কচি-কাঁচাদের দুর্গা পূজো
কলমে : সমীর কুমার দাশ
কচি-কাঁচাদের দুর্গাপূজো
পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষমশ ধুসর থেকে ঘুসরতর। আবছা স্মৃতি রোমন্থনে আমরা পেয়ে যায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গ্রাম্য শিশু নিতুকে। দুচোখে অসীম কৌতুহল আর অগণন জিজ্ঞাসা নিয়ে আর পাঁচটা শিশুর মতোই তার অবচেতন থেকে চেতনে উত্তরণ এক ক্রমিক জটিল রসায়ন । দিন মাস বছরের অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করে নাকি নিঃস্বও করে? কল্পজগৎ ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কঠোর কুলিশ বাস্তবের সন্মুখীন হয়। সে তার অনুভূতি, আশা -নিরাশা , সুখ-দুঃখ , পারিপার্শ্বিক যেমন দেখে যেমন বোঝে তাই ব্যক্ত করে। জন্ম মৃত্যুর মাঝের চেতন সময়টুকু বড়ই স্বল্প। এই স্বল্পকালীন সময়ের বিক্ষিপ্ত কথকথা ।
নিতু লক্ষ করছে বাড়ির পুস্তার কাছে শিউলি গাছের পাতারা যেন বেশী সবুজ। আকাশে -বাতাসে, জলে- জঙ্গলে চাপা খুশির গন্ধ। ঝকঝকে উজ্জ্বল রোদ। সকাল – বিকেল মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া । আকাশ জোড়া ক্যানভাসে কোয়ার্টজ নীল আর সাদা মেঘের মিশেল। মাঠজোড়া ঘন সবুজ ধানের ক্ষেতে হাওয়ার ছন্দোবদ্ধ হিন্দোল । গৃহপালিত গরু ছাগলগুলো গায়ে গতরে চকচকে মসৃণ । পুকুর- দীঘির ঘোলা জল দিনে দিনে স্ফটিক স্বচ্ছ হচ্ছে। ডোবার কলমিলতার গাঁটে গাঁটে ফুল ফুটছে। দীঘির কমল বনে কমলকলি পাঁপড়ি মেলার অপেক্ষায়। ধানের ফুলে দুধ জমছে। দুধের ভারে শীষগুলো মাথা নত করে ঘোড়ামুখো হচ্ছে। গ্রীষ্ম – বর্ষার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর মানুষজনের তৃপ্তি আর প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট । তার পরিশ্রম সার্থক হবে আর কদিন পরেই ধানের মড়াই পূর্ণ হবে।
সাতসকালে বাণী হাঁফাতে হাঁফাতে এক ছুটে এসে খবর দিয়ে গেল পাল মশাই এসে গ্যাছেন। তারপর যেমন এসেছিল তেমনি দৌড়ে ওধাউ। বোধহয় অন্যান্যদের খবর দিতে। নিতুও একদৌড়ে চন্ডীমন্ডপে হাজির । বাঁওড়ু মোড়ল, বহিড়া দাদু, ফটিক দত্ত, রমাকাকা, ভবেন ঠাকুর, তুলসী সাহা, দুলু মাস্টার ইত্যাদি চন্ডীমন্ডপের দাওয়ায় গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। নিতুরা ধারেকাছে ঘেঁষতে পারছিল না। পরে জেনেছে পূজোর আয়-ব্যয়ের জটিল হিসেব ঠিক হচ্ছিল। দেবীর নামে কিছু দেবোত্তর সম্পত্তির আয় থেকেই দেবীপূজা সম্পন্ন হয়।
এরপর পরম উৎসাহে সকাল বিকেল চন্ডীমন্ডপে হাজিরা । পালমশাইকে দেখে কোনো ভক্তি-শ্রদ্ধার উদ্রেক হয় না। নেহাত্ মেঠো চেহারা । সঙ্গে নিতুর বয়সীই হবে একটা ছেলে। খালি গা, রুক্ষ চুল, রঙচটা ইজের, কোমরে ঘুনসি। কিন্ত হলে কি হবে তার মধ্যে বেশ একটা গর্বের ভাব। নিতুদের সঙ্গে ভাল করে কথাই বলতে চায়না। সে কিনা ক্ষদে শিল্পী ।
নিতু দিনর পর দিন খুঁটিয়ে লক্ষ করছে। পাটাতনের উপর বাঁশ কাঠ দিয়ে প্রতিমাগুলির প্রাণছন্দের একটা আদল তৈরী হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই কল্পিত প্রাণরেখার উপর খড়ের কাঠামো বাঁধা হচ্ছে। এরপর একমাটি দুমাটি করে করে সম্পূর্ণতা মাটি তৈরী করতেন অনেক যত্নে। মাটি দু-তিন দিন ভিজিয়ে রেখে দেওয়া হত। পাটের গোছা োটা কাঠের উপর ধারালো দা দিয়ে কুচোনো হত। ধানের তুষ পরিমাণ মতো নেওয়া হত। আর চুনের কাদা ভেজানো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে পালমশাই দুপায়ে দলতে থাকতো। একসময় মাটি কেমন পেলব হয়ে আসত।
প্রথমে একমাটি। খড়ের কাঠামোয় মাটির প্রলেপ । পালমশায়ের অনুগ্রহে কখনোসখনো সিংহের বা অসুরের কাঠামোয় মাটি দিতে পেরে নিতুর নিজেকে ধন্য মনে হোত। দোমেটের মাটি আরও পেলব আর নরম। এবার শুরু শিল্পীর হাতের জাদু। অধীত বিদ্যায় শরীরতত্ত্বের খুঁটিনাটি জানতেন বলেই এক নিখুঁত অঙ্গের রূপ দিতে পারতেন। তখনও দেবদেবী মনে হোতনা। নেহাতই মানব-মানবী
পশু পাখির পার্থিব রূপ ।
এরপর মিহি পুরানো ধুতির ন্যাকড়া মধুর মতো ঘন গিরিমাটির ঘোলায় চুবিয়ে প্রতিমার সারা অঙ্গে জড়ানো হোত। একটু টেনে এলে আবার ঘোলার প্রলেপ । এবার মাটির কাজ শেষ।
এখন রঙ তুলির কেরামতি। প্রথমে আগাপাস্তলা খড়ি মাঠির রঙের প্রলেপ। এবার ভগবতী বাসন্তী রঙে ,কার্তিক নীল ,গণেশ লাল ,লক্ষ্মী কমলা ,সরস্বতী সাদা ,মিহিষাসুর কালো ,সিংহ হলুদ ,ময়ুর নীলকন্ঠ ইত্যাদি রঙে রন্জিত হতে থাকলো। মাথাগুলো সাদাই রইল। যদিও সে জানে সেখানে যথোপযুক্ত চুল লাগানো হবে। কিন্তু নিতুর কেমন বেসুরো মনে হোত।
এবার শুরু হবে অঙ্গ সজ্জা । ঝলমলে পোষাক পরানো শেষে মায়ের দশভূজ দশপ্রহরনে শোভিত। এক চালা প্রতিমার চালচিত্র শিল্পীর তুলিতে মন্ডিত। ডকের সাজে প্রতিমা ।
সবশেষে রোমাঞ্চকর ক্ষণ । প্রতিমার চক্ষুদান। শিল্পী একাগ্রচিত্তে একে একে দেব দেবীর চক্ষু জবন্ত করে তুলছেন। কী একাগ্রতা ,কি মগ্নতা,কি মমতায় শিল্পী রুপ দিচ্ছেন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। এবার দেবী ভগবতী সাক্ষাৎ জগজ্জননী রুপে মন্ডপে বিরাজিত।
পরনে নূতন প্যান্ট জামা পূজোর কদিন নিতুর ঠাঁই হয়েছে মন্ডপে। সারাদিন পুটুস পুটুস করে বাহারি বন্দুকে টোটা ফোটাচ্ছে। পূজো মন্ডপে বারুদের গন্ধ, ধুপের সুগন্ধ , ফল বাতাসার বাস আর ফুলের সুবাস মিলেমিশে এক আশ্বর্য্য মহক। জীবনের এতগুলো বছর পার করেও সেই সুখ- বাস সে আর ফিরে পাইনি।
পূজোর কয়েকটা দিন নিয়ম করে অন্জলি দেওয়া । পুরোহিতের সুরে সুর মিলিয়ে মন্ত্রোচ্চারন এখন তার আর মনেও পড়েনা কী মন্ত্র । অষ্টমীর পূজোতে কেমন যেন গা শিরশিরে অনুভূতি । দেবতার মহিমা মন্ত্রের গরিমা ভক্তের বিশ্বাস – সব একাকার।
চারটে দিন যেন স্বপ্ন ঘোরেরমধ্যে কেটে গেলো। এবার দেবীর শ্বশুরবাড়ি প্রত্যাবর্তন – বিসর্জন । ঘট বিসর্জন হয়ে গ্যাছে। মা-কাকীমারা সিঁদুর খেলছেন। জয় মা জয় মা জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত । মা কি কাঁদছেন? নিতুর মনে হত সত্যি সত্যি মায়ের চোখে জল। আসছে বছর আবার এসো মা। তোমার তাপিত সন্তানদের বরাভয় মুদ্রায় আশ্বস্ত কোরো।
শূন্য চন্ডীমন্ডপে নিতু এখন কয়েকদিনএকাই ফিরে ফিরে আসবে আর বুকের ভিতর এক চাপা দুঃখ অনুভব করবে- কিসের দুঃখ সেও ঠিকঠাক বুঝতে পারে না।
About the author :
Samir Kumar Das holds his degree in Textile Engineering. He worked with Govt. for development of Handlooms in the country and retired from KVIC. After retirement, he now lives at Malda (W.B) and offer consultancy to handloom sector.