ছোটবেলায় আমাদের ইস্কুলে ড্রয়িং টিচার ছিলেন জলধরবাবু (ওঁর নিজের ভাষায়, ‘ডইং স্যর’)।এই নামোল্লেখমাত্র মধ্যবয়সী যে মানুষটার ছবি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তার পরনে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবী, নাদুসনুদুস, দাড়িগোঁফ কামানো সদাহাস্যময় একখানি মুখ।উনি আবার আমাদের প্রতিবেশী হতেন বলে জানতাম যে ওঁদের বাড়ির সকলেই ছিলেন বেশ কেউকেটা গোছের—উকিল, ডাক্তার ইত্যাদি, কিন্তু ছোটভাই এই জলধরের ‘কিছু হয়নি’ বলে তাঁর মায়ের বড্ড আক্ষেপ ছিল, যিনি আবার আমার ঠাকুমার সই হতেন। জলধরবাবু ছিলেন অকৃতদার । ও’বাড়ি-এ’বাড়ি বড় ভাবসাব ছিল আমাদের, আমার বাবা-জ্যাঠা-কাকারা ওঁদের বড়-মেজ-সেজকর্তাদের বন্ধুটন্ধু হতেন, যেমন স্যরের ভাইপো পলাশ ছিল স্কুলে আমার ক্লাসমেট।
বিশ্বকর্মাপুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপক চল ছিল সেকালে, আর তার প্রস্তুতি চলতো মাসখানিক আগে থেকেই—টিফিনের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে কাত্তিক বোসের দোকান থেকে গুজরাটী মাঞ্জা কিনে আনা দিয়ে যার শুরুয়াৎ।তা, সেই বিকেলে পলাশদের মস্ত ছাদে সদলবল ঘুড়ি ওড়ানোর মহড়া চলছে, বিশ্বকর্মার আর তিনচারদিন দেরি আছে। কখনও ঘুড়ির ধরতাই দিতে ছাদের ঐ কোণে গেছি, দেখি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জলধরবাবু খিঁক্ খিঁক্ করে হাসছেন, আর আঙুল তুলে কী যেন দ্যাখাচ্ছেন উপরে্র দিকে।
‘হাসছেন কেন,স্যর?’ শুধোই।
‘ঐ দ্যাখ্, দ্যাখ্, মেঘের গা ফুঁউউড়ে কেমন রোদ্দুর বেরিয়ে আসছে বর্শার ফলার মতন!’ খিঁক্ খিঁক্ খিঁক্ খিঁক্…..
দেখলুম তাকিয়ে। হ্যাঁ, রোদ বেরোচ্ছেই তো মেঘ ফুঁড়ে। তা, এতে এতো হাসির কী আছেটা? পরে পলাশকে এ’গল্প করতে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, ছোটকা-টা অমনই। সেদিন ঐ নিমগাছের ডালে কাগের বাসায় ডিম ফুটে ছানা বেরোতে দেখে হেসে কুটিপাটি! ঠাগ্মা তো তাই বলে…..’
*
পরের দিন থেকে আমাদের মুখ ভার, বড্ড ভার, কারণ আকাশের মুখ ভার! সে-বছর দুগগাপুজো বেশ আগে আগে পড়েছে, বর্ষার রেশ কাটেনি তখনও। তাহলে কি বিশ্বকর্মাপুজোর দিন ঘুড়ি ওড়াতে পারবো না? এই চিন্তাতেই ক্লাস ফাইভ-সিক্সের বালককুলের চোখে জল। বালিকাও ছিল একজন। পলাশের বোন মিনি।সে যদিও ছাদে উঠতে পায় না, কিন্তু আমাদের অনেক খেলার সাথী। বাবা ওকে এক রঙচঙে বিলিতি বই কিনে এনে দিয়েছেন, তাতে হাজারো ইন্ডোর গেমস শেখানো আছে।ওখান থেকেই মিনি আমাদের ‘ডাম্ব-শরেড’ খেলতে শিখিয়েছিল, আমরা সকলে খেলতুম একসাথে। তা, সেদিন ভারি বর্ষার কারণে বিকেলবেলায় আমরা ছলোছলো চোখে সকলে ঘরে বসে আছি দেখে মিনিরও চোখে জল। মাঞ্জা ভিজে কাঈ!
এমন সময় ছপ্ছপ্ করতে করতে কাগভেজা হয়ে জলধর স্যরের কক্ষে প্রবেশ।যথারীতি হাসছেন মৃদু মৃদু, ‘এই দ্যাকো, তোমরা সব এখেনে বসে আচো, আর ঐ দিকে…..’
আমরা পাত্তা দিলুম না, কারণ এইটি ছিল ডইং স্যরের সিগনেচার-বাক্য……ওঁর কাছে তো সবকিছুই বড্ড আশ্চর্যের, সমস্ত জীবনটাই ইভেন্টফুল।
ফট্ করে পকেট থেকে এক দেশলাইবাক্স বের করে বললেন, ‘বল দিকি, কী আচে এর মধ্যে?’
সেকি? স্যর কি আজ ম্যাজিক-ট্যাজিক দেখাবেন নাকি?
মিনির চেয়ারের পাশে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বাক্সটা সামান্য খুলতে আমরা সকলেও হামলে পড়ে দেখে নিলুম যে ভিতরে নীলচে-কালচে এক পোকা নড়নড় করেছ।
‘কাঁচপোকা!’ মহানন্দে বলে উঠলেন জলধরবাবু, ‘কোথায় পেলুম বলতে পারলি না তো?’ আমাদের বলার ইচ্ছেও নেই, এমনিতেই ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে না বলে মেজাজটা খিঁচড়ে আছে, এখন কি আর বাচ্চাছেলের মতো ঐ কাঁচপোকা নিয়ে খেলার সময় আছে?
‘এই রে! যাঃ! দেখেছ, পুরো ভুলে মেরে দিয়েছি।’ বলে বাক্স-টাক্সো ফেলে লাফ মেরে ঘর থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন স্যর আর সেই কাঁচপোকাটাও মওকা পেয়ে ভোঁ করে উড়ে জানলা দিয়ে পালিয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা হতভম্ব!
‘গেলো ঐ পিঁপড়েদের চিনি খাওয়াতে’। মুখ বেজার করে শামু বললো। পলাশের খুড়তুতো ভাই।
*
সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরা মাত্র মা-ঠাকুমা ঝাঁঝরে উঠলেন, ‘কোন্ আক্কেলে তুই আজ এতো দেরি করে বাড়ি ফিরলি?আজ যে গুরুদেবের পাঠ রয়েছে সন্ধ্যেবেলা।’
এই রে! এক্কেবারে ভুলে মেরে দিয়েছি। মঠের এক গুরুদেব মাঝে মাঝে আসেন আমাদের বাড়িতে। কথামৃতপাঠ হয়। সপরিবার গদগদ ভক্তিতে শুনতে বসতে হয়। হাত-পা ধুয়ে নিয়ে সেদিনও বসলুম গিয়ে আমাদের অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গে, বাবা-জ্যেঠারাও আছেন।
কী পাঠ করছেন অতো ঢুকছে না কানে।মন পড়ে আছে আকাশে। বৃষ্টি থামবে তো? বিশ্বকর্মার দিন ঘুড়ি ওড়াতে পারবো তো? গুরুদেব সেদিন পাঠ করছেন সারদানন্দের লীলাপ্রসঙ্গ থেকে। রমতা সাধু এক এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। সারাদিন যা দেখেন, তা-ই তাঁর আশ্চর্য লাগে, আর হো হো করে হাসেন,….. ‘অরেঃ ক্যা প্রপঞ্চ হৈ! এই দিন ছিল, আর এই রাত ঢলে এলো।কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!’ কিশোর গদাধর তাঁর কাছ থেকে আনন্দের পাঠ পেলেন।পরমেশ্বরের সকল স্বাভাবিক কর্মই আনন্দের, কেবল সেই আনন্দটা দেখার চোখ চাই, মন চাই।
কিছুই বুঝলুম না। সে তো আমাদের জলধরবাবু ডইং স্যরও আকাশের মেঘ আর গাছের ডালে কাগের ছানা হওয়া দেখে আনন্দে মেতে ওঠেন। তাহলে কী উনিও একজন সাধু? কে জানে বাবা।এখন কাল রোদটা উঠলে বাঁচি।
*
পরের দিন ছুটি ছিল, বোধহয় রোববার।সকাল দশটার মধ্যে পলাশদের ছাদে গিয়ে হাজির। রোদ না উঠলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। এই ম্যাদ্ম্যাদে আবহাওয়ায় মাঞ্জা কড়া হয় কখনও, বলো? নিচে থেকে মিনি চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘টুবুদা, শীগগির নিচে নেমে এসো’, আর আমরা সব দুড়্দুড়্ করে তিনতলার ছাদ থেকে নেমে এলুম।দেখি ডইং স্যরের সঙ্গে এক ফকিরবেশী দাড়িওয়ালা লোক দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, গলায় তাঁর এক হারমোনিয়ম ঝোলানো।
‘কেন মল্লিকদা-কে ডেকে আনলুম বলতে পারবি না কেউ তোরা নিশ্চই?’ চোখ ছোট ছোট করে যেন বড় গোপন কথা কিছু বলছেন এমন ভাবে বললেন স্যর। আমরা বেজার হয়ে ছাদে ফিরে যেতে যাচ্ছি, স্যর বললেন, ‘অ মল্লিকদা, ধরো না তোমার সেই…..’
এখন মোটেই আমাদের গান শোনবার মুড নেই। আমাদের লিডার পলাশ সেটা বললোও, ‘ছোটকা, দেখছ বিষ্টিতে সব ঘেঁটে আছে, আর তুমি এখন গান শোনাতে চাচ্ছ।’
‘ওরে, বেঁটে বক্কেশ্বর, সেই জন্যেই তো গান শুনতে হবে। দীপক রাগিনী!’
‘যে রাগে আগুন জ্বলে ওঠে?’ মিনির গালে হাত!
‘আর বিষ্টি বন্ধ হয়ে যায়!’ আমার কথাটার মধ্যে বেশ ঠেস্ ছিল।
‘কৈ, মা-জননী কৈ? দেখি?’ মিনির গলা শুনে সে গায়ক ‘মল্লিকদা’ দেখি ইদিক-উদিক খুঁজছেন।আরে, মেয়েটি তো সামনেই বসে আছে; উনি দেখতে পাচ্ছেন না?
আর তখনই বুঝতে পারলাম যে উনি দৃষ্টিহীন!
এবার উনি হারমোনিয়মের রীড টিপে টিপে সুর তুলতে শুরু করলেন। গাইছেন না কিন্তু তখনও, কেবল সিঙ্গল রীডের সেই হারমোনিয়মে অদ্ভুত দ্রুততায় আঙুল চালিয়ে চালিয়ে সুর তুলছেন। মা-জ্যেঠিমা-ঠাকুমারা ঘিরে এসেছেন ওঁর সুর শুনতে। অবাক অদ্ভুত বিস্ময়ে আমরা জনা পনের প্রাণী সেই অন্ধ গায়কের সুরে মন্ত্রমুগ্ধ! আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না, শব্দ করছি না। কেবল কোথায় ভেসে গেছি, ডুবে গেছি সেই অজানা সুরে।
হঠাৎ দেখি মিনি ওর হুইলচেয়ারটা ঠেলে পিছনে সরিয়ে দিয়ে একা একাই উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এক এক পা এগোনোরও চেষ্টা করছে যেন, যা দেখে আমরা সকলে বাক্যহারা। জ্যেঠিমার তো প্রায় মূর্ছা যাবার উপক্রম।
কতক্ষণ ডুবে ছিলুম আমরা সেই সুরসাগরে? জানিনা।
এবার কলিম মল্লিক গেয়ে উঠলেন আগমনী গানঃ
‘কবে যাবে বলো গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে
ব্যাকুল হইয়েছে প্রাণ, উমারে দেখিতে হে….’
হঠাৎ আকাশের দিকে ঘাড় তুলে দেখি সেখানে ঝকঝক করছে রোদ্দুর! রোদ্দুর!!
পুজোর আর ক’দিন বাকী?
ছোট্টগল্পঃঃ
“রোদ্দুর! রোদ্দুর!!”
দীপঙ্কর চৌধুরী
কলিকাতা
About the author
Dipankar Choudhuri (born 1961) is a Kolkata based author. He had his schooling at Hindu School and Presidency college. He had been working with a bank and travelled extensively. He regularly writes science fiction stories for teenagers which are published in various magazines. He has 2 books to his credit. Post retirement (from bank), he plans to devote his full time in writing.
দারুণ..দারুণ।
আহা। পড়ে মনটাও রোদ্দুর রোদ্দুর হয়ে গেল। কি নরম রোদের মত ভাষা। লেখার হাত ধরে ধরে আমরা সম্ভাবনা থেকে অসম্ভবের দেশে পৌঁছে যাই। ঘুড়ি হয়ে উড়ি রোদ্দুরে। অভিনন্দন লেখককে।
অপূর্ব অপূর্ব। আলগোছে আগমনী গলায় ঢেলে দিল এই লেখাটি। সুরটা গুনগুন করেই চলেছে।বনবন করে।