শান্তিনিকেতন না রবীন্দ্রনাথ – পথের বাঁকে হারাই কাকে
কথায় বলে, ‘কানু বিনা গীত নাই’। তাই কবিপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কথা বলা মুশকিল। তাঁকে আমরা হারিয়েছি ঠিক-ই, কিন্তু ‘ঠিক কী ভাবে হারিয়েছি?’- বিশ্বভারতীতে বারবার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার খবর এই প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত করে। যে কোন সঙ্কট বেড়ে ওঠার একটি প্রধান কারণ, ভুল জায়গায় অশ্রুপাত। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যখন আমাদের বিলাপ- তাঁর গান-কবিতার চর্চা কমে যাচ্ছে… পাশের বাড়ির মেধাবী ছেলেটি ‘গোরা’ বা ‘শেষের কবিতা’ পড়ে নি… ইত্যাদিতে আটকে যায় তখন আবার যেন ভুল অশ্রুপাতের আভাস পাই।
তাঁর সাহিত্য, দর্শন এমন কি দেশ ও রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা আজও পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বহুল চর্চিত। রবীন্দ্রনাথের নোবেল মেডেল নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্য ও বক্তৃতাবলী হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যা নিয়ে চর্চা তেমন হয় না তা হল তাঁর অতি যত্নে ও অর্থব্যয়ে গড়ে তোলা শান্তিনিকেতন (বিশ্বভারতী) ও শ্রীনিকেতন, অথচ, এ দুটি সংস্থা ভারতের দিগদর্শক হতে পারত। স্বামীনাথন আঙ্কলেশ্বরিয়া আইয়ার বহুদিন আগে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কোন জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে তার স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলি (Institutes)-র উচ্চস্তর। সংস্থার মধ্যে পড়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণাগার, পুলিশ-প্রশাসন-বিচারালয় এমন কি মিলিটারী পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শুধু গান-গল্প-কবিতা দিয়ে যান নি, তিনি যে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন আমাদের দিয়ে গিয়েছেন তা আমরা ভুলে যাই। আইয়ার-এর লেখার প্রেক্ষিতে এ-দুটি সংস্থার গুরুত্ব কবির লেখার চেয়েও অনেক সময় বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। একটি দুরগামী আশার বাতাস যেন বলে কবি নিজেও যেন তাতে সহমত হতেন। তিনি যা চেয়েছিলেন ভারতের আত্মার, প্রতিভার বিকাশ- তা শান্তিনিকেতন করে দেখিয়েছে, সেখানে পড়েছেন ইন্দিরা গান্ধী, মুজতবা আলি, সত্যজিৎ রায়, প্রমথ বিশী এবং অমর্ত্য সেন-এর মত মানুষ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু কত যে শিল্পী তৈরী করেছেন তা গুণে শেষ করা ভার। কেন যেন মনে হয়, শান্তিনিকেতন না থাকলে মুজতবা আলি ও রামকিঙ্কর বেইজকে আমরা পেতাম না।
যখন আমরা অতি প্রাচীন ঐতিহ্যকে নিয়ে গর্বে ফেঁপে থাকি, তখনও প্রাচীন গুরুকুলের মত প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে আধুনিক শিক্ষণের যে বর্তমান উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে গিয়েছেন, তার দিকে ফিরেও তাকাই না কেন?
‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ স্লোগান শুনেছি, ‘ভারতের প্রাণ গ্রামে বাস করে’ তাও শুনতে আর বলতে থাকি ক্লান্তিহীন। কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ আগে শ্রীনিকেতনে আমেরিকা থেকে লিওনার্ড এলমহার্স্ট-কে এনে পল্লীবাংলার উন্নত চাষ-আবাদের যে চেষ্টা তিনি শুরু করেছিলেন, যে ধারাবাহিকতায় উন্নত চাষ-আবাদের পদ্ধতি শেখার জন্য তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ, জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, আর বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। সে সময় নগেন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন (মূল বাংলা হাতের কাছে নেই), “You have gone abroad to study agriculture with the resources that might have fed our famine-stricken peasants at home. If you can make up for it by ensuring a few more mouthfuls for them on your return my mind will be assuaged. Remember that the landlord’s wealth is actually the peasants’: they are bearing the cost of your education by starving or half-starving themselves. It is your responsibility to repay this debt in full. That is your first task, even before the welfare of your own family.”* রবীন্দ্রসাহিত্যের অনেক আলোচনা হয় কিন্তু প্রায় কোন সভায় এসব হৃদয়স্পর্শী কথা জায়গা পায় না।
বড় সাহিত্যিক তাঁর কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদিন প্রাসঙ্গিক থাকেন, যেমন রবীন্দ্রনাথ আছেন। কিন্তু আপাত নিষ্করুণ হলেও সত্যি কথা হল তারও একটি সীমা থাকে। আজকালকার বাচ্চারা যারা মুক্ত পরিবেশে বড় হচ্ছে তাদের পক্ষে “হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাওগো আমার হাতে”-র রোমাঞ্চ অথবা ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এলো ফাগুন দিনের শেষে…”-র অপরূপ মাধুরী বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু নতুন যুগের কবির ভাষা তাদের মনে ঢেউ তুলবে… তুলবেই। এমন জানতেন বলেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে গুটিকয় ছাত্র নিয়ে শুরু করা একটি স্কুলকে ধাপে ধাপে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিয়েছিলেন যে খানে ভবিষ্যতের লেখক-শিল্পী-বৈজ্ঞানিক তৈরী হতে পারে, যার প্রথম যুগের অর্জনের সামনে তথাকথিত আধুনিক বহু বিশ্ববিদ্যালয় লজ্জায় ম্লান হয়ে দাঁড়ায়।
এখন ভারতে নামের ভারে ন্যুব্জ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’গুলিতে বহির্বিশ্ব তো দূরের কথা, পাশের প্রদেশের ছাত্র-শিক্ষকও বিরল। অথচ, বিদ্যায়তনে বিশ্বের উপস্থিতি কাকে বলে তা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন- তাও সেকালে যখন যাতায়াত মোটেই সহজ ছিল না। নালন্দা, তক্ষশিলার মত না হলেও বিদেশ থেকে বহু জ্ঞানী মানুষ শান্তিনিকেতনে পড়াতে আসতেন। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই, আসত বিদেশী ছাত্রও। কোন নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল না, শুধুমাত্র সেই ঐতিহ্যটিকে এগিয়ে নিয়ে দেশে আরও কিছু শান্তিনিকেতন তৈরি করতে পারলে কী আশ্চর্যের শোভাযাত্রা আমরা দেখতে পারতাম ভেবে অবাক… শোকাচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না আর। আর শ্রীনিকেতন? তাকে অবহেলা না করলে হয়তো সুজলা সুফলা বাংলায় আমূল-এর মত অনেক সমবায় গড়ে উঠে গ্রামীণ ভারতের চেহারায় আর একটু সহজ সুখের আভাস আনতে পারত।
সামনে পড়ে থাকা রত্নরাজিকে অবহেলা করে দূরে অতীতের স্বর্ণভান্ডার খোঁজা আত্মবিস্মরণের আর এক নাম। দুঃখ রবীন্দ্রনাথের জন্য নয় (ক’দিন আগেই শুনলাম হাঙ্গেরিতে ভারত প্রসঙ্গে একটি অতি জনপ্রিয় বই-এর প্রেক্ষাপট শান্তিনিকেতন), কোন মানুষ-ই অমর হতে পারেন না। যদি তেমন করতেই হয় আমাদের শোক… অশ্রুপাত করা উচিৎ অবক্ষয়িত শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন-এর জন্য, যাদের মধ্যে এক ক্ষণজন্মা কবি-দার্শনিক ভারতের জন্য… পৃথিবীর জন্য অমরত্বের বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন।
-অরিজিৎ চৌধুরী
*Cited by Sankha Ghosh in his essay From Art to Life; translation by Sukanta Chaudhuri
About Author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.