ইনরম হিলস
কলমে : গালিব লেখনিওয়াল
সৌরভ গাড়ি চালাচ্ছিল।
গাড়িতে বসে :
1. সৌরড, বয়স ৪৫। গাড়িটা কর্মসূত্রে অফিস থেকে পাওয়া।
2.কাকলি, বয়স ৫০। এখনও বিয়ে হয় নি। এক নামজাদা স্কুলের ইতিহাসের দিদিমণি। ইনার নামটাই শুধু মিষ্টি, চেহারা পত্তরে লবডঙ্কা। এখন সৌরভের পাশে বসে।
3. বীথি, বয়স ৪৭। ডাকসাইটে সুন্দরী – তার কত্তা দেশের অন্য প্রান্তে কোন কনফারেন্সে গেলেও পরিচিতি পান এইভাবে যে ইনি সেই মূখার্জি সাহেব, যার স্ত্রী খুব সূন্দরী। এখন গাড়ির পেছনের সীটে।
4. দীপিকা, বয়স 23 (আন্দাজ)। কাকলির ভাইয়ের মেয়ে। থাকে দূরে, কলকাতায়। এখন কাকলিদের কাছে এসেছে কয়েকদিনের জন্য, এখানকার কলেছে অ্যাডমিশান টেস্ট দেবে। বসেছে পেছনের সীটে।
5. সুনন্দ. বয়স 24। বীথির ছেলে। গ্রাজুয়েশন সদ্য শেষ করে পরের পড়াশোনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন পেছনের সীটে।
গাড়ি চলছে বিকেলের আউটিং এ । শহরের গন্ডী ছাড়িয়ে ছোট একফালি নীচু পাহাড়ের দিকে। উঁচুনীচু রাস্তার দুপাশে কাঁটাঝোপের গাছ। মাঝখানে জনবসতি নেই ই।রাস্তায় অন্য গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। পড়ন্ত বিকেলে মদিরতা মাখানো। খালি দুজন থাকলে মনটা আপনা থেকেই গেয়ে ওঠে – আজ মদহোশ হূয়া যায় রে, শরারৎ করনে কো মন চাহে রে।
গাড়িতে কাকলি কথা বলছিল সবচেয়ে বেশী। সেটা ওর অভ্যেস।
সৌরভ দেখো তো, এই হারটা কেমন লাগছে? নতুন কিনেছি, ইমিটেশন জুয়েলারী – কাকলি সৌরভের মন পাবার চেষ্টা চালায়। কিছুদিন ধরেই এই চেষ্টা চলছে।
এই গায়ে পড়া ভাব সৌরভের ভালো লাগে না। ও আরষ্ট হয়ে থাকে, মনের ভালো না লাগাটাকে শালীনতার অভ্যেসে মুখে বলতে পারে না। এড়ানোর জন্য গাড়ি চালানোতে বেশী মনসংযোগ করে।
হাওয়াটা হালকা করতে পেছন থেকে বীথি শুরু করে, তূই এটা সিংলা জুয়েলারি থেকে নিয়েছিস, না ? ওরা খুব ভালো স্টক রাখে। কয়েকদিন আগে মিসেস খান্ডুজা ওখান থেকে একটা যা সুন্দর চোকার কিনেছে না ! সেদিন পার্টিথে পড়ে এসেছিলো। খুব এলিগ্যান্ট লাগছিলো।
প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়ায় সৌরভ মন-জোগানো মিথ্যে মতামত দেবার দায় থেকে বাঁচে। ও গাড়ির স্টিরিওটা চালায় বাঁ হাত দিয়ে। এই ফাঁকে কাকলি খালি গিয়ার নবে নিজের হাত রাখে, সৌরভের অজান্তে। স্টিরিয়োর সাথে হাতাহাতি শেষ করে গিয়ার নবে হাত রাখতে গিয়ে সৌরভ টের পায় আরেকটা হাতের স্পর্শ। ঝটিতে সরিয়ে নেয় নিজের হাত, ইন্সটিনক্টের বশে। কাকলি সশব্দে হেসে বলে, দেখলি বীথি, সৌরভ কেমন ব্লাশ করলো আমার হাত ছুঁতেই ? এ এখনও বড় পিউরিটান।
চুপচাপ ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর এই কেতাতেও সৌরভ দুরস্ত নয়। কাকলির শহুরে চালটা মাঠে মারা গেলো।
কিন্তু সৌরভের কেতাদুরস্ত না হওয়ায় কাকলির ঠাট্টার সাথে সাথে ভগবানও বোধহয় মুচকি হাসছিলেন। সকলের অলক্ষ্যে তিনি সৌরভকে অন্য কেতায় পারদর্শী করছিলেন। হয়তো বীথিকেও করছিলেন। সে কেতা ছিল মন দেয়া নেয়ার।
কাকলী আর বীথির বাবারা একই সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে সহকর্মী ছিলেন। তাই এরা দূজন ছোটোবেলা থেকেই পরিচিত। বন্ধুত্ব আর রেষারেষিও ততটাই পুরোনো।। বীথির বিয়ে হওয়া আর প্রফুল্লিত সংসার হওয়ায় আর কাকলির বিয়ে না হতে পারায় রেষারেষিটা বেড়েছে। এদের দূজনের সাথে সৌরভের পরিচয় মাত্র মাস তিনেক। কর্মসূত্রে নতুন জায়গায় কয়েক মাস আগে আসা। সেখানে কাজের সূত্র ধরেই কাকলির সাথে পরিচয়। তারপর কাকলির বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা। কিছুদিন পর কাকলিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বীথির সাথে। বোধহয় সৌরভকে নিজের ট্রফি হিসেবে দেখানোর তাগিদে। সৌরভের দিক থেকে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ ছিল না কাকলির জন্য।
কিন্তু যখন বীথির সাথে আলাপ হলো, সৌরভের মনটা নড়ে চড়ে বসলো। বীথি অনন্যসুন্দরী। তার ড্রেস-সেন্স অত্যন্ত এলিগ্যান্ট, তার দেহভঙ্গীমা (poise) থেকে একই সাথে লালিত্য আর আভিজাত্য ঝরে পড়ে, তার শাণিত কথাবার্তার disarming candour এ অবাক বিস্ময়ে হার মানে সবাই। তার উপস্থিতি আশেপাশের সবাইকে আলোড়িত করে, উদ্দীপিত করে, বীথির পরিচিতি সমাজের অনেক উঁচু মহলে।
এহেন বীথির সঙ্গে দেখা হবার পর সৌরভের মনে শুরু হলো এক নিঃশব্দ তোলপাড়। বীথির যা কিছূ দেখে তাতেই যেন মূগ্ধ হবার মতো, শেখার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে। এটা কি ভালোলাগা ? যাই হোক না কেন, এটা সৌরভের মনকে অশান্ত করে তুলেছে। এই ভালোলাগাটাকে নাতো মুখে বলা যাচ্ছে, না মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে।
কথাবার্তা নানা মোড় ঘুরে একবার লিপস্টিকে পৌঁছল। কাকলি যথারীতি নিজের ওরাকলে্ – আমি এবার রেভলনের এত নম্বরটা কিনেছি। ডিপ পার্পল কালার। কি সূন্দর কালারটা! ঠোঁটে লাগালে গ্ল্যামার মডেলদের মতো দেখায়। (তা তো দেখাবেই, নিজে কিনেছে যে !) বীথি, তুই ও কিনিস এটা। (বীথিকে subjugate করার চেষ্টা)।
বীথি দায়সারা ভাবে জবাব দিলো- আমার মনে নেই আমার কাছে ঐ রংটা আছে কিনা। আর আমি তো Dior ইউজ করি। তুই এখন বললি, ওটা কিনবো।
ব্যাস, সেই শুনে সৌরভের অবস্থা হলো কাহিল । বীথি এমনিতেই লিপস্টিক কমই ব্যবহার করে। সেটা ছাড়াই ওর চেহারার মধ্যে একটা এথেরাল অরা আসে। সৌরভের মুগ্ধ চোখে বীথিকে মাধবী মুখার্জী লাগে – গলা, পিঠ, ঘাড়, চুলের স্টাইল সব মিলিয়ে। সত্যজিতের নায়িকার মতো যার আকর্ষণটা ‘সঙ্গে’, আসঙ্গে নয়। সৌরভ এইভাবেই ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ বীথিকে ‘করেছে রচনা’। আর সে কিনা এই শাকচুন্নী রঙের লিপস্টিক লাগাবে ? এতো অ্যাস্থেটিক সেন্সের ক্যাটাসট্রফি, ডিব্যাকল্, ব্লুপার !
এখন সৌরভের সমস্যা হল কি করে এটা আটকানো যায়। ইচ্ছে তো করছে বীথিকে সামনেই বলে ফেলে যে রংটা একেবারেই ঠিক নয়, এটা কিনবেন না কিন্তু। তবে কাকলির সামনে সেটা বলা যাচ্ছে না শালীনতার খাতিরে। সৌরভ উসখুস করতে থাকলো কান বাঁচিয়ে কথাটা কি করে কথাটা বলা যায়। ড্রাইভিং এর মনঃসংযোগ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। দীপিকা আর সুনন্দ নিজেদের যৌবন-মদে মাতোয়ারা। একে অপরকে নিজের মোহজালে আবদ্ধ করতে মশগুন। পাশাপাপাশি চলতে থাকা চিত্রনাট্যের কোন আভাস পেল না ওরা।
এই ভাবেই আরো পাঁচ রকম বিষয়ে কথা বলতে বলতে ওরা এখন ফিরে আসছিলো। শহরের কাছাকাছি আসতেই জমজমাট দোকানপাট, শহুরে আলোর রোশনাই, রাস্তায় চলমান জনপ্রবাহ। কোথাও চা খেতে হবে এখন। সৌরভ মনে মনে ছক কষে, কফি খাবার প্রস্তাব পাড়ে, সারভানা ডবনের সামনে পার্কিং খুব ঘিঞ্জি। সবাই একবাক্যে সায় দেয়।
গাড়ি এসে থামে সারভানার সামনে। ইঞ্জিন বন্ধ করার আগে সৌরভ একবার পেছন ফিরে বীথির চোখে চোখ রাখে। বীথি কি পড়তে পারে সেটা ? গাড়ির দরজা আনলক হতেই প্রথমে একজোড়া যৌবন হুড়মুড়িয়ে নামে। তারপর নামে কাকলি, রাজকীয় বিলম্বিত লয়ে। বীথি মুহূর্তকাল ওর নামাটা বন্ধ রাখে, যেন কাকলির নামাকে সম্মান দিতে।
সৌরভের ছকটা কার্যকরি হয়। গাড়িতে এখন খালি সৌরভ আর বীথি। নেমে পড়া ৩ জনের উদ্দেশে সৌরভ একটু আওয়াজ উঠিয়ে বলে – আমি গাড়িটা পার্ক করে আসছি। গাড়ি 3/4 মিটার এগিয়ে যায় খালি পার্কিং লটের দিকে। আর সেই ফাঁকে সৌরভ বীথিকে বলে ফেলে এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা সেই কথাটা – ঐ লিপস্টিকটা কিন্তু আপনি কক্ষোনো কিনবেন না। ওর আওয়াজে চুঁইয়ে পড়ে এক গভীর. গোপন আবেদন, ঝরে পরে এক আর্তি।
এরপর মিনিট দুয়েক পর এরা দুজন যখন বাকিদের কাছে ফিরে আসে, বীথির চোখ প্রথমে ছুঁয়ে যায় কাকলির মিইয়ে যাওয়া মূখ। তারপর বুলিয়ে যায় সৌরভের চোখ। তখন বীথির মুখে একটা হালকা হাসি। সেই হাসি যেন চুপে চুপে, অস্ফুটে সৌরভকে বলে I could read between the lines.
(সমাপ্ত)
About the author
Ghalib Lekhniwal is an author in his pseudonym. He is a GZA member.
দাৱুনলেগেছে ,
ধন্যবাদ।
Beautiful and thrilling story..writer has great quality to compose a suspense based composition to win the hearts of readers
Thank you for your charitable words.
– Ghalib Lekhniwal
বেশ লাগলো।