নেই তাই খাচ্ছো- না পাওয়া মন্দ নয়
কলেজে যাবার পথে ট্রেন চড়তে হ’ত, সেখানে নানা হকারের বেসাতি। যিনি হেঁয়ালির বই বিক্রি করতেন, তাঁর একটি প্রিয় ছড়া ছিল, “নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কোথায় পেতে? কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে।” এই ছড়াটা তার দার্শনিক তাৎপর্যের জন্য মনে গেঁথে গিয়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল এরকম একটা উলটো ছড়াও থাকা উচিৎ-
পেলে তাই ভুগতে হলো, নইলে বেঁচে যেতে-
এই কথাটি লেখা দেখি মনের দেওয়ালেতে।
গরীব দক্ষিণ আমেরিকা আর বড়লোক উত্তর আমেরিকার মধ্যে তফাতের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকায় অনেক আগে পৌঁছে নানা রকম খনিজ আর খাটানোর শ্রমিক পেয়ে বড়লোক হয়ে গেল। তাদের রাজাও ছিলেন শক্তিমান। তাঁর তাঁবে ওখানে রাজার অনুগ্রহপ্রাপ্ত সম্ভ্রান্তদের বোলবোলাও চালু হল। দক্ষিণের সম্পদ সামলাতে ব্যস্ত স্প্যানিশরা শ্রমিকের অভাবের কারণে জনবিরল উত্তরের দিকে হাত বাড়ায় নি। অর্ধ শতক-এরও পর সেখানে ব্রিটিশরা পৌঁছয়। তখন তাদের রাজা ছিল হীনবল। সে জন্য যাবার জন্য উৎসাহ, কিছু টাকা পয়সা, জমি ইত্যাদি দিয়ে বলা হয়, ‘করে খাও’। কিছু রোমাঞ্চপ্রেমী বড়লোক ছাড়া আমেরিকায় প্রথম দিকে তারাই পৌঁছেছিল যাদের দেশে ভাল আয়ের রাস্তা নেই। এই সব মানুষ বড়লোক হবার হাতছানি দেখে নানা উদ্ভাবনের বন্যা বইয়ে দেয়। এক সময় আমেরিকায় প্রাথমিক পর্যন্ত পড়া লোকদের পেটেন্টের অনুপাত ছিল ৪০%। থমাস আলভা এডিসন-ও এই গোষ্ঠীভুক্ত। (নেই তাই …) দেশে কাজ পান নি বলেই এঁদের আবিষ্কার আর তার সুফল ভোগ করেছে সারা পৃথিবীর মানুষ। তাছাড়া, স্থানীয় মানুষকে মজুর বানিয়ে খাটিয়ে নেবার স্প্যানিশ পদ্ধতি কাজে না লাগায়, ওখানকার উপনিবেশকারীদের ভোট দিয়ে নিজেদের সমিতি বানিয়ে কাজকর্ম চালাতে দেওয়া হয়। প্রায় প্রথম থেকেই বিকেন্দ্রীকৃত অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত থেকেই আমেরিকার গণতন্ত্রের শুরু। স্বৈরতন্ত্রের থেকে গণতন্ত্রের সুফল যে কত বেশী, আজকের আমেরিকা দু’ভাগের অবস্থা তার প্রমাণ। আবার দেখুন লোক ছিল না বলেই এমনটা হতে পারলো (নেই তাই…)।
জাপানকে দেখুন। ভূমিকম্পপ্রবণ ছেঁড়াখোঁড়া দেশটা অত বড় চীন আর আশপাশের দেশগুলোতে কলোনি বানিয়ে বিশ্বযুদ্ধ করল কি করে? কারণ, দেশে কিছু ছিল না। যখন প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্য তাদের পড়ে পাওয়া ধন রপ্তানি করতে ব্যস্ত তখন জাপান, যার সম্পর্কে Encyclopedia Britannica লিখছে, “With few exceptions, Japan’s mineral reserves are small, and the quality of those mined is often poor.”, পড়াশোনা আর উৎপাদনে তাদের করুণার পাত্র করে তুলেছে (আবার নেই তাই…)।
তাদের প্রদেশের ঊষর জমি থেকে বেরিয়ে আমাদের দেশের গুজরাতি মাড়োয়ারিরা ব্যবসা করতে শুধু ভারতের কোণে কোণে নয়, পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে যতটা সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন, গাঙ্গেয় অববাহিকার উর্বর প্রদেশগুলির মানুষ যে ততটা হতে পারেন নি তার কারণের মধ্যেও কি ‘নেই তাই…’ লুকিয়ে নেই?
অভিনেতা যীশু সেনগুপ্ত স্বাভাবিক অভিনয় ও অসাধারণ উপস্থাপনা-(সারেগামাপা)র গুণে শুধু বাংলায় নয়, হিন্দি ফিল্মজগতেও ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেছেন, এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, ক্রিকেটার হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। একবার সম্ভবতঃ বাংলার টীমে জায়গা পাবেন এমন অবস্থায় দেখেন একজন ব্যাকিং এর জোরে ওঁর জায়গা নিয়ে নিয়েছে। তাই ক্রিকেট ছেড়ে দেন। পান নি তাই আমরা প্রতিভাবান অভিনেতা যীশুকে (পায় নি, তাই) পেলাম। ধিরুভাই আম্বানি যদি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে মেডেল পেতেন বা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইস্পাত উৎপাদক লক্ষ্মী মিত্তল দেশেই মুদির দোকানে ভাল মুনাফা পেয়ে গেলে কি হত সে দুরের কথা ছেড়েই দিলাম। বাড়ির পাশেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ -এ চাকরি পেয়ে ‘আজ আর খোঁজাখুঁজি নাই কিছু…’ ধরণের তৃপ্ত ছেলেটির সাথে সাত ঘাটের জল খাওয়া তার একদা অনুকম্পার, এখন ঈর্ষার পাত্র ছেলেটির মানসিক ও আর্থিক বিকাশের তফাৎ দেখে অবাক হয়ে যাই। বিহারের কলেজ থেকে উঠে আসা এ দেশের এক অতি সফল তীক্ষ্ণ মেধার ম্যানেজারের সাথে আড্ডা হত। তিনি আইআইটি-আইআইএম পাশ করা তাঁর ওপরওয়ালা সম্পর্কে বলেছিলেন, এঁরা ফুল ছড়ানো রাস্তা ধরে এগিয়ে যান, আমাদের এগোনোর রাস্তায় উপরে জ্বলন্ত সূর্য আর পায়ের নীচে পাথর। লম্বা দৌড়ে এই ভদ্রলোক তাঁর ওপরওয়ালার চেয়ে শুধু প্রজ্ঞায় নয়, পদগৌরবেও অনেক এগিয়ে গেছেন (নেই তাই…)।
বোস অডিও সিস্টেম-এর আবিষ্কারক ও কোম্পানির মালিক অমর গোপাল বোস-এর বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ননী গোপাল বোস ব্রিটিশদের হাতে বার বার গ্রেপ্তারি এড়াতে আমেরিকা চলে যান। দেশে স্বস্তিতে থাকলে কি তা হতো বা বোস অডিও-র মত অসাধারণ শব্দ যন্ত্র তৈরি হ’ত? স্টিভ জবস, বিল গেটস, রিচার্ড ব্র্যানসন, ওয়াল্ট ডিজনি, মার্ক জাকারবার্গ এরা কেউ কলেজের পড়া শেষ করতে পারেন নি। স্টিভ জবস এত গরীব ছিলেন যে কলেজের ফি দিতে পারেন নি, বিনা পয়সায় পাওয়া যেত বলে আমেরিকায় ইস্কনের মন্দিরে খেতে যেতেন। রবীন্দ্রনাথও স্কুল শেষ করতে পারেন নি। এঁরা পারেন নি বলেই অনেক কিছু সৃষ্টি হয়েছে। হ্যারি পটার-এর অতি বিখ্যাত স্রষ্টা জে কে রাওলিং-এর কোলে একটি শিশু দিয়ে তাঁর স্বামী ছেড়ে চলে যান। উপার্জনহীন সে সময় তিনি মানসিক অবসাদ আর দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে প্রথম বইটি লেখেন। বারো জন প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করার পর ত্রয়োদশের হাতে সেটি ছাপা হয়। রাওলিং এখন অতি প্রিয় লেখিকা আর ব্রিটেনের প্রথম সারির ধনী মানুষ। আমার প্রশ্ন অন্য – যদি তিনি স্বামীর ভালবাসায় ভরা গৃহকোণটি পেয়ে যেতেন, আমরা কি হ্যারি পটার আর এখনকার রাওলিংকে পেতাম (নেই তাই… আবার)?
আপনারা যদি গত পঞ্চাশ বছরে দেশে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিষয়ে বড় মানুষের পৃষ্ঠভূমির খোঁজ নেন, দেখা যাবে তাঁদের অনেকেই ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে না পেরে অন্য লাইন ধরেছিলেন। দেশ-বিদেশে ‘নেই তাই…’-এর উদাহরণ এত বেশি যে লিস্ট শেষ হতে চায় না। এ লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, ‘নেই’ ব্যাপারটা অতি আকর্ষণীয় আর মনোরম। শুধু দেখছি আর নিবেদন করছি, জাতি বা ব্যক্তির জীবনে ‘নেই’, ‘আছে’র চেয়ে অনেক ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আসে……শুধু জেগে থাকতে হয়……লেগে থাকতে হয়।
১লা জানুয়ারী, ২০২৩
-অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
এ বিষয়ে নিজের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। অংক আর অর্থনীতিতে নড়বড়ে ছিলাম বলে ভুগোলে লেটার পেয়েও ইংরাজি পড়তে আসি। বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংরাজি অনার্সে লাফ দিয়ে বছর দুয়েক এই আক্ষেপ করেই কেটে যায় প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্স কত আরামেই না পড়তে পারা যেত। পরে, অনেক পরে, অনেক অনেক বছর ধরে এই প্প্রাথমিক না পাওয়ার তলে খুজে পেয়েছি অলৌকিক সব পাওয়া। মনে হয়েছে “ভাগ্যিস!”
তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সরকারি চাকরি না থাকা সত্বেও তার পিছনেই ছুটে চলে। মফস্বল ও গ্রামের দিকের ভালো ছেলে-মেয়েরা সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরির জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, ঘুষ দেয়, কিন্তু আর কিছু করার কথা ভাবতে পারে না। বোধহয় বর্তমানে সরকারি চাকরির high salary এবং সারা জীবনের জন্য pension এর ভরসার জন্যই আর কিছু করার কথা ভাবা যাচ্ছে না।
এই নিবন্ধের সত্যতা তারাই বুঝবে যাদের জীবনটাকে পিছন ফিরে দেখার মতো বয়স হয়েছে। যেদিন এই লাইনটার মানে বুঝেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিল সত্যি বড় হলাম বুঝি।
” সকালবেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছো তুমি এ কি
ঘর ভরা মোর শূন্যতারই বুকের ‘পরে।
জানি নাই যে তুমি এলে আমার ঘরে।।”
আরো পড়ার প্রত্যাশায় রইলাম।