস্টবিনে ফেলে বিন্দু’র মোহে মগ্ন হতে চাইছি। আশা এই যে, ‘এক্কেবারে মানাইছে না রে’ অনুভূতিও কাঁধ থেকে নামতে চাইছে না।

যার ভান্ডার পূর্ণ সদাই, রয় না কিছুই বাকি,

তার কি সাজে একটি দিনের ঢাক পেটানোর ফাঁকি?

 

বুঝে নেওয়া ভাল, পশ্চিমী দুনিয়া এত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও টিঁকে আছে তার কারণ তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি- যাদের মধ্যে প্রধান আইনব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণাকেন্দ্র। আমরা নিজেদের নিরুচ্চার সহজ সৌহার্দ্য ধরে রেখে যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিশ্বমানের করে তুলতে পারি, তা’হলে এখানে….এখানেই- আমাদের দেশের মাটিতে যা ঘটে যেতে পারে যা দেখে ওমর খৈয়াম বলে উঠবেন- “স্বর্গভূমি এই তো সেরা, কাজ কি ছেঁড়া গল্পকথায়?”

http://unescocenterforpeacenys.org/international-days-celebration/

 

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.