কথাগুলি রয়ে যায় বলিতে…… (১/২)
প্রায়ই অনুযোগ করি, ‘আমার কথা ওরা বুঝলো না।‘ বড় অভিমান হয়, কিন্তু নিজেও বুঝি না যে ঐ ছোট্ট বাক্যটির মধ্যে কি গভীর না বলতে পারা’র রহস্য লুকোনো। যেমন ধরুন কেউ যখন বলে, কথা বলতে চায় তখন সে কি কথা-ই বলতে চায়, না মনের ভাবটি জানাতে চায়? একটু অন্যভাবে ভাবুন, যদি আপনার দিল্লি যেতে ইচ্ছে হয়, তখন কি বলবেন, আমি প্লেন বা ট্রেন চড়তে চাই? কথা আসলে প্লেন, ট্রেন বা সাইকেলের মত ভাবনার বাহন। আরও ঠিক করে বলতে গেলে কথাগুলি আমাদের মনের ভাব নয় তাদের ইঙ্গিতমাত্র।
সব কথাই অসম্পূর্ণ- আমাদের মনে ভাবের যে ঢেউ ওঠে তা নানা রূপ- রস- গন্ধে বিমিশ্র ও বহুমাত্রিক। তাকে বক্তা ও শ্রোতা দু’পক্ষের চেনাশোনা কয়েকটা শব্দে বেঁধে ফেলতে গিয়ে যে ব্যাপারটি আমরা অজান্তেই করতে থাকি, তাকে বলে অনুবাদ আর তা করতে গিয়ে ভাবের নোলক আর পালক ঝরে পড়ে, হারিয়ে গিয়ে যে ক্ষতিটা হয়, তার নাম অনুবাদে লয় (lost in translation)। প্রথম ধাপেই এই অবশ্যপ্রাপ্য ধাক্কাটি খেয়ে শব্দ যখন শ্রোতার কানে পোঁছোয়, তখন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোয় শব্দগুলিকে সেঁকে যা বোঝার তা বোঝে। যেমন ধরুন ‘হাই’ মেসেজ পেলে দুনিয়ার লোক এক জিনিস বোঝে, অন্যদিকে পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজ-এ চার বন্ধুর কাছে ঐ মেসেজ সুরাপানের মদির হাতছানি। আবার এই জন্যই অনেক দুঃখে থাকা অভাবী ভদ্র মানুষ ‘ভাল আছি’ বললেও তাঁর প্রিয়জনেরা হেঁসেলে উঁকি দেন আর হাড়কিপ্টে ‘টাকা নেই’, ‘টাকা নেই’ বলে সারা পাড়া ঘুরলেও কেউ কান দিতে চায় না।
একে তো মানুষের ভাবপ্রকাশের পথে প্রকৃতিদত্ত বাধা অনেক, তার ওপর আছে নীতিবোধের বোঝা- মনে যা হচ্ছে তা বলে ফেলা উচিৎ হবে কি না এই ভাবনা। তাতে ব্যাপারটা আরও গুলিয়ে যায়। ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোম চমস্কি বলেন, সাধারণতঃ, বাচ্চাদের ভাষা শেখানোর দরকার হয় না, তারা পরিবেশ থেকেই শিখে যায়। আমরা তাদের ভাষা শেখানোর নামে যা শেখাই তা ঠিক ভাষা নয়, নীতিবোধ। ‘তুমি বলো’, ‘আপনি বলো’ খাবি নয়, ‘খাবে’ আর ‘খাবেন’ বলো ইত্যাদি এবং আরও অনেক কিছু।
জীবিত ভাষা সতত অশুদ্ধ – যেমন বিশুদ্ধ মোটরগাড়ি বা বিশুদ্ধ জাহাজ বা এরোপ্লেন নেই সেরকম বিশুদ্ধ ভাষা বলেও কিছু নেই। প্রতিটি কাল তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী ভাষাকে অদলবদল করতে থাকে, ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে পুরনো আর নতুনকে চিনতে-ই পারে না- যেমন আধুনিক ইংরাজি চিনতে পারে না প্রাচীন ইংরাজিকে আর মঙ্গলকাব্যের বাংলা চিনতে পারে না এখনকার বাংলাকে। কাছের উদাহরণ- আমরা দুধ বা তেল কিনি প্যাকেটে বা বোতলে। তাই, প্রায়ই হাঁক দিই, ‘একটা দুধ বা দু’টো তেল নিয়ে আয়’। আমাদের পিতামহরা এ ভাষা বুঝতেন না, কারণ তখন এ সব জিনিস কৌটোয় মেপে বিক্রি হ’ত।
যে ভাষা প্রতিদিন নিজেকে না পাল্টায় সে মৃত্যুসাধনায় বসেছে। কারণ, একাধারে লেখক, সম্পাদক ও সমালোচক এইচ এল মেনকেন- এর মতে, “যে কোন জীবন্ত ভাষা যেন একটি মানুষ যার শরীর থেকে ক্রমাগত অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। সর্বদা অন্য ভাষা থেকে নতুন রক্তের যোগানের জন্য সে কাতর হয়ে থাকে। সে যোগান বন্ধ হলেই তার শেষের দিন ঘনিয়ে আসে।“
নতুন নতুন শব্দ আহরণ করে তাকে আত্মস্থ করলে ভাষার জোর বাড়ে বই কমে না। তবে দেখতে হবে তা যেন জবরদস্তি করে, বাক্য ও চিন্তার সৌকর্য ক্ষুণ্ণ না করে। যেমন ধরুন, চেয়ারকে আমরা কেদারা বলব না, আবার ‘গ্রহণ করুন’-কে ‘কবুল করুন’ বলতে যাব না; রক্ত দেখে বাংলায় ‘খুন’ ঝরছে বলব না, কিন্তু, নজরুল যখন কবিতায় “আসমানের ঐ আংরাখা খুন-খারাবির রঙ মাখা, কি খুবসুরৎ বাঃ রে বাঃ” লিখবেন তখন আমরাও নির্দ্বিধায় ‘বাঃ রে বাঃ’ বলে উঠবো।
এই কথাটা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও বেশী করে প্রযোজ্য। যখন সারা পৃথিবী রসগোল্লা কে রসগোল্লা আর বাসমতি চালকে বাসমতি বলতে রাজী তখন কেন আমরা পরের ছেলে ঘরের হয়ে যাওয়া হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনকে উদজান, অম্লজান বলে বাচ্চাদের ভিরমি খাওয়াতে থাকবো? মনে রাখতে হবে পরিভাষার অস্তিত্বের একমাত্র অজুহাত সহজ হওয়া। আরও কঠিন হলে সে ব্যর্থ।
আবেগ অতি বিষম বস্তু- আবেগে আবিষ্ট হয়ে পরিভাষা তৈরীর জন্য বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরি থেকে আর সাহিত্যিকদের লেখার ডেস্ক থেকে তুলে এনে মিটিং করে আমরা কত অমূল্য সময় যে নষ্ট করেছি ভেবে খারাপ লাগে। অনেক পরে বুঝেছি, মুখের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করা উচ্চমার্গীদের আয়ত্তের অনেক বাইরে (লেখ্য ভাষা তাঁরা দখল করে রাখায় যে কী আতান্তর হয়েছে সেটি সহ আরও দু’চার প্রসঙ্গ পরের লেখায়)। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে পাক খেতে থাকা, পালটে যেতে থাকা ভাষা বস্তুটি পণ্ডিতদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। তাঁরা যতই ‘মেশিন’কে যন্ত্র, ‘রিকশ’কে ত্রিচক্রযান বলানোর জন্য বক্তিমে দিন না কেন, কাজ হবে না। মুষ্টিমেয় যারা একটু চেষ্টা করবে কিছুদিন পরে হাসি-টিটকিরিতে তারাও বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাস হয়ে দাঁড়াবে।
দেখছি ভেবে অনেক দূর- বিশ্বসংসারের বহু জিনিস সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেলেও কথ্য ভাষা এখনও তাদের আঁকড়ে আছে। তথাকথিত অ-পরিশীলিত ভাষা, যাকে আমরা স্ল্যাং বলি, তাকে আটকানো যায় না, খিল্লি ওড়ানো (হাসির পাত্র করে তোলা), কোটি টাকাকে ‘পেটি’ বলা, চলে যাওয়াকে ‘কেটে পড়া’, বকুনিকে ‘ঝাড়’- এসব তো আছেই- আরও আছে। স্ল্যাং কেন তৈরি হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে চমস্কি বলেন, অল্পবয়সীরা সব কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চায়। তার প্রকাশ নাচে-গানে যদি হতে পারে, ভাষাতেই বা হবে না কেন? আর একটা ব্যাপার আছে গত কালের শীলিতভাষ আজ অশ্লীল হয়ে দাঁড়ায়। একটি উদাহরণ মনে পড়ছে- আজকাল কেউ ভদ্র সমাজে স্বামী-স্ত্রীকে মাগ-ভাতার বলে না, আগে বলত। অন্য দিকে তথাকথিত স্ল্যাং-কে বাধ্য হয়ে সর্বজনের মেনে নেবার ইংরাজী উদাহরণ বোধ হয় ট্যাক্সিকে ‘ক্যাব’ আর টাকাকে ‘বাক’ বলা।
আপন অন্তরে অবগাহি- প্রথম প্যারার জের টেনে বলি, কথা বুঝল না বলে বিলাপ করার আগে ভাবতে হবে,
ক) আমি মনের ভাবটি সত্যিই পুরোপুরি প্রকাশ করেছিলাম, না বলার আগে উঠে আসা কথাগুলি ‘উনি কি ভাববেন’ এর ছাঁকনিতে ছেঁকে বলেছিলাম?
খ) শ্রোতার রিসিভার আমার শব্দ সঙ্কেত কী ভাবে তাঁর মনে প্রতিফলিত (Decode) করতে পারে তা নিয়ে একটু তলিয়ে ভেবেছিলাম কি না?
গ) শব্দচয়ন খ-এ লেখা চিন্তা’র ফসল ছিল কি না?
এর পরেও বিনয়ের সাথে বুঝতে হবে যে মনের ভাবকে পুরোপুরি বাক্যে ফুটিয়ে তোলা শুধু মানুষের নয়, দেবতাদেরও অসাধ্য কাজ (সে রকমটি না হ’লে গীতার, কোরানের, বাইবেলের ব্যাখ্যা করে লক্ষ লক্ষ বই আজও লেখা হত কি!)।
অতঃ কিম- বেশি ভাবতে গেলে যদি মাথা গরম হয়ে যায়, তাহ’লে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবৎ খেয়ে চিন্তায় গুলি মেরে নিজের কাজ ভাল ভাবে করতে থাকুন। আপনি অর্থে- পরমার্থে (জ্ঞান) তালেবর হয়ে উঠলে লোকে আপনার ভাষা বুঝতে প্রাণপাত করবে, ইন্টারপ্রেটার নিয়ে আসবে, যেমন স্টিফেন হকিং-এর জন্য করেছিল। ততটা করতে যদি ইচ্ছে না হয়- যদি আমার মত অলস প্রকৃতির হ’ন তবে কোন তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র বাণীবর্ষণ করতে থাকুন, যার দরকার সে নিজেই বুঝে নেবে। একটু সাবধানতা মন্দ নয়, কারণ-
‘পড়লে কথা দশের মাঝে, যার কথা তার বুকে বাজে।‘
সেই বাজনাটা একটু বেমক্কা-বেতাল হয়ে গেলে নিজের বুক-পিঠ দুটোই সামলানো মুশকিল হতে পারে। সে সম্ভাবনা থেকে বাঁচার আশায় নন ভায়োলেন্ট কমিউনিকেশন (M. B. Rosenberg)- নামে একটা বই পড়া শুরু করেছি। বকবকানির নেশা ছাড়তে না পারলে আপনারাও তেমন কিছু একটা পড়তে পারেন…
-অরিজিৎ চৌধুরী
About Author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.