অণুসন্ধান ৯
পাস ফেল।
-বাবা পুষ্কর একটু মিষ্টির দোকান দেখলে বলবে কিন্তু। না না বড় এসি দোকান নয়, পাড়ার দোকান। একটু দানাদার কিনবো। বৌদিমণির ছেলে খুব খেতে ভালোবাসে। বাড়ীতে তো খেতে দেয় না। আমাকে দিয়ে চুপিচুপি আনায়, দুপুর বেলা অংক করতে করতে।
-বাঃ আমার জন্য কিছু কিনবে না! আমিও পান্তুয়া খাবো।
-তা এখন পারিস বাবা। পরীক্ষার সময় গোল গোল জিনিষ খেতে বারণ করতাম। অশুভ তো? এখন ভালোয় ভালোয় চুকে বুকে গেছে । খা যত খুশি। কিনে দেবো। দানাদারের দোকানেই পান্তুয়া পেয়ে যাবো ঠিক।
-তুমি না মা একেবারে পুরনো কালের।
-কে বলল? মোবাইল ধরতে পারি। ফোন করতে পারি। হোয়াটসাপে কত ছবি আসে কোথায় কোথায় খুনোখুনি রাস্তা অবরোধ করছে ওরা। অত্যেচার করছে মোছলমানরা সব দেখতে পারি। হ্যাঁ রে হোয়াটসাপটা কি চীন দেশের সাপ? আমাদের গাঁ গন্জে তো শুনিনি।
-কি জানি। আমি তো জীববিজ্ঞানে পেয়েছি ৪২ নম্বর। সাপের কি জানি! ঐ কেউটে গোখরোর কোন জাত হবে।
-যা নম্বর পেয়েছিস তাই বেশ। তোর কি আর পাঁচটা মাস্টার ছিলো। না কোচিংএ ভর্তি করতে পারি আমরা? পাস তো করেছিস খেটে খুটে। আমাদের বংশে প্রথম একটা পাস।
-থার্ড ডিভিশন। মলয় স্যারকে বলেছিলাম আমি কোচিংএ এককোণে বসে থেকে শুধু শুনবো। এমন ঝাড় দিলো।
– ছি স্যারকে অমন ভাষা বলে? গুরুজন না? আর তুই কি তোর বাবার মত মুখ্যু? বাক্যি ঠিক কর।
ট্রেন থামে বালীগন্জ স্টেশনে। লক্ষীকান্তপুর লোকাল। সকাল চারটে থেকেই কাজের লোকের ভীড়। ফ্ল্যাটবাড়ীতে ভরে গেছে বাইপাস। সেখানকার মানুষজন শিক্ষিত। দেশ ও দশের ভালো ভালো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই সুন্দরবন অঞ্চল থেকে সাপ্লাই হয় কাজের লোকের। পুষ্করের মা ছটা বাড়ীতে কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধে। আসল নামটা আর মনে নেই। পুষ্করের মা বলেই চেনে সবাই। এমন একটা জব্বর নাম ওর জ্যাঠার দেওয়া। তিনি ছিলেন সাধু। ছোটবেলায় দুর্ভিক্ষের সময় বেচে দিয়েছিল তার বাপ। কিভাবে সে সাধু হল কেউ জানে না। কিন্তু দু তিন বছর পরে পরে আসতো যখন পাড়ার মেয়ে মানুষ বুড়ো বুড়ি ঝামড়ে পড়তো ধম্মকথা শুনতে। কিরকম মন্ত্রীদের মত হিন্দী বলত। রংটাও ছিল টকটকে। পুষ্করের রংটাও ওরকম। ভাইগুলো কালো কিটকিটে। তো সেই তিনিই আকাশের তারা গুনে নাম দিয়েছিল পুষ্কর।
দোকান পাওয়া গেল। মা কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার। দশটা দানাদার আর চারটে পান্তুয়া কিনে বীরদর্পে পুষ্করের মা তার মালকিনের সংগে দেখা করতে যাচ্ছে। পা ছুঁয়ে একটু প্রণাম আর একটু আশীর্বাদ । যদি কাজ টাজের কিছু ব্যবস্থা হয়। মালিক মদনবাবু সরকারী অফসর। কি ট্যাক্স না কিসের। অনেক গুলো বাড়ী হোটেল চালান দীঘা পুরী আরো কোথায় কোথায় সব।
আর মিষ্টু মানে অর্চিমানকে দেবে দানাদার। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে ওকে। একসময় রোজ বিকেলে পার্কে নিয়ে যাবার কাজটা ছিল পুষ্করের মার। পুষ্করের বয়সী। সেও মাধ্যমিক দিয়েছে। খুব পড়াশোনা করত রাত জেগে জেগে। চোখে কালি পড়ে গিয়েছিল পরীক্ষার আগে। বলত মাসী এক থেকে দশ হবোই। দেখে নিও।
যেন নিজেরই আর এক ছেলে। ভেবেই জিভ কাটে। ছি ছি এটা ভাবা ঠিক হয় নি। আজ পুষ্কর মাধ্যমিক পাস করেছে বলে আমরা কি বড়লোক হয়ে গেছি না কি। তবু মিষ্টুকে দেখলেই ওর মনে বাৎসল্য দেখা দেয়। এটা কিছুটা গরীব মানুষের আদিখ্যেতাও বটে। যাই হোক গরীবদের বেশি লোভ করতে নেই। ছেলেটা পাস করলো তো সংসারটা চলছে বলেই। আর সংসারটা চলছে মালিকের মাইনেতেই। শনিঠাকুরের মন্দির রাস্তার ঠিক কোণায়। সকাল থেকেই ভীড়। পুষ্করের মার হাত দুটো কপালে উঠে আসে। পুষ্কর মুচকি হাসে।
পুষ্করের মা আর পুষ্কর মদনবাবুর আড়াই হাজার স্কোয়ার ফুটের ডবল ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সে ঢুকতেই রাস্তা আটকালো পুলিস।
-কোথায় যাবে? কোন ফ্ল্যাট। একজন চটপটে চশমা পরা পুলিশ অফিসার লাঠি উঁচিয়ে প্রশ্ন করে।
-সি ৫০৭। মদন সরকার। কেন কি হয়েছে?
-এখন দাঁড়াও। বাইরের লোক কেউ যাবে না ভিতরে।
উঁকি দিয়ে দেখে লিফটে ওঠার সামনে প্রচুর ভীড়। বেশ কজন পুলিস, একটা সাদা ঝকঝকে পুলিশের সুইফট গাড়ী।
-ভিতরে এখন যাওয়া যাবে না। কেস ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত। একটা সুইসাইড কেস।
-সুইসাইড? কে? কোন ফ্ল্যাট? আবার কোন টিভি দিদিমণি ?
পরপর চারদিন চারজন টিভি সিরিয়ালের সংগে যুক্ত চার তরুণী সুইসাইড করেছে। চ্যানেলে চ্যানেলে জমিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কারো মনে তেমন দাগ কাটে নি। সিরিয়ালের সিরিয়াল কিলারের থেকে রগরগে না হলে আর মাথায় নেয় না আজকাল।
-কি হলো মা ঢুকতে দেবে না? পুষ্কর অধৈর্য হতে থাকে। খিদেও পেয়েছে।
– পান্তুয়া গুলো খাই?
– তোর খালি খাই খাই। পেননাম করে তারপর খাস।
সেইসময় একটা এমবুলেন্স এসে ঢোকে। পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, আর এমবুলেন্স কি করবে?
জিভ বেরিয়ে গেছে শালা।
-ছোট ছেলে নাকি। গলায় দড়ি দিতে গেল কেন? পেম টেম কেস ?
-না না। পরীক্ষার কেস।
পুষ্করের মার কান শক্ত হয়ে ওঠে। সে ঘুরে দেখে সিকিউরিটির দুজন খৈনি টিপতে টিপতে বকবক করছে।
ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে,
-কোন ফ্ল্যাট?
-সি ৫০৭। ছেলেটা নাকি ৫ নম্বরের জন্য এক থেকে দশে আসে নি। তাই বাবা মা ঝেড়েছে খুব। ব্যাস ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছে।
-কি বলছ তোমরা? ঐ ফেলাটে তো আমি কাজ করি। ওখানে তো একটাই ছেলে। মিষ্টু। একটা জান্তব আর্তনাদ বেরোয় ওর গলায়-
-হ্যাঁ রে বাবা ঐ। আজকাল সূসাইড তো জলভাত। বক্তা থু খু করে খৈনী চিবিয়ে ফেলে দেয়।
হাতের আঙ্গুল কেমন অসাড় হয়ে আসে। মাথাটা ঘুরে যায়। দানাদারের ঠোঙাটা গড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। একটা কুকুর এসে চটপট সেটা খেতে শুরু করে। দুটো কাক একটু দূর থেকে তাকিয়ে থাকে সুযোগের জন্য।
পুষ্কর হাতে পান্তুয়া নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে না খাওয়াটা উচিত হবে কি না।
About Author
বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং
স্তব্ধ করে দেবার মত গল্প।