কথাগুলি রয়ে যায় বলিতে…… (২/২)
কথা থেকে লেখা- ভাবনাকে কথায় ফুটিয়ে তোলার কাজটা শক্ত হ’লেও তা নিজের আওতার মধ্যে থাকে। শিশুরাও যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কাজটা করেও ফেলে, কারণ কম্যুনিকেশন যা কিনা, পিঁপড়ে, মৌমাছি, বাঘ, সিংহ, শুশুক, তিমি সবাই করে থাকে তা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। বাধা পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় যখন লেখার ব্যাপারটা আসে। মানুষও প্রকৃতির সৃষ্টি, অতএব ‘তার তৈরি সব কিছুই প্রাকৃতিক’ বলে গোঁয়ার্তুমির ঝান্ডা তুলে না দাঁড়ালে আমরা সহজেই বুঝতে পারি লেখা একটি বিমূর্ত মানুষী ব্যাপার। একটি হায়েনা যেমন মুর্গী বলতে একটি পালকওয়ালা চলনশীল কখনো ঊড়ুক্কু একটি জিনিস বোঝে, আমাদের বাচ্চারাও বোঝে সেভাবেই। কিন্তু, তারা একটু বড় হবার পর তাদেরকে কিছু অক্ষর সাজিয়ে বোঝানো হয় এটা মুর্গী। এতে রঙ্গীন পাখ-পাখালি, গাছ-পুকুর নদী-নালা ভরা বাস্তব জগতের সাথে সাদা-কালো অথবা একটু রঙমাখা বইয়ের জগতের যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় সেটা বাচ্চারা গুছিয়ে বলতে পারে না, বড়দের খুশী রাখতে কোন রকমে ম্যানেজ করতে জেরবার হয় আর আমরা তাদের বানান ভুল ধরে হয়রান করতে থাকি।
‘এ সব পণ্ডিতেরি হাতে আমায় কেন সবাই মারো’- অগণিত মানুষ রাস্তাঘাটে, খেলার মাঠে কথ্য ভাষা তৈরি করে, কিন্তু লেখার নিয়ম তৈরি করেন মুষ্টিমেয় পণ্ডিত মানুষ। লেখার ব্যাপারটা এমনিতেই কঠিন, এতে আরও গুলিয়ে যায়। কাউকে দোষ না দিয়েও সারা পৃথিবীতে প্রায় সব ভাষাতেই লেখাটা যে অপ্রয়োজনে শক্ত করে তোলা হয়েছে এ সন্দেহ থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। বাংলা ভাষা বরং একটু সহজ (বিশদ ব্যাখ্যা পরে), কিন্তু তাতেও কোথায় দীর্ঘ ঈ বা ঊ প্রয়োগ করতে হবে তা বোঝা মুশকিল কারণ বাংলায় দীর্ঘ স্বরের উচ্চারণ নেই বললেই চলে। তারপর ধরুন কোথায় ড় হবে কোথায় র আর কোথায়-ই বা ঢ়, কোথায় ন আর কোথায় ণ তার হদিশ পাওয়া উচ্চারণের ভিত্তিতে অসম্ভব। যুক্তাক্ষর আর এক ব্যারিকেড তৈরি করে। ‘বুঝে বুঝে পড়া উচিৎ’ শুনতে শুনতে মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আর একটা অসুবিধে হ’লো হসন্ত শব্দকে লেখা আর পড়তে পড়তে বোঝা। রবীন্দ্রনাথকেই ধরি, “আমায় কেন (ও কারান্ত) বসিয়ে রাখ (ও কারান্ত)” আর সেই কবিতাতেই “মেঘের (হসন্ত) পরে মেঘ (হসন্ত) জমেছে”। তবুও বলি, বাংলা বানান ফোনেটিক না হ’লেও চিকেনের বা সব্জি’র টুকরো ফেলা স্যুপ খাব, না পান করব- নিয়ে তার সমস্যা কম, আরও বড় কথা লিঙ্গভেদ নেই, যা কিনা ফোনেটিক হিন্দি ভাষা শেখার এক বড় সমস্যা। সাধারণ মানুষ কথা বলতে বলতে জড় পদার্থকেও লিঙ্গ অনুযায়ী ভাগ করে ফেলেছে, পৌরুষের ধ্বজা গোঁফকেও (ফরাসীরাও তাই) স্ত্রী-লিঙ্গে লীন করে দিয়েছে ভাবতে অসুবিধে হতে হতে দেখি ফরাসী আর জার্মানরাও এ ব্যাপারে কম যায় না। জটিলতার দু’টি উদাহরণস্বরূপ দেখুন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে বিড়াল ফরাসীদেশে পুংলিঙ্গ আর জার্মানীতে স্ত্রী, আবার দ্বিতীয় দেশটিতে (জার্মানী) বহুবচন মাত্রই স্ত্রীবাচক। লিঙ্গভেদের সমস্যা আরও বাড়বে কারণ আন্দোলন করে অনেকেই এখন লিঙ্গনিরপেক্ষ হতে চাইছেন। অতি সূক্ষ্মতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ভোঁতাভাব- ইংরাজির ‘শ্যাল’এর অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে, সবাই ‘উইল’ বলে কাজ সারছে আর ‘গাই’ (Guy) শব্দটি প্রাথমিক ভাবে পুরুষ বাচক হলেও অল্পবয়সী মেয়েরাো নিজেদের জন্য ঐ সর্বনাম ব্যবহার করছে।
আরো গুচ্ছের সমস্যা আছে। হিন্দির মত-ই ফরাসী-জার্মানে কোনো বস্তুর লিঙ্গ বোঝার কোন সোজা-সাপ্টা নিয়ম নেই, জিজ্ঞেস করলে কেউ বলতে পারবে না ‘নিজেকে-ই জানতে হবে’ (ভাষা এক অনুভূতি)। এ সব দেখার পর ইংরাজি যা শিখতে গিয়ে আমার এক ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আই ডু’ (I do) হ’লে ‘হি ডুজ’ (He does) হবে না কেন?’ আর একটি মেয়ে ইলেভেন, টুয়েলভ-কে ‘ওয়ানটি ওয়ান, ওয়ানটি টু’ করে নিয়েছিল, সেটিকেও সহজ মনে হয়।
ফরাসী ভাষার বানানে তো পণ্ডিতদের বলগাহীন নৃত্য, সেখানে champs-Elysee-র উচ্চারণ শঁজেলিজে, ভারসাই এর বানান Versailles আর Montmartre (মঁমার্ত্র)।
আর না বাড়িয়ে, এটুকু বলে শেষ করি যে, লেখালিখি চলতে থাকছে বলে ব্যাপারটা যে অতি সহজ এমন ভাবা ঠিক নয়। মুখের কথায় ফুটতে গিয়ে ভাবনার কিছু পালক ঝরে যায়, আরো ক্ষতি হয় তাকে যখন লেখায় নামানো হয়। এবার যখন কেউ পড়েন (রিভার্স ডি-কোডিং) তার কাছে আদি ভাবনার কোন চেহারাটি যে পৌঁছোয় তা আন্দাজ করা মুশকিল। এক-ই লেখার মানে নানা রকম দাঁড়ায় বলে এডমন্ড উইলসন নামে এক সমালোচক বলেছিলেন (দেখে মনে হয় এক বই পড়ছে, কিন্তু) , ‘দু’জন আলাদা মানুষ কখনো এক-ই বই পড়ে না।‘
কম্পিউটার এর জন্য শ্রেষ্ঠ ভাষা – আগে সবকিছুতেই ঈশ্বরের যোগাযোগ দরকার হত। এখন সে জায়গার অনেকটাই কম্পিউটার দখল করে নিয়েছে। সে জন্য ভাষার গুণগান করতে গিয়ে কম্পিউটার-এর শরণ নিতেই হয়। মাঝে মাঝেই শোনা যায় কম্পিউটার-এর জন্য এই ভাষা বা ওই ভাষা সর্বশ্রেষ্ঠ। এসব কথা যাঁরা বলেন তাঁরা কথাগুলো প্রমাণ করার দায়িত্ব কোড লেখকদের ওপর ছেড়ে রাখেন। মজার কথা হ’ল, মিতভাষী কম্পিউটার কোড লেখকরা ও সব কথায় কান না দিয়ে প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টিতে ব্যস্ত। বহু আগে ছিল কোবোল, ফোরট্রান তার পর এল জাভা, পাইথন এখন ‘আর’ ল্যাঙ্গুয়েজ আরও কত কি। ২০২১ সালের হিসেব দেখাচ্ছে তখন-ই সাতশো’র বেশি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল।
শেষ নাহি যে- হৃদয়ের কথা বলিতে আমরা যতই ব্যাকুল হই না কেন, কিছুতেই সেটা নিখুঁত ভাবে বলা হয়ে উঠবে না, অথবা বলতে পারা গেলেও যিনি শুনছেন তিনি যথার্থ বুঝবেন না- এই সত্যিটা মেনে নিলে সুখ না এলেও স্বস্তি আসবে। পারফেক্ট কম্যুনিকেশন, মানুষের সাথে (বা কম্পিউটার-এর সাথেও) একটি সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু না হলেও তেমন ক্ষতি কিছু হয় নি… হবে না। একটু না বলা কথা না থাকলে আকর্ষণও মার খায় যে। চেষ্টা চলতে থাক, ভাষা আরও সূক্ষ্ম ভাব ফুটিয়ে তুলুক। শেষ পর্যন্ত কথার ক্ষমতা ফুরোলে ভাব ফুটুক দেহভঙ্গিমায়… আঁখির আলোয়। মনে রাখবেন, এক মহানুভব বলেছেন, বিয়ের নিখুঁত ভিত হ’ল পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি (The perfect basis of marriage is mutual misunderstanding)।
-অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
বাক স্বাধীনতা আছে ও থাকবে কিন্তু লেখস্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তবু মাঝে মাঝে জ্ঞানীগুণীরা যেমন রবীন্দ্রনাথ বা ক্ষমতাশীল প্রতিষ্ঠান যেমন আনন্দবাজার নিয়ম পালটাতে চেষ্টা করেন। তাতে ব্যাপারটা আরো গুলিয়ে যায়। কম্পিউটৈরের কোডের বানান ভুল হবার জো নেই কারণ লেক্সিকাল এনালাইজার ক্ষমাহীনভাবে ভুল ধরাবে। যদিও শেষপর্যন্ত যা লেখা তার কি মানে তা বোঝা প্রায় মনুষ্যসাধ্য
থাকে না। বাধ্য কম্পিউটার মানুষের ওপর আস্থা রেখে শুধু আদেশ পালন করে যায়। তা থেকে কখনো টিকটক কখনো পেগাসাস কখনো মেটা ভার্সে হাসিমুখ প্রপিতামহের অবতার।
লেখককে এই প্রাণবন্ত আলোচনার জন্য অভিনন্দন।
Excellent writing and intense thoughts. Chamatkar …aaste aaste jome kheer hochhe