Episode 5
পর্ব – ৫
(18 শতকে পদার্পণ)
নিউটন তার যুগান্তকারী মাধ্যাকর্ষণের সূত্র (ইনভার্স স্কোয়ার ল) নিয়ে আসেন 1687 তে। 1700 সাল আসতে আসতে সে সূত্র সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে গৃহীত হয়। একটা ধারণা জন্মায় যে আরও অন্য প্রাকৃতিক শক্তি হয়তো এই সূত্র ধরেই কাজ করে যাচ্ছে।
1760 -1780 নাগাদ খোঁজ চলছিল যে (স্ট্যাটিক) ইলেকটিসিটিতে যে বিকর্ষণ শক্তি, সেটা কি কোন সূত্রের আওতায় আনা যায় ? ইলেকট্রিসিটির বিকর্ষণ শক্তিও তো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই প্রকৃতি-দত্ত।
কিন্তু সেটা জানতে সমস্যা দাঁড়ালো যে পরীক্ষা চালাতে গেলে তো বিভিন্ন টেস্ট কন্ডিশনের সাথে সাথে পরিবর্তিত বিকর্ষণের পরিমানটা মাপতে পারা চাই। কিন্তু এতদিন অবদি তো শুধু ইলেকট্রিসিটির তীব্রতাই (বা চার্জের তীব্রতা) মাপতে পারা গেছে।
এ বিষয়ে সুরুর দিকের কাজ সুইস বিজ্ঞানী বার্নোলীর। ( বিমানের ডানায় বায়ুচাপের তারতম্যের কারণে বিমানের ভেসে থাকার ক্ষমতার মূল থিয়োরিটি ইনারই)। প্রীস্টলী ও ক্যাভেন্ডিশও কাছাকাছি সময়ে ইংল্যান্ডে বসে একই ধরণের পরীক্ষা চালিয়ে একই ফল পান।
কিন্তু এ বিষয়ে কেল্লাটি ফতে করেন ফ্রান্সে বসে কুলম্ব, 1786 সালে। তখন তার বয়স 50। ইলেকট্রিসিটি থেকে হওয়া বিকর্ষণটা মাপতে তিনি নিজেই ফ্যাব্রিকেট করেন এক টরশন ব্যালেন্স। (প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে 1795 তে এমনই এক টরশন ব্যালেন্স বানিয়ে ক্যাভেন্ডিশ মেপে ফেলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং তা দিয়ে পৃথিবীর ওজন) সেটা দিয়ে বিকর্ষন শক্তিকে নানা পর্যায়ে মেপে তিনি বানিয়ে ফেললেন তার ইলেকট্রিকাল ফোর্সের ইনভার্স স্কোয়ার ল যা এখনও কূলম্বস ল নামে ‘সগৌরবে চলিতেছে’।
কুলম্ব কিন্তু এই সূত্র লিখলেন শুধু স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির ওপর। ঘরে, দরবারে তখনো তেলের আলো। ইলেকট্রিকের আলো তখনো স্বপ্নবিলাস। এমনকি প্রবাহমান বিদ্যুতের (Electromotive) ধারণাটাও আসে নি। সব ভাবনাই তখন contact electricity র আওতায় (Electrostatic)।
Flowing Electricity
কুলম্ব যখন তার Electrostatic এর সূত্র লিখছেন তখন সমান্তরাল ভাবে ইলেকট্রিসিটির আরেকটা ভিন্ন ধারায়ও কিন্তু কাজ হচ্ছিল। 17 শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে হওয়া সেই ধারাকে বলা হতো Medical Electricity। এসব কাজের লক্ষ্য ছিলো স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটিকে মানুষের শরীরে প্রবাহিত করিয়ে শরীরের কোন রোগের উপশম করা যায় কিনা।
ইটালির লুইগি গ্যালভানি অ্যানাটমির ডাক্তার হয়ে এ বিষয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ইলেকট্রিসিটি জেনারেটর মেশিন থেকে (স্ট্যাটিক) ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে, তা ব্যাঙের শরীরে প্রবাহিত করিয়ে শরীরে ফেলা প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। পরীক্ষার পরিবেশের বিভিন্ন তারতম্য ঘটিয়ে দেখেছেন যেমন ইলেকট্রিসিটি শরীরে প্রবাহিত হবার সময়ে ব্যাঙের শরীরকে এক/দু জায়গায় কাঁচি দিয়ে শ্পর্শ করা, ব্যাঙকে লোহার রেলিংয়ে ঝুলিয়ে এসব পরীক্ষা করা ইত্যাদি। এই সব পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি 1791 তে তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলেন যে ব্যঙের শরীরেই ইলেকট্রিসিটি তৈরী হয়েছে। সেটার নাম দেয়া হয় Animal Electricity। তার ধারণায় সেটা একটা ‘নতুন ধরণের’ electricity যা ঘর্ষণজনিত ইলেকট্রিসিটি থেকে আলাদা। তখন গ্যালভানির বয়স 54।
Galvani’s Frog experiment
Galvani’s Frog experiment
এই নতুন মতবাদ বিজ্ঞানী মহলের এক অংশ মেনে নিলেন। কিন্তু মানতে গররাজী হলেন ইটালিরই আরেক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আলেজান্ড্রো ভোল্টা। 46 বছর বয়সে তিনি তখন খ্যাতি ও সাফল্যের উচ্চাসনে, ইলেকট্রিসিটির নানা বিষয়ে গত 25 বছর ধরে নানা কাজ করে চলেছেন, প্রিস্টলী, ল্যাভয়সিয়ের, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতো বিদেশী বিজ্ঞানীদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে বিঞ্জানের গবেষনার নানা বিষয়ে, ক্যাপাসিটার আবিস্কার করেছেন, তিনি ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ান ও অস্ট্রিয়ান সম্রাটের নেকনজরে, 3 বছর পরে তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির অত্যন্ত সম্মানজনক Copley Medal পাবেন 1794 তে। তিনি গ্যালভানির পরীক্ষাগুলো নিজেও করলেন, ফলও একই পেলেন। কিন্তু গ্যালভানির Animal Electricity র সিদ্ধান্ত ছেড়ে এক নতুন সিদ্ধান্ত দিলেন। তিনি বললেন যে ব্যাঙের শরীরে যে ইলেকট্রিসিটির প্রভাব পড়েছে তার উৎস ব্রাঙের শরীরের ভেতরে নয়। যে দুই ধাতব তার ব্যাঙের শরীর দিয়ে জুড়ে গেছে (লোহার রেলিং আর ছোঁয়ানো তার) তারাই তৈরী করেছে এই ইলেকট্রিসিটি। ব্যাঙের শরীর শুধু ধাতব তারের ভেতর তৈরী হওয়া ইলেকট্রিসিটিকে প্রবাহিত করেছে, নিজে ইলেকট্রিসিটি তৈরী করে নি।
Voltaic Pile
Alessandro Volta showing his invention (Voltaic Pile) to Napoleon.
এ এক সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারা। ঘর্ষন ছাড়াই ইলেকট্রিসিটি তৈরী হচ্ছে ! না কোন জীবের উপস্থিতি চাই, যা animal electricity র মূল প্রতিপাদ্য। এটা তো আগে কেউ কখনো বলে নি ! দুটো আলাদা আলাদা ধাতু কোন বিশেষ ভাবে জুড়ে দিলেই ইলেকট্রিসিটি তৈরী হয়ে যাচ্ছে ? তাও আবার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ হিসেবে ? নাহ, এ জিনিস প্রথম বার জানা গেলো।
নতুন মতবাদে বিজ্ঞানী মহল দু ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। একদল গ্যালভানির মতে বিশ্বাসী, অন্য দল ভোল্টার মতে। ভোল্টা কাজ করতে লাগলেন এ নিয়ে তার মতবাদটা যে ঠিক সেটা প্রমাণ করার জন্য।। এবং তা রূপ পেলো ৮ বছর পরে যখন ভোল্টা এক ভোল্টাইক পাইল বানিয়ে ফেললেন। এটা ছিল আজকের দিনের ব্যাটারির আদি রুপ। দুটো অসম ধাতুর দন্ড (জিঙ্ক আর কপার) কিছুটা ফাঁকে রেখে মাঝখানে নুন-জল দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিতেই তৈরী হয়ে গেলো ইলেকট্রিসিটি এবং চলতে থাকলো তার প্রবাহ। পরে আমরা সেই ধাতব দন্ডকে জানবো ইলেকট্রোড নামে, নুন-জলকে জানবো ইলেকট্রোলাইট নামে।
এই আবিষ্কারের সাথে খুলে গেলো ইলেকট্রিসিটি ব্যবহারের এক নতুন দিগন্ত। এতদিন ছিল Electrostatic Force। এবার নতুন জুড়লো Electromotive Force. 6 মাসের মধ্যে ভোল্টাইক পাইল থেকে বিদ্যুত প্রবাহিত করে নিকলসন জলের বিশ্লেষন করলেন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে। শুরু হয়ে গেলো নতুন পদ্ধতি – ইলেকট্রোলিসিস।
সেই সময় – আমাদের দেশে :
1794 তে রাজা রামমোহন রায় পাটনা/বেনারসের পাঠ/শিক্ষা শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। কোলকাতায় সদ্য পৌঁছেছেন উইলিয়াম কেরী, তার সাথে রামমোহনের এক উজ্জীবিত সখ্যতা তৈরী হচ্ছে। দ্বারকানাথ ঠাকুর সদ্য জন্মাচ্ছেন। ব্রাহ্মসমাজ আরো 40 বছর দূরে, সতীদাহ প্রথা বন্ধ হতে আরো 35 বছর লাগবে।
(এর পর পরের সংখ্যায়)
ঘটনাপ্রবাহ যেন এক রহস্য উপন্যাসের ঢঙে লেখা । রোমাঞ্চ, কি হয় কি হয় সাসপেন্স এবং অজান্তেই অনেক নূতন তথ্য জেনে যাচ্ছি।
লেখকে অসংখ্য ধন্যবাদ এত সুন্দর উপস্থাপনার জন্য।
খুব ভালো লেখা। বিশ্বজোড়া ঐতিহাসিক ঘটনা ও বৈজ্ঞানিক কর্মপ্রবাহের অতি সুন্দর ও আকর্ষণীয় উপস্হাপনা।
এরকম লেখা পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য লেখকদ্বয় ও গঙ্গা-জুয়ারি’কে অনেক ধন্যবাদ।