উজবূক উবাচ
Kuntala Bhattacharya
লকডাউনের চক্করে ওয়েব সিরিজগুলো বেশ তরতরিয়ে বেড়েছে। আমরা,যাদের পরিযায়ী পথ পেরোতে হয় নি,কাজ চলে যায় নি, মাইনে কাটে নি,ইয়ুটিউব দেখে রান্না করে, হঠাৎ পাওয়া অবসরে যারা তাক লাগিয়ে দিয়েছি, এরকম আমরা প্রতিরাতে একঘেয়ে অবসর কাটাতে ওয়েব সিরিজের টানটান বয়নে নিজেদের বুনে নিয়েছি।
পরিস্থিতি সামলানোর পর সেই বুনন ছিঁড়তে আরম্ভ করেছে। আমার যাপনে ওয়েবসিরিজ বা সিনেমা— কোনোটার মতোই জোরালো প্লট নেই। প্লট বলতেই প্লেটোর কথা ঢুকে এল। ধ্বনিগত সাদৃশ্য। মনে রাখার কলাকৌশলে অনুষঙ্গ নীতি আবশ্যক। আমরা একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে নিয়েই মনে রাখি। সহজ উদাহরণ, রবীন্দ্রনাথ-গীতাঞ্জলী। বাজার চলতি যে কোনো মনোবিজ্ঞান বইতে এই উদাহরণটি আছে।
Allegory of the Cave নামে বিখ্যাত একটি রূপক আছে প্লেটোর। ভূগর্ভস্থ গুহায় কয়েক কয়েদি রাখা। তারা আজন্ম বন্দী। হাতে পায়ে শেকল। ঘাড় ঘোরাতে পারে না,চোখ সরাতে পারে না। সামনে দেখে আখাম্বা এক দেওয়াল। গুহামুখের আলো আর গুহার মধ্যে থাকা আগুনের রশ্মিতে ঐ দেওয়ালে ছায়া পড়ে। দেওয়ালমুখী বন্দী ঐ ছায়াগুলোকেই জানে শুধু। হয়ত মানুষের ছায়া, বন্যপশুর ছায়া, বা চলমান যা কিছু সরে সরে গিয়ে ছাপ ফেলে, সেগুলোর ছায়াই ওরা চেনে। চট করে চিনে নেওয়ার জন্য ছায়াছবির ক্লাসিফিকেশন করে নাম দেয়। ঠিক যেন, শৃঙ্খলিত শাপগ্রস্ত শিককাবাব। আচমকা, কয়েদিদের মধ্যে কেউ যদি পালায় বা তাকে বের করে আনা হয়, স্বাভাবিক সে প্রথমে বাইরের দুনিয়ায় চোখ মেলতেই পারবে না। অনভ্যস্ত চোখ বুজে ফেলবে। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে গেলে সে চোখ মেলে দেখবে, বাহ্যজগতের রূপসুষমা। কয়েদখানায় এতোদিন সে যা দেখেছিল, সেসবের আসল খোলতাই রূপ চোখ ভ’রে দেখবে সে। জ্ঞানের শলাকায় চোখে কাজল পড়তে গিয়ে মনে পড়বে, ফেলে আসা তার সহবন্দীদের কথা। তৎপর হয়ে সে ফিরবে আটকে থাকা বন্দীবন্ধুদের মুক্তি দিতে। হাঃ জন্ম-ইস্তক বদ্ধবন্দীদৃষ্টিতে কী অপার অসীমের ছোঁয়া পাওয়ার অধিকার থাকে? চক্ষুষ্মান পুরনো বন্ধুটিকে তারা বিশ্বাস করবে না, উপহাস করবে, ধমকাবে এবং শেষ মেষ মেরেই ফেলবে।
প্লেটো হয়ত সক্রেটিসের রূপকল্পনায় তৈরি করেছেন, মুক্ত চক্ষুষ্মান মানুষটিকে। আজীবন পরাধীন থেকেও কেউ কেউ ছিটকে বেরিয়ে যায়। সে তখন অপরিসীম অভিজ্ঞতার কুলজিনামা জানতে জানতে এক্কেবারে শুরুতে চলে যায়। বিস্ময়ে পাগলপারা, জনে জনে ডেকে ডেকে বলে : ও হে অমৃতের সন্তানেরা, বিপুল তরঙ্গে গা ভাসিয়ে সেই কোন সেকাল থেকে তরী বাইতে বাইতে আসছো। এবার গন্তব্য খুঁজে নাও।
সক্রেটিসের নিশিডাকে এথেনীয়ানরা একে একে বাইরে চলে গেলে তো রাজকার্য লাটে উঠবে। সক্রেটিস-সরাও হুঙ্কারে প্রাণদণ্ড ধার্য হল।
গল্পটা বলার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা হাজার হাজার বছর পরেও এই অ্যালিগোরিটা ব্যবহার করছি। স্মার্টফোন, অ্যামাজন, অনলাইন পেমেন্টকেই ভাবছি আধুনিক। সভ্য-বিজ্ঞাননির্ভর-আধুনিক। না-জানার একচ্ছত্র অধিপতি আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে এখনও। আমাদের থেকে সেই নীলকন্ঠ সক্রেটিস কবে আসবে!!!!!!
লেখিকা পরিচিতি:
কুন্তলা ভট্টাচার্য। মেজাজে বাঙাল,চলনে ঘটি। পুরনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শখ। গান অন্ত প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ,স্বামী বিবেকানন্দের সময়কার কোলকাতা দেখার ভীষণ ইচ্ছে। উত্তর কোলকাতার বিশেষ ভক্ত। বর্তমানে শিশুকন্যার মা হিসেবে নিজেকেও তার সমবয়সী ভাবতে সাহস রাখে। পেশা: পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী স্কুলে দর্শনের শিক্ষিকা।