অণু সন্ধান ৪
সমভূমি।
বাসুদেব গুপ্ত।

নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এলো সুদর্শন। ওর বাসনা ছিলো একেবারে ২৫ তলায় বাসমান হতে । নীচের তলার মানুষের শরীরের গন্ধটা ভালো না, গায়ে ধুলোর কম্বল। সসোলিটোতে বিজয় মালিয়ার বাড়ী দেখেছিল
১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১। প্রশান্ত মহাসাগরের বুক থেকে উঠে এসেছে জলপরীর মত দ্বীপ। ৯১১ কবেই ভুলে গেছে। কিন্তু সেই গাড়ীর মেলা, ফেরারি, ল্যাম্বোরগিনি, বেন্টলি ভোলেনি। একেই বলে জিন্দগী। টপে উঠতে হবে। নো কম্প্রোমাইজ। তাই যখন সরকারী সংস্থা বিজ্ঞাপন দিলো মেঘবালিকা আবাসন, জলের ধারে জলের রানি, তক্ষুণি বুক করে দিয়েছিল। ২৫ তলায় বুকিং পরে পাল্টে হল ১০ তলা। বৌ রম্যার অত ওপরে মাথা ঘোরে । আর ৯১১ এর ছবি ওরও দেখা। মনে একটা চাপা ভয় আছে, যদি প্লেন এসে ধাক্কা মারে? ১০ তলা ওর মতে সেফ এনাফ, তরতর করে নেমে যাওয়া যাবে। ২৫ তলায় হলে তো উড়ে উড়ে নামতে হবে।

রম্যার কথা শোনাটাও গুড সেফটি প্র্যাকটিস। তাই ও যখন এসেই একজন ঠিকের ব্যবস্থা করল সেটা মেনে নেওয়াই দস্তুর। কোন ব্যাকগ্রাউন্ড চেক নেই। অসুখ বিসুখ আছে কি না, অভিজ্ঞতা কেমন তার কোন রেকর্ড নেই। শুধু এসোসিয়েশন অফিসের ম্যানেজারের বৌএর কথাতেই রেখে দেওয়া হল। বেশি প্রশ্নের জবাব মেয়েরা দেয় না। শুধু বলল, এসব ব্যাপার তুমি বুঝবে না। আর লোক কি বললেই পাওয়া যাবে। আমি কথা বলে নিয়েছি। ওর বাড়ী বিদ্যাসাগর বস্তিতে। কামাই করতে পারবে না বন্ধ অবরোধ এসব বলে।

বিদ্যাসাগর বস্তি শহরের বুকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য জবর দখল বাসভূমির একটা। মেঘবালিকার একদিকে বিস্তৃত লেক। নারিকেল বীথির এভিনিউ। বোটিং। জলের ধারে কাবাবের দোকান। আর উল্টা দিকে বিদ্যাসাগরের ম্রিয়মাণ মূর্তি। কোন বিদ্যায় উৎসাহী নেতার প্রতিষ্ঠা করা। তার পরেই বস্তি। যেমন হয়। এলোমেলো ইঁট কাঠ চিন এসবেস্টস ত্রিপল দিয়ে ঝুপড়ি,খুপরি যে যেমন পেরেছে করে বসে আছে। সেখানে আছে দরজী,কলের মিস্তিরি, অটোওলা,রিক্সাওলা, সুগারকেনজুস, কি নেই। আর আছে অফুরন্ত ঠিকে ঝি আর রাঁধুনির সাপ্লাই। বড় বাড়ির লোকে কাজ দেয়। বস্তির লোক কাজ করে দেয়। সুদর্শনের গর্বই হয়। শুধু অফিসে বসে দেশ চালানোই নয়, এত গুলো মানুষের রুজিরোজগার এই ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের হাতে।

বিকাশশীল দেশে প্রোমোটারিই আসল বিজনেস। তাদের সুনজর পড়েছে জানা গেল যখন এক শনিবার বস্তির বেশ খানিকটায় আগুন ধরল। তারপর হঠাৎ একদিন লাগল ছোটখাটো মারদান্গা। পুলিশ কর্ডন বসল। সুদর্শনের ওপরমহলে বৈঠক বসল। শান্তি ও আইনের শাসন রক্ষার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত।

ঠিকে ঝি পুন্যলতা বা পুননি কাজ করছে। কামাই করে না। পরিস্কার হাতের কাজ। মেয়ে সেলাই করে। সেই কাজ কোমপানির ছাপ মেরে অনলাইনে বিক্রি হয়। ছেলে অটো চালায়। ফুটবল খেলে। নো কমপ্লেন বয়, নো কমপ্লেন গারল। বিকাশ হচ্ছে। সুদর্শনের কাছে নোটিশ এলো বস্তি ভাঙার আদেশ এসে গেছে। ওকে সুপারভাইজ করতে হবে। সামনের শুক্রবার। বড্ড লাউডস্পীকার বাজে। একটা মেসেজও যাবে।

এখন মেসেজের যুগ। ফোনে কথা নয়। মেসেজ যায়। ঈশ্বর বজ্রপাতে মেসেজ পাঠান। শাসনকর্তা পাঠান বুলডোজার দিয়ে। সুদর্শন জিজ্ঞেস করল রম্যাকে তোমার পুণ্যবতীর বাড়ি তো এই বিদ্যাসাগর না? রম্যা অবাক হয়। কিন্তু পাত্তা দেয় না। বলে তোমার জেনে কি? রম্যার এখন মুড পাল্টায় যখন তখন।

রম্যার নমাস চলছে। সব ঠিকঠাক। পুননি এক্সট্রা সেবা করছে। হাত পা টিপে দেয়। আর গান শোনায়। গলাটি ভালো। বলে পেট থেকে গান শুনলে সুরের কান তৈরী হয়। রম্যা আড়ালে সুদর্শনকে বলে, দেখেছ, কেমন লোক রেখেছি।

জেনে সত্যি কি হবে? অর্ডার বেরিয়ে গেছে। তদারকির কাজ ওর। প্যারা মিলিটারী ঘিরে রইল। যাতে কোন গোলমাল না হয়। পুণ্যবতীর বাড়ীও যাবে। ঠিকে ঝি কোথায় পাবে এখন? শালা এই এক ঝামেলা। মারীচ সংবাদ।

যখন বস্তিটা ভান্গা হচ্ছে, সুদর্শনের বেশ লাগছিলো। যেন সমস্ত আগাছা উপড়ে ফেলে এখন তৈরী হবে উপবন। ঝকঝকে রাস্তা, ফোয়ারা, সুইমিং পুল। ভদ্রলোকের আবাস।

দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লাগছিল। নোংরা মানুষগুলো হার মেনে ধীরে ধীরে পিছনে চলে যাচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফোনটা বেজে উঠল। রম্যার গলা।

এক্ষুনি এসো। আমাদের বিল্ডিঙে হঠাৎ ক্র্যাক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ওপরের তলাগুলো ভেঙে পড়বে এক্ষুনি। কি করে নামবো আমি এই অবস্থায়। পুন্নিও আজকে আসে নি।
পুন্নি কি করে আসবে? বলতে গিয়েও থেমে গেল সুদর্শন। কি করে একশান ছেড়ে যাবে কিচ্ছু মাথায় আসছে না। ফোনে ইউটিউবে নিউজ দেখল। বস্তি ভাঙার খবর নেই। বলে দেওয়া আছে না দেখাতে। কিন্তু ব্রেকিং নিউজ। মেঘবালিকা আবাসনে ভাঙন। উপরের তলার বাসিন্দাদের এখনও নেমে খালি করার নির্দেশ। তদন্ত শুরু হচ্চছে। যতদূর মনে হয় বাড়ী তৈরীর মাল মেলায় ভেজাল ছিলো।

পাগলের মত ফোন করে সুদর্শন পুন্নিকে। অনেক পরে ফোন পাওয়া যায়। পুন্নির শান্ত গলা। জানায়
‘বৌদিমণির ব্যথা উঠে গিয়েছিল। আমার ছেলে ও ওর বন্ধুরা ধরাধরি করে নামিয়ে হাসপাতালে নে গেছে। আপনি ওখানে চলে যান।’
‘তুমি তুমি এখন তো তোমার ডিউটি নয়। কি করে জানলে?
‘আপনি জানেন না? আমাদের তো আজ উচ্ছেদ হচ্ছে। তাই বস্তির লোক এসে এখানে জড়ো হয়েছি যে। আবার কোথাও গিয়ে বসত করব। তা আপনার বাড়ীতেও কি আর থাকতে পারবেন। সবাই বলছেল আপনাদের বাড়ীও নাকি ভাঙতে হবে?

ফোন রাখতেই আর একটা ফোন বাজে। হাসপাতাল থেকে। অভিনন্দন। আপনার একটা সুন্দর বেবি বয় হয়েছে। দুজনেই সুস্থ আছে। একটা নাম দিতে হবে, রেজিস্টার করার জন্য। আপনার ওয়াইফ বলেছেন আপনাকে চলে আসতে । আর নামটা ঠিক করে আসবেন।

আগে ঠিক হয়েছিল ছেলে হলে নাম হবে বিকাশ। মেয়ে হলে উন্নতি। এখন? সুদর্শন সিদ্ধান্ত নিলো নাম হবে বিপ্লব।

About Author


বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং