বিবেকানন্দ- আলাপচারি
দু’দিন আগে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন পালিত হল (জন্ম ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩; প্রয়াণ ৪ঠা জুলাই ১৯০২)। দেখলাম ঐ উপলক্ষ্যে গঙ্গা-জুয়ারি একাডেমীর প্রভাতফেরিতে যোগ দেবার জন্য নাম দিয়েছেন নানাভাষী মানুষ। দেড় শতাব্দীর পরেও এই স্বল্পজীবী মানুষটি সারা ভারতের কাছে এতটা আবেদন ধরে রাখতে পারলেন কী করে, ভেবে অবাক হই আর নানা কথা মনে ভেসে ওঠে।
আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গঙ্গার ধারে চুঁচুড়া শহরে। পড়তাম মহসীন কলেজের লাগোয়া ১৮১২ সালে শুরু হওয়া এক সরকারী স্কুলে। পড়াশোনার প্রতি আমার কোন রকম দুর্বলতা ছিল না, আর নকশাল আমলের পর স্কুলের বড় গেটের মধ্যে একটা কুঠুরিমত দরজা সবসময় খোলা থাকতো। দেখতাম কলেজ ছাত্ররা সারাদিন কলেজে থাকে না। ইচ্ছেমত ক্লাস করে। তাই স্কুলের কলেজিয়েট নামটাকে School, yet it’s a college’ ধরণের ভাবানুবাদ করে আমিও প্রথম দু’একটা ক্লাস করে বেরিয়ে পড়তাম। প্রধান আকর্ষণ ছিল খেলার মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতি দীর্ঘ চুঁচুড়া কোর্ট, যার মধ্যে সিনেমার মত সওয়াল-জবাব দেখার বহুদিনের ব্যর্থ প্রয়াসজনিত হতাশা- পাশে ভাগ্যগণনা, সাপ খেলা, বাঁদর নাচ থেকে দাঁতের পোকা বার করে দেখিয়ে দেওয়ার চমৎকার কার্যকলাপ-এ ভাল রকম পুষিয়ে যেত। কোর্ট ছাড়াও যত জায়গায় যেতাম যেমন হাসপাতাল, রেলস্টেশন লঞ্চঘাট বা বাসস্টপ – সব জায়গায় পানের পিক-এর বিস্রস্ত রক্তাভ কারুকাজ দেখা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একেবারে নতুন রং করা জায়গাগুলোও মুহূর্তের মধ্যে নোংরা হয়ে যেত দেখে আমরা এই রকমই। নোংরা থাকাই আমাদের নিয়তি- এমনি একটা ধারণা যখন চেপে বসে গেছিল প্রায় তখন একবার বেলুড় মঠে যাবার সুযোগ হ’ল। ধর্ম নয়, আধ্যাত্মিকতা নয় আমার কিশোর মনে সেদিন প্রথম ও শেষ যে প্রশ্নটি উঠেছিল, তা হ’ল ‘স্বামীজি পানের পিক ফেলা বন্ধ করলেন কি করে?’
আর একটু বড় হয়ে বাড়িতে বিবেকানন্দের উদ্ধৃতির বই, Thus Spake Vivekananda এমন কি তাঁর গোটা রচনাবলীতে হাত পৌঁছেছিল। স্কুলের পাঠ্যেও তাঁর লেখা কিছু কিছু পড়েছি। কিন্তু বইয়ের বাইরে তাঁর সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ নানা জায়গায়। যেমন ধরুন, ভোপালের এক কেন্দ্রীয় শিক্ষণ সংস্থায় ইজরায়েল থেকে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ করে সদ্য-প্রত্যাগত এক অঙ্কের অধ্যাপকের সাথে দেখা। জানলাম তার কলেজ রামকৃষ্ণ মিশন (বেলুড় বা নরেন্দ্রপুর)। শুনলাম বাড়ি মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম। অনেক ভাই-বোন।
-কলেজে পড়তে কি রকম খরচ পড়েছিল?
-আমার সঙ্গতি ছিল না। মহারাজদের বললাম পড়তে চাই, টাকা দিতে পারব না। ওঁরা ভর্তি করে নিলেন।
‘নিরামিষ’, ‘নিরামিষ’, ‘অহিংসা’, ‘অহিংসা’ চিৎকারে বিপর্যস্ত আমিষাশী মন নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ন্যাসী বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমাদের ছাত্র হোস্টেলের খাবার ডাল-সব্জি-মুর্গির ঝোল খাওয়ালো, নিজেও খেলো। রামকৃষ্ণ মিশন বোধ হয় একমাত্র হিন্দু মিশনারি সংস্থা যেখানে আমিষ খাওয়াতে বাধা নেই। পরে জার্মানির এক অধ্যাপিকা বললেন যারা অন্য প্রাণীদের প্রতি করুণার কথা বলে তারা কি জানে, বনে জন্তুদের প্রাকৃতিক মৃত্যুর মানে হল, অন্য জন্তুদের হাতে জীবন্ত ভক্ষিত হওয়া অথবা বার্ধক্য বা অসুখে সহায়হীন, খাদ্যহীন, চিকিৎসাহীন মৃত্যুবরণ? তখন মনে পড়ল, পাহাড়ে ভাল সব্জি হয় না, সেখানে ভয়ঙ্কর বড়লোক না হলে নিরামিষ খেয়ে বেঁচে থাকার শখ মেটানো অসম্ভব। ভারতের অতি দীর্ঘ সমুদ্রতটবাসী মানুষের শুধু শখের নয়, অপরিহার্য খাদ্য- মাছ। তাছাড়াও এ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের পুষ্টির যোগান দেয় আমিষ খাবার। নিরামিষের নেশা আরও জেঁকে বসলে তাদের কি হবে? আমার মনে স্বামীজি বললেন, এদের নিজের স্বর্গলাভ ছাড়া কোন চিন্তা নেই। পশুপাখি বল, মানুষ বল কে মরলো, কী ভাবে মরলো তাতে কিছু এসে যায় না ওদের। এ সব ভন্ডামি দেখেই আমি বলেছিলাম- লোকে পিঁপড়েকে চিনি দিচ্ছে আর ভাইএর সর্বনাশ করছে।
অনেক আগে আমির খান ‘সত্যমেব জয়তে’ টেলিভিশন প্রোগ্রামে দেখা পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে বাবর আলি নামের একটি ব্যতিক্রমী ছেলে যে ছোট বয়সে নিজে স্কুলে পড়তে পড়তেই গ্রামের অন্য বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুল খুলে বসেছিল। টিভিতে বাবর আলির পেছনে টাঙ্গানো বিবেকানন্দের ছবি অতি স্বাভাবিক লেগেছিল।
তাজুদ্দিন আহমেদ পড়াশোনা করেছেন প্রথমে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন, তার পর বেলুড় বিদ্যাভবন আর শেষে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন-এ। তিনি যখন আবাসিক ছাত্র হিসেবে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তে যান, তখন তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা ভয় পেয়েছিলেন যে তাকে হিন্দুয়ানি গ্রাস করবে। মিশনে তাঁকে ধর্ম খোয়াতে হয় নি। সেখানকার শিক্ষা তাঁর স্বধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষও জাগায় নি, পরে তিনিও শিক্ষক হন। মিশনে তিনি হিন্দুয়ানি পান নি, পেয়েছেন এক বিশ্ব-ধর্মের ছোঁয়া যার অন্য নাম মানবতা।
আবার নিজের কথা- চাকুরিজীবি পরিবারে স্কুল এড়ানো ছেলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার বাড়ির লোকজনের এবং যুক্তিবাদী হবার জন্য আমার নিজেরও তেমন কোন আশার মায়াবী হাতছানি ছিল না। খেলার মাঠে চিন্তা ভুলে থাকলেও মাঝে মাঝে দুপুরবেলা যখন ‘একা শুয়ে তেতালাতে’ পরে কি হবে চিন্তা খোঁচা মারত, তখন অন্য সময়ের প্রিয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী বা সুকুমার রায় নন, ‘ভয় কি? তুই অমৃতের পুত্র’ বলে ভরসা দিতেন তাঁর রচনাবলী থেকে উঠে আসা স্বামী বিবেকানন্দ। মহাশক্তির অধিকারী সত্ত্বগুণী আর শক্তিহীন তমোগুণী দুজনকেই দেখতে এক রকম। একজন আঙ্গুল নাড়ান না, তাতে প্রলয় ঘটে যেতে পারে, দ্বিতীয় জন সেটি করে না অলস বলে- এসব পড়তে পড়তে বিদ্যার জগতে ঘোর তমোগুণী এক কিশোর কিছুটা সত্ত্বগুণের দিকে এগোনোর স্বপ্ন দেখত। আর কে না জানে, স্বপ্ন থেকেই গড়ে ওঠে তাজুদ্দিন, বাবর আলি’র মত জীবনসমূহ।
অনেকেই বিবেকানন্দের স্ববিরোধিতার কথা বলেন। তাঁরা যখন স্বামীজির লেখা বা বক্তৃতার থেকে নানা প্রমাণ দেন তখন …বিবেকানন্দের প্রায় সব কাজের মধ্যে… সেই সব প্রমাণাদির মধ্যেও জনকল্যাণের নীরব আর্তি ফুটে ওঠে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস কবিতায় মোক্ষদা’র অনুযোগ “শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা।“ আমরা জানি, সন্ন্যাস জীবনের মুল উদ্দেশ্য জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি, পরমাত্মার সাথে মিলন- নির্বাণ। অথচ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ গিরিশ ঘোষকে বলেন, “দেখ গিরিশবাবু, মনে হয়- এই জগতের দুঃখ দূর করতে আমায় যদি হাজারো জন্ম নিতে হয় তাও নেবো… মনে হয়, খালি নিজের মুক্তি নিয়ে কি হবে? সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঐ পথে যেতে হবে।” এই মানবপ্রেম-ই তাঁর জন্মের ১৬০ বছর পরেও বিবেকানন্দকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সমালোচনা এড়িয়ে যেতে নেই। পরের কথঞ্চিৎ-এ তাঁর স্ববিরোধিতা আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে ঈষৎ স-বিস্তার হবার ইচ্ছে রইল।
১৪ই জানুয়ারী, ২০২৩ -অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
তোর লেখা পড়ে বার বার যে কি মুগ্ধ তার কোনো হিসাব নেই। পরের লেখাটা পরে পড়ার অবস্থায় থেকে পথ পানে চেয়ে রইলাম।
অদ্ভুত স্মৃতিচারণ আর তার সঙ্গে মানুষ বিবেকানন্দের সহজ, সহৃদয় মানবীয় গুণের আন্তরিক বিশ্লেষণ। পড়তে পড়তে বাবর আলি এবং তাজউদ্দীন আহমেদের মত এমনি আরো কিছু সাধারণ মানুষের কথা মনে পড়ে যাঁদের আত্মিক জীবনে সমৃদ্ধ হওয়ার পিছনে মানুষ বিবেকানন্দ,রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর ইত্যাদির অবদান কত গভীর ছিল। তাই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের জীবনের স্ববিরোধ তাঁর সাধারণের মনে অমর হয়ে ওঠার পথে কোন অন্তরায় তৈরি করেনি। লেখাটা সত্যিই সুন্দর লাগল। অপেক্ষায় রইলাম যদিও পরের পর্বে স্বামীজীর জীবনে স্ববিরোধিতা আর অসম্পূর্ণতার কথা পড়ব বলে।
অসাধারণ স্মৃতি চারণায় স্বামী বিবেকানন্দ’র “মানবধর্মী” সত্তা ছবির মতো ফুটে উঠেছে। বাবর আলি, তাজুদ্দিন দের কথা অজানা ছিল এতকাল। এঁদের কথা জেনে সমৃদ্ধ হলাম।
দুর্ভাগ্য এটাই যে বেশিরভাগ মানুষের কাছে স্বামীজী কে *সন্ন্যাসী* সাজিয়ে রেখে দেওয়া হলো!!! এই লেখার গুরুত্ব তাই অসীম। শুভেচ্ছা ভালোবাসা শুভকামনা।