দাম্পত‍্য

কলমে : মনোজিৎ মজুমদার

 

অফিস টাইমের যানজট ঠেলে বাড়ি ফিরতে আটটা বেজে গেল অরুণাভর। আজ খেলা আছে। ভারতের রান তাড়া করা শুরু হয়ে গেছে। গাড়িতে বসে ছটফট করছিল। কখন বাড়িতে গিয়ে টিভি খুলে বসবে। হৈমন্তী রুটি বানানোর বেলন হাতে দরজা খুলল। অরুণাভ দরজা থেকেই তাদের উন্মুক্ত রন্ধনশালার দিকে উঁকি মেরে দেখল, রুটি বেলা চলছে। নিশ্চিন্ত হল, হৈমন্তীর মুষ্টিধৃত বস্তুটির উদ্দেশ্য রুটিই। বেলন বস্তুটির সঙ্গে কোনও কালেই প্রীতির সম্পর্ক নেই অরুণাভর। ক্রুদ্ধ গুরুজনদের হাতে পড়লে সে বস্তু কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তার সম্যক ধারণা বাল্যকালে বেশ কয়েকবার হয়েছে। হোক না হৈমন্তী তার বউ। বেলন হাতে সব মহিলাই বিপজ্জনক।

ধড়াচূড়ো ছেড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অরুণাভ টিভির সামনে বিরাজমান। হৈমন্তী সামনের টেবিলে জলের বোতল রেখে দাঁড়াল। জলের বোতল রাখাটা কি একটু জোরে হল? অরুণাভ প্রমাদ গুনল। আজ আবার নির্ঘাত কিছু আনতে ভুলে গেছে। বিকেলের দিকে হৈমন্তীর ফোন এসেছিল বটে। লাঞ্চ করেছ কিনা, বাড়ি ফিরতে দেরী হবে কিনা ইত্যাদি প্রশ্নে যন্ত্রবৎ হুঁ হুঁ করে ফোন কেটে দিয়েছিল। রোজকার জানা প্রশ্নপত্রের মাঝে নতুন কোন নির্দেশ গোঁজা ছিল কিনা এখন আকাশ পাতাল ভেবেও মনে করতে পারল না অরুণাভ। ইতিমধ্যে পছন্দের চ্যানেল টিভির পর্দায়। রোহিতের সপাট চার আর অরুণাভর সকল ভাবনা চিন্তার ইতি।

হৈমন্তী সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘গিয়েছিলে?’ বাউন্সারের আগে সোজা বল। অরুণাভ দ্বিধান্বিত, রান নেওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছে। ‘কি হল, গিয়েছিলে?’ হৈমন্তী এবার একটু অধৈর্য।
‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো। ছিল না।‘ রান আউট হওয়ার সম্ভাবনা একশো ভাগ জেনেও অরুণাভ ক্রিজ্ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। অতশত ভেবেই বা কি লাভ? হৈমন্তীর সঙ্গে বাগযুদ্ধে তো গত তেইশ বছর ধরে প্রতিদিনই দু-তিনবার রান আউট হয়ে আসছে।
হৈমন্তী মধুমাখা গলায় শুধোল, ‘তাই! কে ছিল না গো?’
‘আরে ঐ তো, যার কাছে গিয়েছিলাম’ অরুণাভ কোনও ভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল।
‘তা সেটি কে? কার কাছে গিয়েছিলে আর কে ছিল না?’ হৈমন্তীর গলা চড়ছে।
অরুণাভ শেষ চেষ্টা করল, ‘ঐ যে তুমি বললে, রান্নাঘরের গিজারটা খারাপ হয়েছে। তো দোকানের লোকটাকে কাল মিস্ত্রি পাঠানোর কথা বলতে গিয়েছিলাম।‘
হৈমন্তী এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলল, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি ভীমরতি ধরেছে? গিজারের কথা আগের সপ্তাহে বলেছিলাম। দোকান থেকে লোক এসে সারিয়ে গেছে দু দিন আগেই। কতবার বললাম, ডাক্তারখানায় বলে রাখা আছে, আমার হোমিওপ্যাথি ওষুধগুলো নিয়ে এস। ওরা তৈরী রাখবে বলেছে।‘
তাই তো। হৈমন্তী বলেছিল বটে। তবে অরুণাভ হতোদ্যম হল না। হৈমন্তীর মুখনিঃসৃত অমৃতবাণীর নিশ্ছিদ্র প্রাকারে দুর্লভ ফাটল চোখে পড়ল। গলাটা একটু চড়িয়ে সাহস করে বলে ফেলল, ‘কতবার কোথায়? একবারই তো বলেছ।‘
হৈমন্তী গলা সপ্তমে রেখেই জবাব দিল, ‘যাক, আজ অন্ততঃ স্বীকার করলে বলেছি। আর একবারের বেশি বলার সুযোগ দাও?’

কাল রবিবার। ডাক্তারখানা বন্ধ থাকবে। এদিকে সকালে লুচি আর দুপুরে পাঁঠার মাংসের প্রস্তাব হৈমন্তীকে বেশ একটু আদুরে গলায় দেবে বলে ভেবে রেখেছিল অরুণাভ। পরিস্থিতি যেরকম ঘোরালো হয়ে উঠেছে, তাতে রবিবাসরীয় লুচিমাংসভোগে ভোগান্তির সম্ভাবনা সুস্পষ্ট। অরুণাভ দমে গেল না। অমৃতমন্থন করতে গেলে গরল তো উঠবেই।
অরুণাভ অজুহাত মাখানো মোলায়েম গলায় বলল, ‘একটা জরুরী মিটিং-এ এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, কাজ মিটিয়ে বেরোতে বড্ড দেরী হয়ে গেল। তোমাকে মেসেজ করেছিলাম তো।‘
হৈমন্তীর অলিখিত হুকুম, বাড়ি ফিরতে দেরী হলে জানাতে হবে। অরুণাভর পাঠানো ‘আজ ফিরতে দেরী হবে’ সমাচারটি প্রায় প্রতিদিনই ভরসন্ধ্যায় হৈমন্তীর মোবাইলে হানা দেয়। নিতান্তই মামুলি প্রায় প্রতিদিনের পুণরাবৃত্ত মোবাইল প্রেষিত সমাচারটি মোক্ষম সময়ে কাজে লাগাতে পেরে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াল অরুণাভ।
হৈমন্তী গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ফেরত গেল। রুটি বেলা আর গজগজানি যুগপত চলছে। অরুণাভ একবার আড়চোখে হৈমন্তীর মুখভাব পর্যবেক্ষণ করে টিভির পর্দায় মন দিল। না, স্ত্রীর মুখ দেখে মনের ভাব বিচার করবে, এতটা নিরেট অরুণাভ নয়। সে সঠিক সময়ের প্রতীক্ষায় রইল।

রাতে খাবার টেবিলে অরুণাভ পরদিনের লুচিমাংসের প্রস্তাব পেশ করতেই হৈমন্তী রে রে করে উঠল, ‘লজ্জা করে না? নিজের ভুঁড়িটা দেখেছ? সেদিন গুলাটিদের সামনে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে।‘
অরুণাভ রুটির পরিবর্তে গুলাটির মুণ্ডু চিবোতে পারলে খুশি হতো। সেদিন কি কুক্ষণেই যে সান্ধ্যভ্রমণরত গুলাটি পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গুলাটি খর্বকায় ব্যক্তি। ঈর্ষণীয় সম্পত্তি ও পিপেসদৃশ মধ্যপ্রদেশের মালিক। তার জামার বোতাম লাগাতে বাড়ির লোকেরা হিমসিম খায়। বোতাম যদিও বা লাগানো যায়, পিপের বিপুল চাপে নাইকুণ্ডটি অচিরেই দৃশ্যমান হয়ে তৃতীয় নয়নের মতো পিটপিট করতে থাকে। অবিরাম বোতাম লাগানো আর বোতাম সেলাই – শেষমেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পুত্র কন্যা মায় গুলাটি গিন্নি পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করায় আজকাল জামার বদলে টি-শার্ট পরে গুলাটি। তাতেও জনসমক্ষে ভুঁড়ির উঁকিঝুঁকি মারা বন্ধ করা যায় নি। ক’দিন আগে কোনও এক আগমার্কা হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছে গুলাটি পরিবার। ডাক্তারের ওজন কমানোর নিদানে গুলাটি গিন্নি যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ। সকাল সন্ধ্যা হাঁসফাঁস হাঁটাহাটি না হয় মেনে নেওয়া গেল, তা বলে বাড়ির সামান্য খাওয়াটুকুতেও শত বাধানিষেধ! ওই তো মাত্র কয়েক পাত্র তরল আর অল্প কিছু ভাজাভুজি দিয়েই সকাল সন্ধ্যা কাটাতে হয় বেচারা গুলাটিকে। রাতেই যা একটু ভালমন্দ খাওয়া। সেটাতেও কিনা নিয়ন্ত্রণ। আগে এক কিলো ঘি শেষ হতে এক সপ্তাহ লাগত। এখন দু সপ্তাহেও শেষ হচ্ছে না। গুলাটি গিন্নির আক্ষেপের শেষ নেই।

সেই গুলাটি দিন দুই আগে অরুণাভর ঢলঢলে পাঞ্জাবির নীচে অস্পষ্ট আভাসমান নোয়াপাতির দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ কটাক্ষ করে হৈমন্তীকে বলেছিল, ‘লাগতা হ্যায়, আজকাল আপ দাদাকি কুছ যাদা হি খয়াল রখ্ রহে হ্যাঁয় ভাভী।‘ অরুণাভর গা-পিত্তি জ্বলছিল। নিজের ভুঁড়ির প্রায়শ্চিত্ত করছিস কর না, অন্যের ইয়েতে নজর কেন? হৈমন্তীও সুযোগ বুঝে তার পতিদেবটি কতটা পেটুক আর তাঁর খাইখাইপনা সামলাতে তাকে কতটা হ্যাপা পোয়াতে হয়, সেসব তার বঙ্গীয় হিন্দিতে সাতকাহন করে বলেছিল, ‘দেখিয়ে না ভাইসাব, ইস্ সে বড়া পেটুক ম্যায় তো জিন্দগি মে নহী দেখি। যব ভি দেখো, খাঁউখাঁউ করতা হ্যায়।‘ অরুণাভ পাশ থেকে ফুট কেটেছিল, ‘হাঁউমাউটা বাদ দিলে কেন?’ হৈমন্তীর সাতকাহন গুলাটির কতটা বোধগম্য হয়েছিল কে জানে, তবে সে হৈমন্তীর ‘মিঠি বোলি’র বিস্তর প্রশংসা করে বিদায় নিয়েছিল। অরুণাভও নিজের আর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের জনে জনে ফোন করে হৈমন্তীর উদ্ভূত হিন্দি শব্দাবলির সুবিশেষ গুণগান করে বদলা নিয়েছিল। এমন সুযোগ তো আর বারংবার আসে না।

আজ খাবার টেবিলে ভুঁড়ির খোঁটা চুপচাপ হজম করে যাবে?ডিম তড়কা মাখানো রুটির টুকরো চিবুতে চিবুতে ভাবছে অরুণাভ। হৈমন্তীর হাতের তড়কা খুবই প্রিয় তার। হৈমন্তীও তার পতিদেবটির জন্য যত্ন করে রান্না করে। অরুণাভ বিশুদ্ধ আমিষাশী। তার জন্য তড়কা বানালে ডিম বা মাংসের টুকরো দেবেই হৈমন্তী। নিজে খুব একটা পছন্দ না করলেও। অরুণাভ ভাবছে, রবিবাসরীয় ভুঁড়িভোজের আশায় কার্যত জল ঢেলে দিয়েছে হৈমন্তী। সেদিনের বদলা নিচ্ছে না কি? তাহলে একটু খোঁচাখুঁচি করাই যেতে পারে। অরুণাভ সরু গলায় বলল, ‘আমার ইয়ের চিন্তা না করে নিজেরটা দেখ। দিন দিন যা মুটোচ্ছ! তোমার জন্য তো বইয়ের দোকানে যাওয়াই ছেড়ে দিতে হল।’ ঘটনাটা বছর খানেক আগের। কোনও এক পাক্ষিক পত্রিকার একটি সংখ্যার বিষয়বস্তু ছিল ‘রোগা হওয়ার সহজ উপায়’। হৈমন্তী তার জনৈক শুভানুধ্যায়ীর কল্যাণে বিষয়টি অবগত হয় মাসখানেক পরে। তার দিন দুই পরে অরুণাভকে বগলদাবা করে হৈমন্তী পাড়ার মোড়ের বইয়ের দোকানে হাজির হয়ে আকুলভাবে পত্রিকাটির খোঁজ করতে থাকে, ‘ভাই, এটার আগের আগের সংখ্যাটা পাওয়া যাবে?’ স্বাভাবিক ভাবেই মলাটের বিষয়বস্তু উহ্য রেখেছিল। দোকানের অল্পবয়সী ছেলেটি হৈমন্তীকে এক ঝলক দেখে বলেছিল, ‘আপনি যে সংখ্যাটি খুঁজছেন, সেটি অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে।’ হৈমন্তী অপ্রস্তুত মুখ দেখে সেদিন অরুণাভ মনে মনে উৎফুল্ল হলেও সেটি প্রকাশ করে অযথা নিজের বিপদ ডাকেনি। অরুণাভ আজ বেশ রসিয়ে রসিয়ে সেকথা স্মরণ করল। হৈমন্তীও অরুণাভর ক্রমবর্ধমান মধ্যপ্রদেশ, বিপুল নাসিকা গর্জন, কুম্ভকর্ণ সদৃশ নিদ্রা ইত্যাদি ইত্যাদি সুগুণের চর্চা করতে করতে রাত্রের আহার শেষ করল। অরুণাভ বৈরাগীর মতো মুখ করে অফিসের কাগজপত্র নিয়ে বসল। পরশু সে এক সপ্তাহের জন্য সরকারি কাজে বাইরে যাবে।

রবিবার অনেক বেলা পর্যন্ত অরুণাভ নিদ্রাদেবীর বশে থাকে। সেদিন তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বাজারে পাঠাতে হৈমন্তীকে বিস্তর চেঁচামেচি ও কসরত করতে হয়। অনেকটা ভূত তাড়ানো ওঝার মতো। আজও একপ্রস্থ হুড়যুদ্ধ করে অরুণাভকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হৈমন্তী বলল, ‘যাও, মাংসটা তাড়াতাড়ি নিয়ে এস। একগাদা এনো না আবার। তুমি কাল থেকে থাকবে না। আমি একা একা এত মাংস গিলতে পারব না।’

মাংসের কথায় অরুণাভ নড়েচড়ে উঠল। ঠিক শুনেছে তো? দেখল বেলা হয়েছে। কটা বাজবে? দশটা না কি আরও বেশী? ছুটির দিনে সময়ের হিসেব না রাখা অরুণাভর বিলাসিতা। দেখল, ঘরদোর তকতকে হয়ে রয়েছে। হৈমন্তীর স্নান সারা। খোলা চুলে সে হাতে বাজারের ছোটখাটো ফর্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজও তেমন তিড়িক্ষি লাগছে না। বেশ একটা যুদ্ধবিরতি যুদ্ধবিরতি বাতাবরণ। অরুণাভ আর বিলম্ব না করে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ল।

জলখাবারে কালো জিরে আর গোলমরিচে মাখামাখি আলু চচ্চড়ি দিয়ে ফুলকো সাদা লুচি আর দুপুরে অমৃতবৎ পাঁঠার ঝোল আর ভাত, শেষ পাতে মিষ্টি দই। এর পরেও জেগে থেকে শরীরকে কষ্ট দেওয়া যাদের সাজে, অরুণাভ তাদের দলে নয়। সন্ধ্যায় হৈমন্তী অরুণাভর ব্যাগ গুছোতে বসল। অরুণাভ চেয়ারে গা এলিয়ে অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিজের ব্যাগ নিজে শেষ কবে গুছিয়েছে, মনেই করতে পারে না সে। একবার বলল, ‘চিরুনি দিতে ভুলো না যেন। সেবার যা কাণ্ড করেছিলে। সকালে চুল না আঁচরেই কনফারেন্সে যেতে হল। পাগল ভেবে তো প্রথমে ঢুকতেই দিচ্ছিল না।’ ঘটনাটা চার পাঁচ বছর আগের। সুযোগ পেলেই অরুণাভ সেইটির কথা হৈমন্তীকে মনে করায়। হৈমন্তী যেমন অরুণাভর গত তেইশ বছরের তেইশ হাজার অপকর্মের কথা দিনক্ষণ নির্ভুল উল্লেখ করে অক্লেশে বলে দিতে পারে, অরুণাভ তা পারে কই? ঐ দু একটিই তার সম্ভার। সেগুলিকেই সুযোগ সময় মত পুণর্ব্যবহার করে।
হৈমন্তী বলল, ‘তোমার চেহারাতেই পাগল পাগল ছাপ। হাজারটা চিরুনিতেও সে দূর হওয়ার নয়’।
অরুণাভ বলল, ‘তোমার সঙ্গে এতদিন থাকলে যে কেউই পাগল হয়ে যাবে। আমি তো কোন ছাড়?’
অতঃপর অরুণাভ যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পাগল তা প্রতিপন্ন করে এবং আর কখনও সে মরে গেলেও অরুণাভর ব্যাগ গুছিয়ে দেবে না, এমন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে হৈমন্তী ব্যাগ গোছানো নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করল।

এক সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরেছে অরুণাভ। এই কয়দিন দূরভাষেই তার খাওয়াদাওয়া আর কখন কি জামাকাপড় পরবে, সে ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিয়েছে হৈমন্তী। জলখাবারে রোজ ডিম খাবার দরকার নেই, একটার বেশি ডিম খাবে না, মাটন খাবে না একদম – কি না কি আজেবাজে দেবে, ফলটা বেশি করে খাবে, এই জামার সাথে লাল টাই, ওটার সাথে নীল, রাত জেগে টিভিতে সিনেমা দেখবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অরুণাভ বাধ্য বরের মতো হুঁ হাঁ করেছে। ধড়াচূড়ো ছেড়ে এসে অরুণাভ দেখল চা প্রস্তুত। সঙ্গে তার প্রিয় বেগুনি। অরুণাভ জিজ্ঞাসা করল, ‘একা একা ক’দিন কেমন কাটালে? তোমাকে এমন শুকনো লাগছে কেন বল তো? খাওয়াদাওয়া কর নি ঠিক করে?’
হৈমন্তী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কি জানি কি হয়েছে! ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। মাথাটা সারাক্ষণ ভার হয়ে আছে।’
অরুণাভ বেগুনিতে এক কামড় দিয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আঃ, জিভটা এতদিনে একটু আরাম পেল। বাঙালির কি আর রোজ বিরিয়ানি কাবাব সয়?’
হৈমন্তী চোখ বড় করে বলল, ‘রোজ বিরিয়ানি কাবাব? ফোনে রোজ মিথ্যে বলতে আমায়? পেট পুরে পাঁঠার মাংস খাইয়ে পাঠালাম। যাতে লোকটা বাইরে গিয়ে উল্টোপাল্টা না খায়। আর উনি কিনা রোজ কাবাব বিরিয়ানি সাঁটিয়ে এলেন। হ্যাংলা পেটুক কোথাকার।’
অরুণাভ আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করল, ‘আহা, রোজ কি আর ইয়ে টিয়ে খেতাম। ওটা তো কথার কথা।’ হৈমন্তীর বাক্যস্রোতে তা হাবুডুবু খেতে খেতে হারিয়ে গেল। অরুণাভ অগত্যা বেগুনিতেই মনোনিবেশ করল। চা পর্ব শেষ হলে হৈমন্তী চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘জান, মাথা ভার ভার ভাবটা আর নেই।’
অরুণাভ খুশি হয়ে বলল, ‘তাই বুঝি?’
হৈমন্তী অরুণাভর কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘হ্যাঁ গো। তোমার উপর চেঁচামেচি করতেই মাথাটা হাল্কা হয়ে গেল। সাত দিন কথা না বলে কি থাকা যায় বল?’
অরুণাভ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, কাজের লোকজন কি ছুটি নিয়েছিল?’
হৈমন্তী আদুরে গলায় বলল, ‘আহা, ওরা তো বাইরের লোক। ওদের সঙ্গে শুধুই কাজের কথা। কারণে অকারণে কি ওদের উপর চেঁচামেচি করা যায়?’
অরুণাভ, তার ও হৈমন্তীর দাম্পত্যের নাতিচঞ্চল সরোবরে প্রস্ফুটিত অদৃশ্য পদ্মটির দিকে কিছুক্ষণ তৃপ্তভাবে তাকিয়ে রইল। তারপর হৈমন্তীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ রাতের মেনু কি গো?’
হৈমন্তী অরুণাভর পেটে আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, ‘হ্যাংলাকুটে।’

 

About the author

Monojit Majumdar, age about 55 years, works with a nationalised bank. He now lives at Delhi.