দেবাশীষের দিল্লীতে পোষ্টিং হবার পর মামাজি ওকে শক্ত করে ধরে বসলেন – আমাকে একবার বাংলাদেশে নিয়ে যেতেই হবে।

মামাজি গত 50 বছর ধরে দিল্লী প্রবাসী। সেখানেই পুরো চাকরী জীবন, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, তাদের বিয়ে থাওয়া, সেখানেই বাড়ি বানিয়ে অবসর জীবন যাপন। গত পাঁচ বছর থেকে মামাজি দেবাশীষকে বলে আসছেন।
– চলো না, একবার বাংলাদেশটা ঘুরে আসি। আমাদের গ্রামটা দেখার খুব ইচ্ছে। সেই বাড়ি, সেই স্কুল ! কাবুলকে (মামাজির ছেলে) বললে ওতো শোনেই না। তুমিই নিয়ে চলো না।

যত দিন বাইরে পোষ্টিং ছিলো দেবাশীষ হচ্ছে হবে বলে কাটিয়ে আসছিল। এবার দিল্লীতে এসে আর নিস্তার পাচ্ছে না। মামাজিকে আটকাতে ও কয়েকটা বাউন্সার ছাড়ল –
– মামাজি, গ্রামের বাড়ি দেখবেন তো বলছেন, কিন্তু যাবার রূট কি জানা আছে আপনার ? ঢাকা থেকে সেই গ্রামে যেতে ট্রেন বাস কি পাওয়া যায় জানেন কিছু ? ওখানে থাকার জন‍্য হোটেল জাতিয় কিছুর খবর আছে ? রাত্তিরগুলো তো কাটাতে হবে কোথাও ?

উত্তরে মামাজি তাঁর 60 বছরের পুরোনো GK ছাড়লেন : কেন, সান্তাহার স্টেশনে নেমে চলে যাবো। ওখান থেকে আমাদের গ্রাম তো কাছেই।

ব‍্যাস, আর কি। সমাধান তো হয়েই গেল।
কিন্তু সেই সান্তাহারে পৌঁছনোর জন‍্য যে ট্রেন কখন কোথা থেকে ধরতে হবে, সেখানে নেমে লাগেজ নিয়ে গ্রাম অবদি যাবার জন‍্য ট‍্যাক্সি পাওয়া যাবে না গরুর গাড়ি, গ্রামে গিয়ে কোথায় রাতে থাকা হবে – সে সব চিন্তা মামাজীর পক্ষে বাতুলতা। বুড়ো হলে কিছূ প্রিভিলেজ আপনিই চলে আসে। যেমন ইমোশনাল ব্ল‍্যাকমেলিং। বুড়োরা বলেই খালাস। ঝামেলা অন‍্যেরা বইবে। আহা, বুড়ো মানুষ একটা সাধ করেছেন। পূরণ করার দায়িত্ব তো কমবয়েসীদেরই না ?

সে যা হোক, এরপর বাধা-বিপত্তির এক লম্বা সিরিয়াল পেরিয়ে, দেবাশীষের অফিসিয়াল পোজিশনকে অনেক দূর অবদি কাজে লাগিয়ে, শেষ মেষ একটা আইটিনারি দাঁড় করানো গেলো।

প্লেন, ট্রেন ও গাড়িতে মালদার কাছে ছোট সোনা মসজিদ বর্ডারে পৌঁছনো। পথে পাটনায় কারো বাড়িতে ডিনার, পরের দিন মালদায় কারো বাড়িতে লাঞ্চ। দু জায়গাতেই পরিচিতি শুধু অফিস-সূত্রে। তারপর বর্ডারে পৌঁছে এপারের চেক পোস্ট। এই অবদি দেবাশীষের অফিসের এক এসকর্ট সাথে থাকবে। তারপর সীমানার কাঁটাতার হেঁটে পেরিয়ে ওপারে গাড়ি রাখা থাকবে যেটা ওদের সাথেই পুরো চার পাঁচ দিন থাকবে। চেক ইন করা হবে রাজশাহীর এক মোটেলে, যেটার খোঁজ নেট-এ পাওয়া গেছে। রাজশাহী থেকে মামাজির গ্রাম খুব একটা দূরে হবে না। গ্রামে থাকার জায়গা না পাওয়া গেলেও রাজশাহী থেকেই এক দু দিন রোজ আসা যাওয়া করা যাবে। এরকম ঠিক করেই দেবাশীষরা নির্দিষ্ট দিনে দিল্লী থেকে বেরিয়ে পড়লো।

প্রথম দিন বেলা দুটো নাগাদ দিল্লী থেকে ফ্লাইট ধরে ওপরের আইটিনারির সমুদ্র পেরিয়ে রাজশাহীর মোটেলে যখন পৌঁছলো তখন পরের দিনের পড়ন্ত বিকেল। এবার রাতটা এখানে থেকে পরের দিন সকালে সেই গ্রামে যাবার অভিযানে নামতে হবে।

জানা গেল যে জায়গাগুলোর অ‍্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেট আপটা এই রকম : রাজশাহী (ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার ) > মহাদেবপুর (সাব-ডিভিশনাল টাউন) > খাজুর (গ্রাম)। এদের শেষ গন্তব‍্য খাজূর গ্রাম। রাজশাহী থেকে মহাদেবপুর আড়াই ঘন্টা, ওখান থেকে খাজুর আরও আধ ঘন্টা। সঙ্গে গাড়ি থাকায় মনে হচ্ছে না কাল কোন অসুবিধে হবে পৌঁছতে। গিয়ে, থাকার জোগাড় না হলে আবার রাজশাহীতেই ফিরে আসা। এখানে তো হোটেল থাকলোই।

কিন্তু মামাজি রাজশাহী পৌঁছে বোধহয় নিজের ক্রিজ খুঁজে পেলেন। বনে গেলেন ধোনি। ধূঁয়াধার ব‍্যাটিং শুরু করলেন, দেবাষীশের প্ল‍্যানকে নস‍্যাৎ করে :
– দেবু, শোন। আমি ছোটবেলায় এই রাজশাহীতে সাগর পাড়ায় একজনের বাড়িতে আসতাম। তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। চলো, এখন সেখানে যাই।

দেবাশীষ বেশ বিরক্ত হলো। অচেনা শহরে এসে ষাট বছর আগের জানা কোন বাড়ি এখন খুঁজে বের করা ! কোন যোগাযোগ নেই, কোন ঠিকানা জানা নেই, কোন লোকের নাম ভালো করে জানা নেই। জানার মধ‍্যে মামার সেই সময়কার তিন বন্ধুর কেবল ডাকনাম – ননী, মাখন আর ছানা। আর তাদের বোন ক্ষীরো। এদের বাবার নাম কি গোপাল ছিলো? মিষ্টি মন্ডার বাজার লাগিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে। কিন্তু এই বিবরণ নিয়ে আজকের দিনে তাদের খুঁজতে গেলে লোকে হাসবে। দেবু ভেবে পাচ্ছিলো না মামার নবতম বাউন্সারকে কি ভাবে এড়াবে।

কিন্তু ভগবান মুচকি হেসে ব‍্যপার গুলোর সমাধান যথাযথ জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। দেবাশীষ ব‍্যাজার মুখে একটা লূজিং ব‍্যাটল ডিফেন্ড করতে মামাজিকে নিয়ে সাগর পাড়া খুঁজতে বেরোলো, সেখানে এক সহৃদয় পরিবারের দেখা মিললো যিনি খাজুরের (মামাদের গ্রাম) মেয়ে, মামাজি তাদের সাথে গভীর আলাপে মত্ত হয়ে গেলেন, তাঁরাই অযাচিত ভাবে দেবূদের থাকার ব‍্যবস্থা মহাদেবপুরে (গ্রামের কাছের সাব-ডিভিসনাল টাউনে) করে দিলেন মোবাইলে যোগাযোগ করে। সেই জায়গা থেকে মামাদের গ্রাম খালি পনেরো মিনিটের রাস্তা, নদীটা পেরোলেই ওপারে। শূভানাল্লা।

সেই মতো পরের দিন দেবুরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে আড়াই ঘন্টায় এসে পৌঁছলো মহাদবপুর – সেই অপরিচিত পরিবারে। এতক্ষণ অবদি ছিল যাত্রার বিবরণ। এখন আমরা ঢুকতে যাচ্ছি অষ্টম বাটির আদরের প্রসঙ্গে।

মহাদেবপুরে যাঁদের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করা হলো তাঁর নাম পুতুল। তিনিও খাজুরের মেয়ে, মামাজির থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। মামাজি যখন খাজুরের স্কুলে পড়তেন, তখন পুতুল খাজুরে কোলের শিশু। তারপর দেশভাগ। মামাজিরা দেশভাগের পর চলে গেছেন কলকাতায়। আর পুতুলরা সেখানেই থেকে গেছে। বিয়ে হয়ে পুতুল মহাদেবপুরেই বৈবাহিক জীবন কাটিয়েছেন। এখন পুতুল একা, স্বামী বিগত হয়েছেন। ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

পুতুল মামাজিকে চেহারায় নয় নামে চিনলেন। গ্রামের পুরোনো লোককে পেয়ে আতিথেয়তার ধুম পড়ে গেল। রাতে খাওয়ার সময় দেবুর মনে হলো – এ এক মহাভোজ। পিঁড়ে পেতে মাটিতে বসে বিশাল থালায় ভাত আর চারপাশে গোল করে রাখা গোটা আষ্টেক বাটিতে বিভিন্ন ব‍্যঞ্জন। খেতে বসেছে দেবু, মামাজি আর বাড়ির কর্তা (পুতুলের ছেলে)। সবার থালাই সমান সজ্জিত। মহিলারা সামনে বসে, কেউ অতিথি রঞ্জনে, কেউ পরিবেশনের তদারকিতে।বাচ্চাদের খাওয়া আগে হয়ে গেছে, মহিলারা পরে খাবেন। ঘরে একটা ‘প্রাণের আলাপ’-এর খুশীর আবহাওয়া। খূশীটা মন থেকে উঠে আসা, যেন ছোঁয়া যাচ্ছে। নো দেখনদারি, নো selfie moment.

খাওয়ার বহর দেখে দেবুর চোখ কপালে উঠলো। ওর দিল্লীতে রোজকার খাওয়ার মেনু কিছুই বর্ণাঢ‍্য থাকে না। তাই আজকের আয়োজনে আঁতকে উঠে দেবু কিছু দেখে, কিছু চেখে, কিছু পদ ভালো লেগে খেয়ে আর কিছু পদ না খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। বাপ রে, এতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখন খালি রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়া।

পরের দিন ঘুম ভাঙ্গলে দিনচর্চা শূরু করে মামাজি আশেপাশের পুরোনো লোকের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখা টেখা করে দুপুরে বাড়ি ফিরলে লাঞ্চের পর্ব শুরু হলো। এখনও সেই একই ব‍্যবস্থা – থালার চারপাশে গোল বাটির মিছিল। আজকে বাটির পদগুলো নিশ্চই অন‍্য।

হঠাৎ দেবুর নজরে এলো যে আজ মামাজি আর বাড়ির কর্তার থালায় সাতটা করে বাটি, কিন্তু ওর থালায় বাটি আটটা ! দেবূ চোখ কুঁচকে রহস‍্যটা বোঝার চেষ্টা করলো। এরকম তো হবার কথা নয়। সকলেরই তো একই বাটি পাওয়ার কথা – হয় সাতটা নয় আটটা। শুধু ওকেই বেশী কেন ? মূল অতিথি তো মামাজি, দেবু তো শুধু সাথে এসেছে তল্পিবাহক হয়ে। যদিও দেবুর শানিত কথাবার্তায় গৃহস্বামী-স্বামীনিরা বেশী প্রভাবিত হচ্ছেন মামাজির একঘেয়ে স্মৃতি-চারণের থেকে, তবুও ‘বিশেষ খাতির’ তো মামাজিরই প্রাপ‍্য প্রোটোকলের বিচারে। তাই অষ্টম বাটিটা তো মামাজির থালায় থাকার কথা। থালা কি ভুল করে বদল হয়ে গেল ?

মামাজি গভীর আগ্রহের সঙ্গে 1930 – 40 এ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পুতুলও যতটা পারেন ঠেকা দিয়ে যাচ্ছেন। দুজনেই আত্মমগ্ন, আর কোন দিকে হুঁশ নেই। বাকিরা তো পরবর্তী প্রজন্ম, বাকিদের অতটা গা নেই সেই তিরিশের দশকের স্মৃতিচারণায়।

দেবূ আস্তে করে অন‍্য পরিবেশনকারিনীর কাছে জানতে চাইল এই সাত-আট রহস‍্যের উৎস, বাকিদের কান বাঁচিয়ে।

উদ্দিষ্টা মহিলার (পুতুলের পুত্রবধু, নাম প্রতিমা, বয়েস বছর পঁয়ত্রিশ) মূখে কি একটু বিস্ময়ের আভাষ খেলে গেল ? দেবু ব‍্যাপারটা নজর করতে পেরেছে বলে ? তারপর নামিয়ে নেয়া চোখে কি লজ্জার একটা ক্ষীণ আভা ? মনের ভাবটা দেবূ বুঝতে পেরেছে বলে ? এখন জল আনার আছিলায় সামনে থেকে সরে যাওয়া, এটা কি নিজেকে লূকোনোর তাগিদে ?

একটু পরেই আবার তিনি এসে বসলেন পরিবেশনের তদারকিতে, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কি ? এবার তিনি সহজাত মেয়েলি দক্ষতায় বাকিদের কান বাঁচিয়ে দেবুকে জানালেন সেই রহস‍্য :
– কাল রাতের খাওয়ায় আপনার বাঁধাকপির তরকারিটা ভালো লেগেছিলো। কারণ শুধু সেই বাটিটাই কাল আপনি উপুড় করে খেয়েছিলেন। বাকি বাটিগুলো তো সব একটু একটু করে চেখেই দেখেছিলেন। সেটা লক্ষ‍্য করেই আজ আবার বাঁধাকপি রান্না হয়েছে খালি আপনার জন‍্য। সেটাই আপনাকে অষ্টম বাটিতে দিয়েছি। বাকিদের দিই নি। তাই তাদের আজ সাতটা করে বাটি।

দেবু বাস্তবিকই অবাক হয়ে গেল। কানে যেন মধুবর্ষণ হলো, প্রাণে যেন স্নিগ্ধ বৃক্ষছায়ার প্রলেপ লাগলো। সে এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা অতিথি, এসেছে অন‍্য দেশ থেকে, দুদিন পরে আবার ফিরে চলে যাবে নিজের দেশে, পরে কোনদিন আর দেখা হবে না। আর তার জন‍্য ইনার নিজের মনে এত জায়গা ? বিস্ময়কর সেই মনের মাধুর্য, অবশ করে দেয়া সেই মনের উর্বরতা। অতিথিদের জন‍্য রান্না করাই তো আপ‍্যায়নের প্রথাগত কষ্টিপাথর হতে পারত। আমি কি ভাবে খাচ্ছি তা দেখাটা তো তার কাজের মধ‍্যে পড়ে না। কিন্তু তিনি মন দিয়ে সেটা দেখেছেন, দেখে ভাললাগার বিষয়টা আহরণ করেছেন, তারপর সেই ভালোলাগাটা আবার তৈরী করার জন‍্য খেটেছেন (পরের দিন আবার বাধাকপি রান্না করেছেন)। এবং এসব করেও কোন লোক-দেখানো বাহাদুরি নিতে চান নি। ব‍্যাপারটাকে নিজের মনের জগতে গোপন রাখতে চেয়েছেন।

বিস্ময়, বিস্ময়। একে কোন মাপদন্ডে বিচার করা যায়, কোন নিক্তিতে মাপা যায় ? দেবূর মনে হলো তিনি নিজেই একটি মাপদন্ড – তার নিজের মন নিয়ে, চিন্তাধারা নিয়ে, কাজকর্ম নিয়ে। অন‍্যদের বিচার করা যেতে পারে এর সাথে তূলনা করে। এরা পৃথিবীর নিজের নাগরিক। এরকম কিছু মাথায় রেখেই বোধহয় তৈরী হয়েছিলো শান্তিনিকেতনের মূলমন্ত্র – এসো আনন্দিত চিত্ত
এসো উৎসূক প্রাণ
সবারে করি আহ্বান।

দেবূর মনটা তখন সপ্তম স্বর্গে।
এমনি করেই শ্রাবন রজনীতে
হঠাৎ খুশী ঘনিয়ে আসে চিতে
এই অনূভুতিটা, দেবু বূঝতে পারলো, ওর মগজের হার্ড ডিস্কে un-deletable factory hardware এর মতো গেঁথে বসলো। 10 বছর পরেও এই স্মৃতি ‘ধেয়ানের বণাছটায়, খুশীর রঙে মনকে রঙ্গিতে’ থাকবে।

(সমাপ্ত)

Ghalib Lekhniwal is a GZA Member in pseudonym. He now lives in Goa.