বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা’র ভাল-মন্দ- পর্ব ১
বাঘ, সিংহ, পিঁপড়ে বা প্রজাপতির জীবনে মহা বুদ্ধির অনুপ্রবেশ ঘটে নি, তারা যা পায় তা-ই খায়, যেখানে জায়গা পায় সেখানেই থেকে যায়, মানুষের মত তারা সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত টোস্ট খাব, না দোসা; বাসে যাব- না ট্রেনে বা হাওয়াই জাহাজে ইত্যাদি রকম ‘নিজে-বেছে-নিন’-এর সুযোগ পায় না। মানুষের ‘নিজে-বেছে-নিন’-এর অধিকার সহজে আসে নি। যেমন ধরুন, আগে রাজাদের ইচ্ছেমত চলতে হত। এখনও বহু দেশে এ অধিকার অতি সীমাবদ্ধ। যে কোন জিনিষের মতই, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা’র সুগন্ধি গোলাপের কাঁটা হিসেবে লুকিয়ে থাকা প্রধান ঝুঁকি হল, সব দায়িত্ব নিজের। যারা ‘তুমি অতীব বুদ্ধিমান, নিজবুদ্ধি’র প্রয়োগ কর’ বলে গর্বের গাছে তুলে দেয়, তারাই কোন সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হলে বলতে থাকে- ‘এত নির্বুদ্ধিতা কি করে করলে ভাই?’
সুখ আছে বটে, স্বস্তি নেই- তাঁর লেখা বই প্যারাডক্স অফ চয়েস-এ ব্যারি সোয়ার্জ বলছেন তাঁর কাছের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বেছে নেবার জন্য ২৪০ রকম স্যুপ, আর ১৬০ রকম ফলের রস। তাদের মধ্যে একটি বেছে নিন আর সারা দিন ভাবতে থাকুন নিজের জন্য সবচেয়ে ভালোটা নিতে পারলেন কি না। ‘আপনি মহা বুদ্ধিমান’ অন্যদের এ কথায় তাতিয়ে ওঠা ছাড়াও ভেতর থেকে প্রতিটি বেছে নেওয়া থেকে সবচেয়ে ভালটি নেওয়ার তাগিদ এখনকার মানুষকে দিনরাত তাড়া করে ফিরছে। চল্লিশ রকম জ্যাম আর বত্রিশ রকম পাঁউরুটি’র মধ্যে ঠিক’টি বাছতে গিয়ে কমে যাচ্ছে আমাদের সময় আর বেড়ে যাচ্ছে রক্তের চাপ আর তাতে চিনি (blood sugar)। এটাকে সোয়ার্জ বলছেন খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তের অত্যাচার (Tyranny of small decisions)।
‘অধিকার চাই’, ‘অধিকার চাই’-এর আন্দোলনকারীরাও কখনো কখনো সে অধিকার খর্ব হলে গোপনে উপকৃত বোধ করেন না এমন নয়। যেমন ধরুন, বাচ্চাকে অনেক দূরের বাছাই করা স্কুলে পাঠিয়ে তার শৈশব ব্যাহত করার অধিকার বহু উন্নত দেশে কেড়ে নিয়ে পাড়ার স্কুলেই পড়াতে হবে নীতি নেওয়ায় পাড়ার স্কুল আর পাড়ার শিশুদের শুধু নয়, অভিভাবকদেরও কম উপকার হয় নি। অনেক কিছু সামনে রাখলে মানুষ ঘাবড়ে যায়, কী করবে ঠিক করতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থমকে যায়। ভেবে দেখুন, দু’টির বদলে বত্রিশটি ভ্যাক্সিন সামনে রেখে ‘বেছে নিন’ বললে আজ অবদি আমাদের মধ্যে ক’জন করোনা’র টিকে’টি নিয়ে উঠতে পারতেন!
পড়াশোনার ক্ষেত্রে চার থেকে চোদ্দ বছরের বাচ্চাকে বড় হয়ে তুই কি হতে চাস? জিজ্ঞেস করা আমাদের যে রীতি তার ফলে কত সাহিত্য-ইতিহাসের সম্ভাব্য তারকা মধ্যম বা নিম্নবর্গীয় হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। একজন হাঙ্গারিয়ান অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সমাজতন্ত্রের পতনের পর শিক্ষাক্ষেত্রে কি বদল ঘটেছে? তিনি বললেন, একটি নতুন সমস্যা হ’ল, এখন ছাত্ররা যে কোন বিষয় নিতে পারে যেমন ধরুন, নৃতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, এর ফলে সাযুজ্য (coherence) ব্যাহত হচ্ছে। কলেজগুলো শিক্ষাকেন্দ্রিক না হয়ে উপভোক্তা (customer)-কেন্দ্রিক হয়ে সুপারমার্কেট-এর মত চেহারা নিচ্ছে। ভারতেও ব্যাপারটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ক’দিন আগে চেন্নাই-এ ক্লাস টেন-এর একটি ছেলের কাছে জানলাম সে অঙ্ক পছন্দ করে না। মুক্ত বিদ্যালয়ে (open school)-এ তার বিষয় অর্থনীতি, ইংরাজি, গৃহবিজ্ঞান (Home science) আর ব্যবসাবিধি (Business administration)।
আগে ডাক্তাররা দ্ব্যর্থহীন ভাবে এটা-সেটা করতে হবে বলে দিতেন। আজকাল তাঁরাও ‘আপনি কি চান’-এর খদ্দের তুষ্টিকরণের পথ ধরেছেন। আপনি চোখে এই লেন্স বসাবেন না ঐটা, হার্টে অমুক স্টেন্ট বসাবেন না তমুকটা এসব সিদ্ধান্ত ডাক্তারীজ্ঞান বিহীন রোগী বা তাঁর আত্মীয়দের জিজ্ঞাসা করলে তাঁদের আত্মশ্লাঘা বাড়তে পারে কিন্তু আদতে উপকার হয় কি না তা নিয়ে গভীর সন্দেহ করার কারণ আছে। সম্পর্কহীন রোম্যান্টিকরা না বুঝলেও ভুক্তভোগীরা বোঝে। যাঁদের ক্যান্সার হয় নি (ক) আর যাঁদের হয়েছে (খ) তাদের নিয়ে একটি সার্ভেতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘ক্যান্সার চিকিৎসার নানা পদ্ধতির মধ্যে আপনার পছন্দটি নিজে বেছে নেবেন না ডাক্তারদের ওপর ছেড়ে দেবেন? সুস্থ ‘ক’ গোষ্ঠীর বেশীর ভাগ নিজেরা বাছতে চাইলেও, ‘খ’ গোষ্ঠীর চোদ্দ আনা মানুষ সে গুরুতর সিদ্ধান্তটি ডাক্তারদের হাতেই রাখতে চেয়েছেন।
একসময় ছোট ছোট চত্বরে আটকে থাকা বাজার এখন সর্বত্র ছড়িয়ে আমাদের মন-সময় গ্রাস করেছে, সেখানে ‘নিজে-বেছে-নিন’ ব্যাপারটা প্রায় উপাস্য দেবতার জায়গা নেওয়ায় বিক্রেতারা অনেক রকমফেরে ক্রেতাদের ব্যস্ত-বিব্রত রাখতে রাখতে ভুলে যাচ্ছে যে বলগাহীন রকমফেরে দু’দলের কারোই লাভ হয় না। একাধিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, পছন্দের সুযোগ সীমার মধ্যে রাখলে বিক্রিবাটা ভাল হয়। খরিদ্দাররা অনেক বেশী জিনিষ দেখলে খুশি হন ঠিক-ই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরও দেখতে-ভাবতে হবে বলে কেনার কাজটি মুলতুবি রাখেন।
তার কারণ বহুর মধ্যে আপাতদৃষ্ট বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, ঠিক মুক্তির স্বাদ দেয় না- অবস্থা হয় একটিমাত্র বাঁশের জন্য বাঁশবনে ঢুকে ভ্যাবাচাকা খাওয়া মানুষের মত।
বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা যখন সীমাহীন,
ইচ্ছা-সুখে উচ্ছে মেশায় লাফারের লাইন।।
ট্যাক্স বাড়ালে আমরা ভাবি সরকারের আয় বাড়বে। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ আর্থার লাফার ১৯৭৪ সালের কফি টেবিলের ন্যাপকিনে একটি ঘণ্টার আকারে লাইন টেনে সেসব চিন্তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দেখান যে ট্যাক্স বাড়তে থাকলে সেই সময় একটি সীমা পর্যন্ত সরকারের আয় বাড়লেও তার পরে কমে যাবে। অর্থাৎ, ট্যাক্সের হার শূন্য হোক বা বিপরীত মেরুতে ১০০% হোক, সরকারের আয় শূন্যের কাছাকাছি ঘুরতে থাকে।
এবার মানুষের কেনার ইচ্ছের ব্যাপারে লাফার রেখার প্রয়োগ দেখুন।
পাশে লাফার রেখার ছবিটিতে নীল বিভাজিকা লাইনের একদিকে রকমফের বাড়ার সাথে সাথে কেনার ইচ্ছে বর্ধমান, আর ডান দিকে একই কারণে তা ক্রমহ্রাসমান। শুধু একরকম চাল থাকলে সে দোকানে কেউ যেতে চায় না, আবার দু’শো রকম থাকলে, মন স্থির করতে না পেরে একজিবিশন দেখে ফুচকা খেয়ে ফিরে আসে। অতএব, মধ্যপন্থা মোটেও মন্দ নয়। সে টিঁকে থাকে টিঁকিয়ে রাখে।
নানা দিকের জ্ঞান কীভাবে এক বিন্দুতে মিলে যায় ভাবলে অবাক হতে হয়। দুই প্রান্তে এক ফললাভের ব্যাপারে লাফারের ভাবনা যেন ‘অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি ছোট হয়ো না, ছাগলে মুড়িয়ে খাবে।‘- এই লোককথার অনুরণন। একটি শিশু তার মা দুধ দিলে খেতে চায় না (অন্য সময় খায়) – এমন একটি ঘটনার বিশ্লেষণে মনস্তাত্বিক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, একবার-দু’বার-কয়েকবার বললে যে মানুষ কিছু করতে উৎসাহী হয় বহুবার বললে সে-ই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ভেবে দেখুন, বাবা-মা পড়তে বললে পড়তে না বসা আর খেলতে বললে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার মধ্যে এরকম কিছু কারণ আছে কি না!
বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা’র অপরিহার্য মন্দ দিকটি শুধুই আমাদের অবসর (আর অনেক আনন্দ) অজান্তে চুরি করে ক্ষান্ত থাকে এমন নয়, সে বিস্তর হাবিজাবি জিনিষ কিনিয়ে ছাড়ে। যেমন ফোনে আপনি ছ’টি মাত্র কাজ করবেন জেনেও ছিয়ানব্বইটি করার উপায় কিনে ফেলেন। সে সব থেকে মুক্ত থাকার সরকারী-বেসরকারী ফন্দি-ফিকির পরের পর্বে পেশ করার ইচ্ছে রইলো।
-অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.