অণু সন্ধান ২
নিজেকে হারায়ে খুঁজি
-বাসুদেব গুপ্ত
বিকি বোসের হাতে একটা মশা কামড়াএলো ঠিক চুল আঁচড়ে দাড়ির বনশোভায় ট্রিম করছেন তখন। উফস বলে হাতটা ছুঁড়লেন আর আয়নাটা গিয়ে পড়ল টেবিলের বাউন্ডারী পেরিয়ে ম্যাকসিমাম ধোনীর ছক্কার মত জানলার বাইরে। জানলায় দুটো পায়রা কিছু দার্শনিক ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলো। উড়ে আসা বস্তুটির থেকে বাঁচতে তারা চটপট আম্পায়ারের মত প্রাণ বাঁচাতে সাইড হল তারপর আবার ষঢযন্ত্রে মনঃসংযোগ করল। নীচে থেকে ঝনাৎ ঝনচনঝুম একটা শব্দ এলো। আয়নার আর্তনাদ। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে বিকি বোস আয়না ছাড়াই দাড়ির মার্জনার করে এক গ্লাস লেবুর জল খেলেন। ডিটক্স। তারপর খেয়াল হল বাড়ীর শেষ আয়নাটাও আজ ভেঙে গেল।
যাক এই শ্রী মুখ আর দেখতে হবে না। বাঁচা গেল।
বিকি বোসের মুখটা খুব খারাপ নয়। উন্নত নাসা চাপা একটু বাঁকা ঠোঁট। তাতে চাপা হাসি ও চাপা তাচ্ছিল্য মিলে মিশে থাকে। মাথায় কুন্চিত কেশরাশি একসময় ছিলো এখনও তার রেশ জেগে আছে। ক্লাইমোট চেন্জ থাবা বসিয়েছে। নবউদ্ভিদায়ন করেও লাভ হয় নি। বাঁ কানের পাশে একটা বড়সড় কালো আঁচিল আয়নায় মুখ দেখলেই চোখে পড়ত। পাবলিকও ঐ দিয়েই চিনত। ব্যাংকের জাঁদরেল ম্যানেজার। উনি বললেই লোন পাস নৈলে দিয়ে যাও ডকুমেন্ট বছরের পর বছর। শুনেছেন কতবার ফিসফিস করে এনকোয়ারীর বেজার মুখ ধরণী পান দেখিয়ে দিচ্ছেন -ঐ যে কালো আঁচিল বসে আছেন উনিই বিকাশ বসু, ম্যানেজার। আঁচিলটা আর দেখা যাবে না।
বিকি বোস এখন নিজেকে একটু আড়ালে নিরালায় রাখতেই পছন্দ করেন। অনেক হয়েছে। তিনটে বাড়ীর দুটো ছেলে মেয়ে দখল করে আর যোগাযোগ রাখে না। বলে তোমার বদনাম আমাদের ছোট বাচ্চাদের গায়ে লাগে ওরা চায় না। মাই রি। এই বাতিল হয়ে যাওয়া swearword টা বিকি বোসের খুব পছন্দ।
তৃতীয় বাড়িতে বদ্ধ পান্ডার মত বিকি বোস বিচরণ করেন। একলাই। মোবাইল ফোনের প্রবেশ নিষেধ। মৃদুলার কাপড় গয়না র আলমারিগুলো হৈ হৈ করে নিয়ে গেছে ছেলে মেয়ে।
শেষ আয়নাটিও আজ গোল। শান্তি। আঁচিলটা দেখতে ভালো লাগত্যনা। যতদিন কাজ করেছেন, একটু একটু করে বড় হয়েছে। যেন সবসময় ভয় দেখানো। যত পাপ করবে ততই আমি বড় হবো। আর সবাই আণ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দেবে, ঐ যে, কালো আঁচিল ওলা লোকটি। হ
যেটা বলত না পরিস্কার করে, উনিই টাকা পয়সার কথা বলবেন। উনি বললেই আপনার লোন পাস। ১ কোটি হিমঘর দুকোটি ধানকল, পাঁচকোটি নতুন আইটি কলেজ, সব হবে। হত। বছরে দুবার বিদেশ সপরিবার, হীরের গয়না আলমারি ভর্তি সিন্গল মলট চাইলেই পাওয়া যায়।
আয়না ছাড়াই দিব্যি চলছে। দেখতে দেখতে নিজেকে কেমন দেখতে সেটাই ভুলে গেলেন বিকি। আমরা কে আর সত্যি নিজেকে মনে রাখি বা চিনি। সারা দিন নানা রকম বই পড়া অভ্যেস। তাতে অনেক চরিত্র। কেউ মাতাল ও প্রেমিক। কেউ জাঁদরেল গোঁফ বাগিয়ে বাঘের মত বিচরণ করেছেন। কেউ টাকমাথা। তাই টুপি পরে নেতা হয়ে দিব্যি আছেন। কেউ যক্ষারোগী। চোখ গুলো তাড়া খাওয়া বাঘের মত। বিপ্লবী।
খেয়াল করেন আঁচিল নেই কারো। হাত দিয়ে ছুঁতোয় দেখেন। না আঁচিলটা ঠিক আছে। যাক আমি ঠিক আছি। আঁচিলটাও।
এমনি করে দিন যাচ্ছিলো হঠাৎ বাধল গোলমাল। একটা পুরনো কেসে সমন এলো সিবিআই থেকে।
প্রোমোটারের সংগে সেখানকার বাসিন্দাদের গোলমাল। জমি থেকে উচ্ছেদ করে উঠবে দশতলার আলট্রা লাকসুরিয়াস ফ্ল্যাট। নামী প্রতিষ্ঠিত বিল্ডার। কিন্তু জমি দখল করে বসে আছে একদল লোক। তারা সেখানে বাস করছে ২৫/বছর ধরে, তারা ছাড়বেনা বলে আবদার। এক শনিবার দেখে বস্তিতে আগুন ওলাগানো হলো, একজন কোনমতে ৫০ শতাংশ পুঢেও বেঁচে গেল। সবাইকে অফার করা হল পন্চাশ হাজার টাকা। তাতেও আপত্তি। অগত্যা একজন নামী বিল্ডার আর কি করে? পার্টির দরজায় আর্জি। পন্চাশজন লোক দরকার কিন্তু সবাই এখন ত্রাণ বন্টনে ব্যস্ত। অগত্যা দুটো পার্টি থেকে হাফ হাফ লোক নিয়ে কাজ করতে হল। দুই পার্টি সারাক্ষণ এ ওকে চমকায়। কিন্তু কাজের বেলায় পেশাদার। একসাথে কাজ করে। একজন তো বললই স্যার দেখুন না আইপিএলের খেলা। কে কোন দলে কবে আছে বোঝা যায়। পফেসানাল একেই বলে।
তো তারা মালমশসা কুটিরশিল্প, মুল্গেরশিল্প, কারখানা থেকে চোরাই শিল্প নিয়ে রবিবার একশান করল। আর পাঁচটি বডি লাশ হয়ে হাপিস। করোনার থেকে এটা কোন ব্যাপার নয়। সব লাশ আর বাড়ী পৌঁছয় না।
ঝামেলা বাধল কোথা থেকে এক নেতাটাইপ এসে হাইকোর্টর পি আই এল মেরে দিয়েছে। সেই কেস মহামান্য আদালত তুলে দিয়েছেন সিবিআইএর হাতে। এই প্রোমাটার এত টাকা কোথায় পেল খুঁজতে খুঁজতে খোচররা এসে পড়েছে বন্গলক্ষী ব্যাংকে। আর বিকি বোসের মাথা কান টানতেই হাতের কাছে।
-আপনি?
-বিকি সরি বিকাশ বোস।
-আপনি বন্গলক্ষীর ম্যানেজার ছিলেন?
-হ্যাঁ স্যার ২০১৮ পর্য়ন্ত। বলেই খেয়াল হলো স্যার না বলে বোধহয় মি লর্ড বলা উচিত ছিলো।
-আচ্ছা আপনি সুরানা বিল্ডারেসকে ৫ কোটি টাকা লোন মন্জুর করেছিলেন?
-ঠিক এমাউন্ট মনে নেই। তবে হ্যাঁ কাছাকাছি একটা ফিগার।
-আপনার মনে হয় এই ডিলে কোন বেআইনী কাজ হয়েছিল?
কোর্ট রুমে একদিকে বসে আছেন সর্বহারাদের নেতা সর্বজয় মিত্র আর একদিকে নির্ভয় সুরানা। বিকি দুজনের দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় এক বর্ষণমুখর সন্ধের কথা।
প্লেট ভর্তি টেংরী কাবাব। গ্লাসে ব্লাডি মেরি। সামনের দুটো চেয়ার। একটায় সর্বজয়। আরেকটায় নির্ভয়।
-আপনার মত দক্ষ ব্যাংক ম্যানেজারের জন্যই তো আজ দেশ এত বিকাশের পথে। আপনার নামটাও দেখুন বিকাশ। হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নির্ভয়
-আমরা এত বছর ধরেও দেশের উন্নতি করতে পারলাম না। কত বোস এল গেল। আপনিই সেই বোস যাঁর জন্য দেশ কৃতজ্ঞ থাকবে চিরকাল। জয় দেশের জয়। বলে তিনজনে তুলে নেন গ্লাস।
-এবারে বলুন আপনার কাট কত?
এই প্রশ্নটা এলেই বিকি বোসের আঁচিলটা চুলকে ওঠে। কিন্তু এখন নরম হলে বা ওদের কথায় ভাও খেলে চলবে না।
-আপনি বলুন উত্তর দিন। এই কোর্টরুমে এমন কেউ আছে যার সংগে আপনার কোন ডিল?
বিকাশ বসু আবার বর্তমানে ফিরে আসে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
মনে পড়ে যায় একটা মুখের কথা। উত্তম। কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে গুলি চলেছিল। চোখদুটো তখনও সরল, কোন ঘৃণা নেই, প্রতিশোধ নেই। শুধু দুটি সরল চোখ। দেখতে গিয়েছিলেন খবর পেয়ে।
সেই উত্তম। ওঁর অক্সিজেন যখন ৭৫, নিজের বাড়ীর লোক বলেছিল বাবা বুঝতেই তো পারছেন, আমাদের ছোট ছেলে মেয়ে আছে, যখন হাসপাতালে ফোন করতে কেউ ফোন ধরে নি, তখন উত্তম ওঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে।
সেই উত্তম। সপ্তাহে চার পাতার একটা কাগজ দিয়ে দিত। বলত আমরা লড়ছি স্যার। ওদেখবেন আমরাই জিতব।
আজ সকালে ফোন এসেছিল নির্ভয় আর সর্বজয় একসংগে।
—বুঝে শুনে কথা বলবেন। দেখবেন কিচাইন না হয়।
-কি বলুন সরকারী উকিলের প্রশ্ন। একটু বিরক্ত।
-হ্যাঁ ডিল হয়েছিল
বিকি আন্গুল তোলেন একবার বাঁ দিকে। আর একবার ডান।
কোর্ট থেকে বেরোতে আক্রমণ আসে। মাথা ফাটে। অপারেশান । আঁচিলটাও বাদ চলে যায়।
এক বছরের জেল। জেলে একটা ছোট আয়না দেওয়া হয়।
অনেকদিন পরে নিজের মুখ দেখেন বিকাশ। একজন অপরিচিত তাকিয়ে হাসছে। কিছুতেই মনে করতে পারেন না কোথায় দেখেছেন।
(সমাপ্ত)
About the author :
বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং
অসাধারণ গল্প। এক পাতায় এক জীবন আর এক দেহে বাস করা দু’জন বিপরীত মেরুর মানুষ। তারা উদ্ভাসিত হয় গল্পের সরল গতিপথে। জোর করতে হয় না,, ধাক্কা দিতে হয় না ক্যানভাস ভরে ওঠে হাল্কা আঁচড়ে।
Thanks for your blog, nice to read. Do not stop.