অঙ্গে বাজায় বাঁশি

অরুণাভ রায়

উৎকল প্রদেশের সঙ্গে বাঙ্গালীর পরিচয় কম দিনের নয়। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ সেই মৌর্য যুগেও ছিল। বুদ্ধদেব-এর থেকে ভারতবর্ষে লিখিত ইতিহাসের সূচনা। তার আগে যে ইতিহাস এ দেশে আমরা পাই তার অনেকটাই গাথা আকারে; কল্পনা ও রাজপ্রশস্তি সেই ইতিহাসের তথ্যকে অনেক সময়ই উচ্চকিত করে তোলে। অবশ্য তামিল ভাষার চর্চাটি ব্যতিক্রম।

উৎকল প্রদেশ, প্রাচীনকালে যার অন্য নাম ছিল ওড্র প্রদেশ, সে কিন্তু সকলের মধ্যে থেকেও তার নিজের অভ্যেসে আলাদা। বাংলায় একটি জনপ্রিয় গান আছে “কাশ্মীরেও নয়, শিলং-এও নয়, আন্দামান কি রাঁচীতেও নয়” – মান্না দের কণ্ঠে এই গানের অনুভূতিটি আজকেও ওড়িশার সঙ্গে যেন খাপ খেয়ে যায়। সে সত্যিই ‘আরো যে সুন্দর, আকাশ প্রান্তর’- সেখানেই বাঙ্গালী তার বাস্তবের ‘তুমি – আমি’ কে নিবিড় করে তোলে

কি নেই ওড়িশায়? বরং বলা ভাল কি কম আছে ওড়িশায়? একজন মুখ্যমন্ত্রী আছেন; তিনি আছেন বলে অযথা বাগাড়ম্বর করেন না; নিজের কাজটি নীরবে নিভৃতে করেন। ‘প্রশাসন হবে অদৃশ্য’- এই সার কথাটি তার এতদিনের রাজত্ত্বকালে ওড়িশাবাসী বুঝেছেন। আপামর ভারতবাসীও বুঝেছেন। জনকল্যাণের জন্য বিজ্ঞাপন নয়; বিজ্ঞাপনই হোক জনকল্যাণ, ওড়িশার পথে প্রান্তরে হেঁটে এটিই মালুম হয়। 

এছাড়া আছে পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র, জনপ্রিয় জায়গাগুলি সব বাঙ্গালীরই জানা। সেই চৈতন্যদেবের সময় থেকে শ্রীক্ষেত্রে যাওয়ার চল বঙ্গবাসীর আছে। প্রায় পাঁচ-ছশো কিলোমিটার রাস্তা সে সময়ে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাঙ্গালী পাড়ি দিত নানা উপায়ে। তবে, সবচেয়ে নিরাপদ বোধহয় ছিল দল বেঁধে সংকীর্তন গাইতে গাইতে মারের সাগর পাড়ি দেওয়া। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখি বিদ্যাসাগরের মা যাচ্ছেন শ্রীক্ষেত্র দর্শন করতে। পরে সারদা দেবীও যান পুরী। গিয়ে কয়েকমাস ছিলেন। বাঙ্গালীর এই অদম্য তীর্থ ভ্রমণ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ওড়িশার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েছে একথা বলা যাবে না কিন্তু। পর্যটন স্থল ভ্রমণ আর তার সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া এক জিনিস নয়, বরং দুরূহ কাজ। অনেক সমুদ্র আছে, অনেক নদী আছে যেখানে দুই স্রোতোধারা আলাদাআলাদা রঙে বয়ে চলেছে একদম পাশাপাশি, কোনো বিরোধ নেই, কোনো মিলও নেই। কিন্তু তলায় তলায় আত্মীকরণ আছে। তাই তো তারা কেউ কাউকে বিব্রত করে না। ওড়িশার সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধটা যেন সেইরকম। 

কর্মক্ষেত্রে ছিলাম সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যুক্ত। দেখেছি ওড়িশি নৃত্যের প্রতি বাঙালীর ভালোবাসা। আত্মনিবেদনের শৈলী ওড়িশি নৃত্যে তিন আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে বিভক্ত হয়েও সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্য্যে মহীয়ান। আর সেই রসবোধ বাঙ্গালী নৃত্যশিল্পীরা সুচারু ভঙ্গীতে পরিবেশন করেন। নৃত্যের সঙ্গে যে গানগুলি গাওয়া হয় তার মধ্যে দক্ষিণ ভারতের প্রভাব স্পষ্ট। সেদিক দিয়ে বলা যায়, ওড়িশা যেন সেতু নির্মাণ করছে পূর্ব আর দক্ষিণ ভারতের মধ্যে

কলকাতা, মহানগরী হতে শুরু করল ১৬৯০ সাল থেকে জব চার্ণক যখন নোঙর বাঁধলেন গঙ্গার পূর্বতটে। বাণিজ্য কুঠি স্থাপনই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মূল উদ্দেশ্য, কিন্তু এক দশকের মধ্যেই তিনটি গ্রামের আকর্ষণ ভাগ্যান্বেষী থেকে প্রশাসনিক কাজকর্মকে ব্লটিং পেপারের মতন শুষে নিল। জনসংখ্যা বাড়ল। ১৭৩৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কলকাতাকে লন্ডভন্ড করলেও ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ কলকাতাকে অন্য ভারতবর্ষের থেকে স্বাতন্ত্র্য দিল। বাবু শ্রেণী বিকাশ লাভ করল। আর কে না জানে বাবু মানেই বিলাস। আর বিলাস আসে অপরের শ্রমে। ১৭৯৪ সাল নাগাদ বাবু নবকৃষ্ণ দেব পালকি – বেহারা চালু করলেন বিলাসী জীবন আরো মসৃণ করতে। কোম্পানীর প্রশাসকরাও এই সুবিধা নিলেন। কিন্তু কিছু অবিবেচক সিদ্ধান্ত পালকি বেহারাদের ক্ষুব্ধ করল। ১৮২৭ সালে তাঁরা জানালেন আর পালকি বইবেন না। ধর্ম ঠাকুরকে ঘটে সাজিয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করলেন। একমাস স্থায়ী এই ধর্মঘট ভারতের প্রথম ধর্মঘট। আর এই ১২ হাজার পালকি – বেহারারা ছিলেন সকলেই ওড়িশাবাসী। বেহারাদের ব্যাজ পড়ানোর সিদ্ধান্ত ধর্মের উপর হাত দেওয়া; আর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বিদেশী টোটা মুখ লাগিয়ে খোলার জন্য হয়েছিল। ১৮২৭-এর এই বিদ্রোহ ১৮৫৭-র বিদ্রোহের অগ্রগামী কিন্তু উপেক্ষিত। 

বাঁশি কখনো শুনেছেন? গভীর রাতে একা বাঁশি যখন বাজে, বা কোন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানে বাঁশিই যখন সমগ্র সঙ্গীত পরিবেশনে মুখ্য উপজীব্য তখন তার ভিতরে এক অন্তর্লীন বেদনা যেন ঝরে পড়ে। হৃদয়ের কন্দরে বাঁশি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অতসী মামী গল্পের মতন মুচড়ে মুচড়ে ওঠে। পাওয়া আর না পাওয়ার সুর মানুষকে করে একা, নিভৃত, সমাহিত। তাই বাঙ্গালী বারে বারে ছুটে যায় ওড়িশায়। বেশিটাই শ্রীক্ষেত্রে, চিলকা, কোনারকে, রিপিট টেলিকাস্টের মতন একই জিনিস বারে বারে দেখেও আশ মেটে না। ইদানিং বড়ন্তী তপ্তপানী, গোপালপুর -অন-সি এমনকি কালাহান্ডিও বাঙ্গালীর আকর্ষণের বস্তু। কত সংস্কৃতি সাধনা আছে ওড়িশায়। বাঙ্গালী সেসবও আত্মস্থ করতে চায়। আছে সরাইকেলার ছৌনাচ, পটচিত্র বা ফেলিগ্রি-গহনার চর্চা, সম্বলপুরী সিল্ক বা কটকী শাড়ি, জামা বাঙ্গালীকে মোহিত করে। 

রথযাত্রা বাঙ্গালীর বার্ষিক অন্দর-অভিযান। রথযাত্রায় মনে হল ২০১৭ সাল থেকে পুরীর রথযাত্রা বাংলা ভাষ্যে দূরদর্শন কলকাতায় চালু হয়, আমি অনুষ্ঠান অধিকর্তা থাকার সময়। কত দর্শক সংখ্যা যে সে কারণে বেড়েছে তা বলার নয়।

স্মরণের বেলাভূমিতে বাঙ্গালী ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কার বেদনা স্থায়ী রূপে নিজ অনুভূতিতে ফিরে পেতে চায়। তাই ওড়িশা; ওড়িশা বাঙ্গালীর অঙ্গে বাজায় বাঁশি। 

 About the author

Arunava Roy,a retired Group A officer from Doordarshan had studied Economics in Santiniketan,Visva-Bharati commenced his career with ISI,Kolkata,worked as Statistician,Labour Dept. Govt of West Bengal joined Akashvani through UPSC in 1991.Worked at Agartala,Panaji,Kolkata,Port Blair AIR kendras.He experienced Tsunami 2004 as broadcaster.Later he worked for Marketing wings of Prasar Bharati.In 2016 Sri Roy joined Doordarshan kendra Kolkata as Head of Programme.He also looked after the East Zone.During this tenure Sri Roy was instrumemtal to augments the viewrrship of this PSB Channel manifold.He introduced the Live Bengali commentary of Puri Rathayatra.Sri Roy is associated with different Universities as guest lecturer on media sciences. Sri Roy retired from service on 30.09.2022.