মেকি-মুগ্ধ
প্রস্তাবনাঃ ‘খাঁটি’, ‘বিশুদ্ধ’ এই শব্দগুলো শুনলেই রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে না এমন মানুষ নিতান্ত বিরল। শুদ্ধতার মায়াহরিণীর পেছনে ছুটতে থাকা মানবসমাজকে ‘কেন দৌড়োচ্ছ ভাই?’, এই সমাজবিরোধী প্রশ্নটি করে বসা সহজ নয়। শুধু জিনিষ নয়, মানুষের মধ্যেও কে খাঁটি আর কে-ই বা মেকি, খুঁজে আমাদের অতিব্যস্ত দিনাতিপাত। শুধু তাই নয়, যখন তখন মানুষ মেকি’র ইংরাজী নাম সিঊডো বলে গালি দিয়ে সোজা-সাপটা হাসিখুশি লোককেও গ্লানিময় ম্লানমুখ করে তুলছে।
সাধুভাষায় ‘বিপরীত-চিন্তা’ আর চলিতে ‘উল্টোবুদ্ধি’-গ্রস্তদের কথা আলাদা। সাধু বুদ্ধি’র চেয়ে সাধারণ বুদ্ধিতে ভরসা রাখা তাদের স্বভাব। আমার আবার সেই ‘তবু যদি কথা শোনে সে পাগল, মানিল না রবি-গান্ধীরে’ ধরণের রোগ।
ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে বার বার আম খাবার আমন্ত্রণে মালদায় গিয়ে বিশুদ্ধতার অসুবিধের দিকটায় প্রথম চোখ খোলে। নীরেস আমগুলো হ’ত ফিচারবিহীন, গোল ধরণের, তাদের সব্বার নাম ছিল ‘আঁটির আম’ বা ‘গুটির আম’। কোন আমের আঁটি কেউ খোঁজও করতো না। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি ইত্যাদি স্বাদু আমগুলোর কিন্তু নাম, জাত, ফিচার সব থাকত, তাদের বলা হ’ত কলমের আম। পরে জেনেছি, আঁটির আমগুলো জাত-না-খোয়ানো একটি-ই গাছের, মানে শুদ্ধ। আর কলমের আম হয় দুটি গাছ মিলিয়ে, মানে অশুদ্ধ।
তবে কিনা গরজ বড় বালাই। এও দেখেছি পারিবারিক উচ্চতা ও বিশুদ্ধতার স্তুতি গাইতে গাইতে মানুষ বিয়ের সম্বন্ধ খোঁজে অনাত্মীয়ের বাড়ি। এটাও জানলাম, যারা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই বৈবাহিক সম্পর্ক আটকে রাখেন তাঁদের সন্তানাদির মধ্যে নানারকম জন্মগত ত্রুটি হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয় রকম বেশী হতে দেখা যায়।
তারপর দেখুন ধাতুর রাজা, রাজারাণীর ভূষণ সোনার কথা। কবি লিখেছেন বটে, “দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা (খাঁটি) সোনা…”, কিন্তু তিনি জানতেন, যিনি গাইছেন আর যাঁরা শুনতে শুনতে ভাবে গলে যাচ্ছেন তাঁরাও জানেন সোনায় অশুদ্ধি না ঢোকালে তা প্রায় কোনো কাজেই লাগে না। মহার্ঘ সোনার উল্টোদিকের ধাতু সস্তা লোহারও এক অবস্থা। খাঁটি লোহার সাথে অশুদ্ধি মিশিয়ে না দিলে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা অধরা থেকে যায়। আবার দেখুন এলুমিনিয়মের মত নরম ধাতুও অশুদ্ধ হবার পর শক্তপোক্ত হয়ে বড় বড় প্লেন ঊড়িয়ে নিচ্ছে।
আমাদের দেশে আইআইটি ধরণের সংস্থা নিয়েও একটা ‘শুদ্ধ হলেই ভাল হবে’ ভাব উঁকি দেয়। গুরুগ্রামে এমডিআই নামে একটি ম্যানেজমেন্ট শেখার ইন্সটিট্যুট আছে তাঁরা বিজনেস কনসালটেন্সিও করেন। সেখানে শোনা একটি ঘটনা এরকম- ‘একবার একটি কোম্পানি এসে বলে, তারা আইআইটি-র মেধাবী ছাত্র ছাড়া লোক নেয় না, তবু রহস্যজনকভাবে টীমগুলোর কাজ ভাল হচ্ছে না। কারণটি কি আর সমাধান এমডিআই বার করুক-এই অনুরোধ।
‘এর পর আমরা (এমডিআই) ওঁদের কর্মীদের দু’দিনের জন্য ডাকি। প্রথম দিন তাদের ম্যানেজমেন্ট-এর কিছু বলতে গিয়ে দেখি সে সব তত্ত্ব প্রায় সবই তাদের জানা। পরের দিন তাদের মানসিক প্রবণতা বোঝার জন্য কিছু টেস্ট করে সমস্যাটা ধরা পড়ল। দেখা গেল, এদের সবাই স্বাধীনচেতা নেতৃত্ব প্রদানকারী মানসিকতার। ফলতঃ, কেউ কারো কথা শুনতে চায় না, তাই টীমওয়ার্ক মার খায়। এমডিআই-এর প্রেসক্রিপশন হ’ল, শুধু উৎকৃষ্ট আইআইটি নয়, টীমওয়ার্কে গতি আনতে তার একটু নীচুদরের কলেজ থেকেও রিক্রুট করতে হবে।‘ অবাক লাগলেও এই জিনিষটা কিন্তু নতুন নয়, মুদির দোকানীও জানেন যে শুধু সেলসম্যান দিয়ে কাজ চলে না আর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জানেন ভাল একাউন্ট্যান্ট-ই সর্বস্ব নয়।
বস্তু জগতের আরও উদাহরণ – সিমেন্ট সহজপ্রাপ্য হওয়ার আগে চুনের সাথে সুরকি মিশিয়ে গাঁথনি করতে হত, এখন সিমেন্ট-এর সাথে বালি আর কংক্রিট করতে গেলে পাথরের টুকরো মেশাতে হয়। জ্ঞানজগতে দেখুন সারা পৃথিবীতে ভাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়তে গেলেও একটু ভাষা, একটু ইতিহাস না পড়লে চলে না, হিউম্যানিটিজ পড়তে গেলে অন্ততঃ কিছুটা অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছুঁয়ে দেখতেই হয়। আর সুস্থ থাকার জন্য, যতই পুষ্টিকর হোক শুধু একরকম খাবার খেলে চলে না, মিশিয়ে খেতে হয়।
মানুষের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ দার্শনিক, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানী, বিশুদ্ধ কবি বা কুস্তিগীর বলে কিছু হয় না আবার ধর্মগুরুদের জিজ্ঞেস করলে জানবেন, ঈশ্বরকে যদি বা পাওয়া যায়, বিশুদ্ধ ভক্ত পাওয়া কত কঠিন।
তবে কেন মিছে খুঁজে ফেরাঃ তার কারণ মানুষ বাস্তব জমিতে বাস করে বটে, কিন্তু অনেকের মন পড়ে থাকে মনোভূমিতে। সেই রামচন্দ্রের যুগ… তারও আগে থেকে সোনার হরিণ হতে পারে না জেনেও তাকে ধরে নিজস্ব জানকীর কাছে না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
মরীচিকার পিছনে ছুটে না বেড়ালে তার বুদ্ধি আর প্রকৌশল দিয়ে সে স্বর্গ কেড়ে নেবার উদ্যোগ নেবে- এই ভয়েই কি ঈশ্বর মাঝে মাঝে তার সাধারণ বুদ্ধিটাও কেড়ে নেন? সেটি চলে না গেলে বড় কোম্পানির ম্যানেজার কী করে সেই সত্যিটা দেখতে পান না, যা এক অল্পশিক্ষিত দোকানের মালিক যুগ যুগ ধরে জেনে এসেছে।
ক্ষতি কি- বাস্তব থেকে মনোভূমি প্রবল হলে মানুষের যা হয়, তাকে বলে ‘আপনি আমাকে জুতি মারতে পারেন, কিন্তু অপমান করতে পারেন না’ ধরণের অবস্থান। মনোভূমির প্রভাবেই না খেতে পাওয়া লোকও পেটের খিদে, পিঠের চাবুক তুচ্ছ করে তথাকথিত সেন্টিমেন্টে আঘাতকারীকে মারতে ছোটে। অসতের কথা আলাদা, কিন্তু যদি তলিয়ে ভাবেন, ভগবানের সম্মান রাখতে যাবার জন্য নিজের জন্য দিনের খাবার যোগাড় করতে অক্ষম সৎ লোকটির এত আগ্রহ কেন- তাহলে বুঝবেন সে এ জীবনে সুখের আশা ছেড়ে ঈশ্বরকে তোয়াজ করে পরলোকে স্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করতে নেমেছে।
ঈশ্বর বিশুদ্ধতার পরাকাষ্ঠা, সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজমান, সর্বদ্রষ্টা । ‘তিনি সকল পাপীকে শাস্তি দিতে সক্ষম’ বলতে বলতেও তাঁর সম্মানরক্ষার কল্পনায় যে নিজের প্রাণ বাজি রেখে নাস্তিকের প্রাণনাশ করতে দৌড়োয়, সাধারণ বুদ্ধি সাথে থাকলে বুঝতো বিশুদ্ধ ঈশ্বরকে অসহায় ভাবা অতি খারাপ ধরণের নাস্তিকতা ছাড়া কিছু নয়। তা ছাড়া এতে বাস্তবের ভয়ংকর ক্ষতি হয়। মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়তে থাকে। সারা পৃথিবীতে যদি সেন্টিমেন্ট সার্ভে করা হয়, নিশ্চিত দেখা যাবে, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে তাঁর প্রকোপ ভীষণ রকম বেশী।
বিশুদ্ধতার আবেগ একটি জাতির পক্ষে কত ক্ষতিকর হতে পারে শ্রীলঙ্কা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। অনেকের মতে, বিশুদ্ধ জৈব সার ছাড়া ব্যবহার করব না-এই পণ রাখতে গিয়ে দেশটা ডুবে গেল। আর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বহু ছাত্র অঙ্কে বিশুদ্ধ ১০০% পায় নি বলে সারা জীবন মনমরা হয়ে কলেজ পালানো স্টিভ জবস আর স্কুল পালানো ধীরুভাই-এর কোম্পানিতে ছোট কর্মচারী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়।
উপায় কিঃ তোমরা যারা বিশুদ্ধি চাও, খুঁজতে থাকো ফাঁকি,
আমরা মেকি, সিউডো হওয়ার সুখেই মুগ্ধ থাকি।
মেকি’র বদনাম হওয়াটা একটি বিশুদ্ধ ভুল ছাড়া কিছু নয়। বেশীরভাগ শুদ্ধ বস্তু কোন কাজে লাগে না, তাই বাস্তবের জমিতে নিখুঁতের আশা, শুদ্ধতার বিলাস ত্যাগ করুন। মেকি হওয়াতে অগৌরবের কিছু নেই, বরং তাতে গর্ববোধ করতে পারেন। কেউ যদি আপনাকে সিউডো বলে, সে আখ্যা কর্ণের কবচ-কুন্ডলের মত সগর্বে ধারণ করুন। অশুদ্ধ না হ’লে কেজো হওয়া যায় না- এই সাধারণ বুদ্ধি আপনাতে স্থিত থাকুক। ওমর খৈয়ামকে মনে করুন…পাচ্ছ যাহা নাও বাপু রে, কান দিয়ো না স্বর্গসভার বাজনাতে যা বাজছে দূরে।।
-অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
এই যে হাওয়া সেটাও বিশুদ্ধ অক্সিজেন হলে আমাদের প্রাণসংশয় হয়। নাইট্রোজেন দরকার তাই। খুব সুন্দর লিখেছেন। ভাষা তথ্য আর তত্বের কি সুন্দর বিরিয়ানী।