অণু সন্ধান ৬
বাসুদেব গুপ্ত।

মা।

সবার একটা মা আছে। থাকতেই হবে। সবাই জানে সে কে? বাবার ঠিক নেই অনেকেরই। কিন্তু মার ঠিক নেই বলে খিস্তি করে থানার দারোগাও প্যাঁদাতে পারবে না।

অর্ক কনসালটেন্ট। স্বপ্ন ছিল সফটওয়ার করে বিল গেটস হবে। হয়ে গেছে কনসালটেন্ট। আজ মিউনিখ কাল স্টকহোলম, পরশু সিয়াটল। আপাতত ডালাসে থিতু। গ্রীন কারড হয়ে গেলে নিশ্চিন্তে। হয়ে গেল হাঁসজারু। কেমনে তা জানে না। অর্কের বয়স তিরিশ। বাবা একবছর হলো করোনার খাদ্য। মাস্ক পতাকার মত উড়িয়ে বাজারে ঘুরতেন। মা একা। রাঁধেন বাড়েন বাজার করেন। গল্প করেন ফোনে। দিব্যি আছেন। আজ এই আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসে গর্ব করে অর্ক বলতে পারে, আমার মা সুখী। আমি সন্তান হিসাবে গর্বিত। মায়ের জন্য না। নিজের জন্য। সে মনে ক’রে প্রতি মাসে মাকে ১০০ ডলার পাঠায়। কম নয়। বাড়ী ভাড়া ইনশিওরেন্স, সোশ্যাল সিকিউরিটি, লম্বা ফর্দ। রিমি আদর্শ বৌ। অভিযোগ করে না। ওর ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হয়। দেশে ইনভেস্ট করতে হয়। রিটারন ভালো। আর যদি ফিরতে হয় কোনদিন তাহলে নিশ্চিন্ত।

আজ মাতৃ দিবস। মনে করে ফেসটাইমে কল করতে ভোলে না অর্ক। অফিসে হাইব্রিড চলছে। আজ wfh করে নিয়েছে। মার এখন সকাল ছটা। ভেসে উঠল মার হাসিমুখ। মধুর আমার মায়ের হাসি। সত্যি মার দুঃখী মুখ দেখাই যায় না। গান শেখাতেন। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। কখনও আর্থিক কষ্ট বুঝতে দেন নি। সবসময় দৃপ্ত। নারীরা যে শুধুই অত্যাচারিতা নয় সেটা মাকে দেখলে বোঝা যায়। সবাই তো আর তালিবান নয়। আমরা সভ্য হয়েছি অনেকদিন।
-কেমন আছিস ওকু? সকাল সকাল?
-তুমি আমার আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসের প্রণাম গ্রহণ করো।
পিছন থেকে রিমির হাসি শোনা যায়। সে বলে,
-হাহা মা ছেলের কি ফর্মাল ডায়লগ।
হঠাৎ অর্কের খেয়াল হয় মার নামটা ও একেবারে ভুলে গেছে। বাবার নাম সর্বজিৎ। মার? সর্বজয়া? ধুত। অপর্ণা। অদ্ভুত ব্যাপার। মার নামটাই ভুলে গেছে।
তাতে কিছু যায় আসে না। মা তো মা-ই। মা একটা কনসেপ্ট। মাকে সবাই মা বলেই ডাকে। নাম মনে করার দরকারই হয় না
-কি রে চুপ হয়ে গেলি? রিমি তুমি ভালো তো? ঐ হাত ফুলে যাওয়াটা আর হয় নিতো? বেশি হাতে জোর দিও না।
রিমি কলবল করে ওঠে,
-হাতের আবার জোর কি মা? ডিশ কাপড় কাচা সবই অটোম্যাটিক। রান্না তো করি না আর। টিভি ডিনার আর লান্চে স্যান্ডউইচ।
কথা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে অর্ক বলে
-মার আবার ডাক্তারি শুরু হল। অথচ বাবাকেই কিছু পারলে না।
অর্কের মার মুখে বিব্রত ভাব ফুটে উঠতে অর্কের একটু আপসোস হল। যাই হোক আজ মাতৃ দিবস। সেসব কথা থাক।
-তোমার জন্য একটা উপহার আছে। বলতো কি মা?
-দূর আমার আবার বুড়ো বয়সে কি উপহার। তুই তোরা ভালো থাকাটাই উপহার। সামনে এলে আরো ভালো লাগত। তোর জন্য পায়েস রাঁধতাম, তুই সেই পুঁই শাকের চচচ্চড়ি কি ভাল বাসতিস। যা হোক তুই তো আর ওসব খাস না এখন। পিৎজা বার্গার এসব পছন্দ। সামনে না হোক ফোনে দেখছি। এই বেশ।
-হ্যাঁ বুঝেছি সামনে থাকলে ঝণ্ঝাট। কম জ্বালিয়েছি তোমাকে। আচ্ছা উপহারটা বলি?
-কি পুজোয় আসবি?
-না গো। পুজোয় রিমির মা বাবা ইউরোপ টুর করে এখানে থাকবে। আমি না, আমি না
এদিকে মার মুখটা স্থির হয়ে যায়। মাঝে মাঝে নেট কাটলে এমন হয়। কিন্তু ওকি! মার মাথাটা হঠাৎ গড়িয়ে পড়ে টেবিলে। নেট চলছে। মার মুখটা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান পর্দা থেকে হারিয়ে যায়।

রিমি বলে দিয়েছিল নামটা। স্বপ্না। পুরনো স্টাইল। খুব স্বপ্ন দেখতেন বোধহয়। ছেলে বড় হবে। বিদেশে থাকবে।
রিমির মা বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিডনীর সমস্যার অনেকদিন ভুগছিলেন অর্কের মা। হাসপাতালে অপারেশান করতে ৪-৫ লাখ খরচ। উনি নিজের গয়না গুলোও বেচবেন না। রিমির জন্য থাক। আরও কটা গানের টিউশানী শুরু করেছিলেন। হঠাৎ। সেপটিক শক।

মন ভালো করার জন্য ওরা দুজন নায়েগ্রা থেকে ঘুরে এল। ঐ জলরাশির প্রচন্ড ধারা সব ভুলিয়ে দেয়। আর অজস্র টিউলিপ যেন একদল শিশু হোলি খেলতে নেমে গেছে বাগানে বাগানে।

নায়েগ্রা থেকে ফিরে জানা গেল রিমি প্রেগনান্ট। মেয়ে পছন্দ ওর। মেয়ে হলে নাম দেবে টিউলিপ। বাংলা নাম আর চলে না।

আর ঘোরাটাও একরকম ফ্রি হয়ে গেল। মার জন্য অর্ক একটা মেডিকাল ইনশিওরেন্স করতে যাচ্ছিল। । সেই টাকাটা বেঁচে গেল।
মা সবসময় ছেলের কল্যাণের জন্যই বাঁচেন। মরেনও।

About Author


বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং