অণুসন্ধান ১৩
বিন্নীর ইচ্ছে।
বিন্নীর হঠাৎ এক নতুন বন্ধু হল আজ । নাম জানতে চাইলে বলল অদ্ভুত একটা নাম।
বিন্নী জানলার এপারে। সে জানলার ওপারে সাইকেল চালিয়ে রোজ ঘুরতে যায়। তার লাল টুকটুকে স্কার্ট আর পায়ে লাল টুকটুকে মোজা। বিন্নীর জানলার সামনে এসে হঠাৎ সেদিন থামল ঘ্যাঁচ করে। কেন কে জানে। বিন্নী একটা কটমটে কাককে মুড়ি দিয়ে ডাকছিলো। ও কি ভাবল কে জানে। এসে জানলার গ্রিলে রাখল হাত। বলল আমি ইচ্ছে। তুমি?
বিন্নীর নানা রকম অসুবিধে আছে। ওর ছোটমামা বলেন ও বিশেষ রকম সক্ষম। বিন্নী জানে এগুলো সান্ত্বনা। বিন্নী আসলে নানা রকম অক্ষম। মুখটা মানুষের মত হতেও যেন মানুষের নয়। একে বলে ডাউনের সিনড্রোম। ডাক্তারবাবুরা দিদিরা মাথা নাড়ান আর বলেন ওঃ ডাউনস। আবার ওর পাগুলোও ঠিক পা হয়ে ওঠে নি। মানুষের পাও হয় নি, তাহলে বিন্নী এক ছুট্টে পার্কটা গোল করে পাক দিয়ে চু ঝিকঝিক করতে করতে রেলগাড়ির হয়ে যেতে পারত। আবার বেড়ালের পাও হয় নি। যে পা টিপে টিপে টিপে টিপে এক লাফ দিত বাপীর পিঠে, আর সব কম্পিউটারের মিটিং এলোমেলো করে দিত।
বিন্নীর অসুবিধে আছে কথা কইতে। সব কথা বোঝা যায় না। মা বোঝে। বাবা না বুঝতে পারলে মার দিকে অসহায় হয়ে তাকায়, মা তখন বুঝিয়ে দেয়, বিন্নীর একটা স্পেস ট্রাভেলের ছবির বই চাই। হ্যাঁ বিন্নীর খুব আকাশে যাবার শখ। কত ফাঁকা জায়গা। ধাক্কা লেগে পড়ে যাবার ভয় নেই। নতুন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ছবি ও দেখেছে বাবার ফোনে। আকাশময় ছড়িয়ে আছে কোন এক অভিমানিনীর গয়নার বাক্স। বিন্নীর মনে হয় ঐ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তারাগুলো গেঁথে গেঁথে মালা করি।
বিন্নী নাম বলতে গেল। ওকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল আমি জানি তোমার নাম। বিন্নী। ঐ যে তুমি হুইল চেয়ার টেনে টেনে খালি জলের দিকে যাও আর তোমার পাহারায় থাকা শম্পি মাসি চেঁচায় বিন্নী বিন্নী। যেউনি যেউনি। ওদিকপানে যেউনি। খিলখিল করে হেসে উঠে সে বলে, বাবা কি গলার জোর। তোমার এই কাক বন্ধুরাও কে কে করতে করতে উড়ুত লাগায় আকাশ পানে তারপর পার্কের রেলিংএ সার গিয়ে বসে টিভির কাকুদের মত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটায়।
বিন্নীর বন্ধু কাকগুলো। ওর মুখ ভার হয়। ওপারে ইচ্ছেও গম্ভীর হয়ে যায়। তারও টলটলে চোখ ছলছল করে।
কি মুস্কিল। আমি দুঃখ পেলে তোমার চোখে জল কেন। তুমি আমার বন্ধু হবে? ফিক করে সে হাসে। বলে আমি তোমার বন্ধু হব কি করে? আমি তো তোমার ইচ্ছে। হাঁ করো দেখি। হাঁ করতেই মুখে টকাস করে ফেলে দেয় একটা ঝাল লাল লজেন্স। আমার মামার বাড়ী সোদপুরে। সেখানে এক বুড়ো দাদুর দোকান থেকে কেনা। ভালো? বেশি ঝাল? খুব মমতা নিয়ে বলে ইচ্ছে।
খানিকক্ষণ চুপ করে স্বাদ নেয় বিন্নী। মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ওর অনেকদিনের ইচ্ছে এই ঝাল লজেন্স খাবার। একবার ট্রেনে করে চেন্নাই যাচ্ছিল ডাক্তার দেখাতে। এক ফিরিওলা এসেছিল এই কালচে লাল ঝাল লজেন্সের বয়াম নিয়ে। তার গলায় ছিলো লাল সবুজ কাঁচা লংকার মালা। মাথায় একটা শেফের মত টুপি। তার ভিতরে কতরকম আচারের প্যাকেট। তার ওপর সে হরবোলা। এই ডাকছে কোলা ব্যাং এই ডাকছে টিয়া। হাঁ করে দেখতে দেখতে লোকটা চলে গেল অন্য কামরায়। ঝাল লজেন্স আর কেনা হল না। যদি পা ভালো হত বিন্নী দৌড়ে গিয়ে তাকে ডেকে আনত। সেই ঝাল লজেন্সের..
-আমার নাম ইচ্ছে। কি এত ভাবছো?
-তোমার নামের কি কোন মানে হয়। কি একটা নাম। ইচ্ছে। যা ইচ্ছে তাই। মানে কি বল ত? যাচ্ছেতাই।
আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে ও।
-আমি ওরকম খারাপ ইচ্ছে নই ভালো ইচ্ছে। মজার ইচ্ছে। যেথা ইচ্ছে যাইতে পারি। যাহা ইচ্ছে খাইতে পারি। সারেগামাপাধানিসা গাইতে পারি।
-এটা তুমি ভালো পারো না। বিন্নীর ঠাকুমা এখনও রোজ হারমনি নিয়ে বসে গান করে এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ। ও বেসুর ধরতে পারি।
ইচ্ছে মেনে নেয়। ঠিক আছে গাইতে পারিনা তো কি। খাইতে পারি যাইতে পারি। গানও গাইতে পারি তবে কাঁচাবাদামের মত ভালো না।
কাঁচাবাদাম শুনে বিন্নীর মজা লাগে। দুজনেই গেয়ে ওঠে কাঁচাবাদাম। আমার কাছে নাইকো বাবু ভাজা বাদাম।
-বাঃ তুমি তো বেশ গাও। বলো তোমার কি পুরস্কারের ইচ্ছে।
-এনে দেবে যা চাই?
-বলছি তো। উটি থেকে স্ট্রবেরি, কিলিমাঞ্জারো থেকে এমুর চচ্চড়ি..
-ইস। কি যে বলো। তুমি আমায় একটু মেঘ এনে দিতে পারবে? ঐ যে বৃষ্টি শেষে সন্ধেবেলা একটু গোলাপী নরম আইসক্রিমের মত মেঘ দেবদারু গাছটার গায়ে লেগে থাকে, যেন গাছটা নাড়া দিলেই পড়ে যাবে ঝরঝর করে। সেই মেঘটা আমার চাই এক টুকরো।
বলতে বলতেই দেখা যায় ইচ্ছে কোথায় হাওয়া। টুং টাং কর একটা আইসক্রিমের গাড়ী কোথা থেকে এসে হাজির। কি দিদিমণি আইসক্রীম চাই? গোলাপী মেঘের মত আইসক্রীম? সন্ধেবেলার সূযযিমামার কারখানায় তৈরী। নরম নরম।
বিন্নীর আইসক্রিম খাওয়া বারণ। ও চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। ইচ্ছে কোথায় গেল?
মায়ের ডাক আসে। অনেকক্ষণ জানলার সামনে বসা হলো। এবারে শোবার ঘরে চলো। ফিজিও আসবে।
অনেক রাত্তিরে যখন সবাই ঘুমিয়ে, চাঁদও চোখে আই ক্যাপ লাগিয়ে ঝিমোচ্ছে, যখন পৃথিবীটা মনে হয় একটা লম্বা মেল ট্রেন, ধু ধু মাঠের ভিতর দিয়ে চলেছে, তখন সেই হরবোলা এসে দাঁড়ায় বিন্নীর ঘুমের জানলায়। পাশে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে। এখন তার মাথায় লাল ফিতের বদলে একটা নীল হেডব্যান্ড। বিন্নী তার দিকে তাকিয়ে হাসে। সেও হাসে। দুজনে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় যেখানে অনেক তারা ছড়িয়ে আছে চুণী পান্না মুক্তোর মত। দুই বন্ধু কুড়োয় আর মালা গাঁথে। সারা রাত।
ওর বাবা মা আর ওকে খুঁজে পাবে? কেউ কি ফিরে আসে যদি ইচ্ছে এসে তার হাত ধরে নিয়ে যায়?
আমি অক্ষম লেখক। বিন্নীর কথা ভাবতে ভাবতে লিখতে লিখতে আমার অণুসন্ধান শেষ হয়ে আসে। চললাম ওর বন্ধুটির খোঁজে। আবার দেখা হবে কোনদিন। নমস্কার।
About Author
বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং
খুব ভাল, বহুস্তরীয়, সমকালীন মরমী লেখা। লেখক নিজেকে অক্ষম বলছেন- সে অক্ষমতা দীর্ঘজীবী হোক।
বিশেষ ধন্যবাদ ‘বিশেষভাবে সক্ষম’-এর ফাঁকি যথাযথ ধরিয়ে দেবার জন্য। আমরা সবাই একটা কাজ পারি, আর একটা পারি না। সবাই ‘বিশেষভাবে সক্ষম’। ঈশ্বর ছাড়া কেউ কি নির্বিশেষ ভাবে সক্ষম হতে পারেন? ধরুন, দু ‘জন অতিথি আসবেন। তাঁদের মধ্যে একজন দেখতে পান না, দ্বিতীয় জন চলতে পারেন না তাঁদের ব্যাহত-দৃষ্টি (Visually challenged) ও ব্যাহত-চরণ (Movement challenged) না বলে একই নাম দিয়ে দিলে ঠিক মত সহায়তার ব্যবস্থা করা যায় কি? কেউ গান গাইতে না পারলে কি তাঁকে বিশেষরকম গায়ক বলা হবে?