আমার সম্বোধনে তিনি বিশ্বকবি। রবিঠাকুর বললে মনে হয় তাঁকে যেন নীচে নামিয়ে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে।
আমার কাছে তিনি অ্যামাজনের মতো এক সর্বব্যাপী ডিপার্টমেন্টাল স্টোর যার পসরা হলো মানুষের যাবতীয় উল্লাস, উদ্দীপনা, উৎসাহ, হতাশা, প্রেম, আনন্দ, বিরহ, ক্রোধ ইত্যাদির অনুভূতি। সবই মজুদ এই অফুরান ভান্ডারে, শুধু খুঁজে নেবার কেতাটা জানা চাই। জানলে দেখা যাবে, মনের আজকের কথা বিশ্বকবি একশো বছর আগেই লিখে গেছেন। মনে হবে, আরে এতো আমারই কথা, .. এ তো আমাদেরি লোক। সেই মনে পড়াটা হয়তো তখন … ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা…। এ এক অদ্ভুদ রসায়ন !
ছোটোতে যখন প্রথম বিশ্বকবির গান শোনা সুরু তখন বার বার শুনে শুনে হয়তো কথাগুলো, বাজনাগুলো মুখস্থ হয়ে যেত, বাজনার শুরুটা শুনেই ধরতে পারা যেত যে কি গান আসছে। কিন্তু সেটা খালি বইয়ের মলাটটা দেখার মতো। মলাট খুলে ভেতরটা দেখা তখনও মনের সাধ্যের বাইরে। (সেই সময়ে গীতবিতান বইটাই আমার অজানা)।
স্কুলের শেষ দিকে যেন কিছু গানে মলাট খুলে ভেতরের পাতা নজর এলো। সম্মোহনের এইভাবে শুরু। কলেজে গিয়ে অন্তরঙ্গতা বাড়লো ধীরে ধীরে। তারপর চাকরিতে ঢুকে হলো নিজের গীতবিতান। সেই প্রথম মোলাকাত। তখন আমার বয়স পঁচিশ। অবাক হয়ে দেখেছিলাম এক মলাটের ভেতরে এত গান। তাদের প্রায় ৭৫ % ই অজানা। পরের ২০ % প্রথম দু-চার লাইন শুধু জানা।
সেই বইএর উৎসর্গ- পত্রে লিখেছিলাম – নিজেকে উপহার, পাথেয় হিসেবে। এখন পেছনে তাকিয়ে মনে হয়, লেখাটা যেন নিজের অজান্তেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। পরের অনেক ক্ষত-বিক্ষত মুহুর্তে এ বই এর হাজারো লাইন প্রলেপের কাজ করেছে। অবসাদে, হতাশায়, নৈরাশ্যে ভেঙ্গে পড়া সত্ত্বাটাকে আবার উঠিয়ে নিয়ে আলোর দিকে চলার রসদ যুগিয়েছে।
গীতবিতান এসে যেন এক স্বপ্নরাজ্যের দরজা খুলে দিল। এতো কবিতা, এতো অত্যাশ্চর্য্য সব পংক্তি ! শুরুতে লাইনগূলো ছিলো কেবল একটা গানের অংশ। ক্রমে গানের অংশ হওয়া ছাড়িয়ে সেই লাইনগুলো নিজের জীবনের নানা অনুভুতির সম্পূরক হতে থাকলো। নিজের বিশ্লেষণের সাথে, অনুভুতির সাথে খাপ খাইয়ে লাইনের আলাদা আলাদে মানে তৈরী করে নিতে মন মাতলো। ‘সেথা হতে সমীরণ, আনে নব জাগরণ, পরাণের আবরণ মোচন করে ‘ এটা আর গানের লাইন নয়, পরিণত বয়সের এক কবির আপাত-সুপ্ত উন্মাদনার পুনরাবির্ভাব। নব জাগরণ, পরাণের আবরণ মোচন – ইত্যাদি শব্দবন্ধে তার মার্জিত কিন্তু সোচ্চার প্রকাশ। এরকম উদাহরণ অগুন্তি।
আমার মতো এমন অনেকেই আছেন যাদের গলায় কোন সুর নেই, যারা গান গাইতে পারে না, যাদের গান জানা মানে আদ্যিকাল থেকে বহুবার শোনা গানের শুধু প্রথম একটা দুটো লাইনই মনে করতে পারা, যাদের কাছে রবীন্দ্র-সাহিত্য মানে শুধু পরীক্ষা পাসের পড়া, যাদের পেশাগত জীবনে সাহিত্য অদরকারী। তাদের কাছে গীতবিতান এক সহজতম রবীন্দ্র-সাহিত্য। এতে একবার ঢুকতে পারলে জীবনর সব মুহুর্তের সাথে তাল মেলানোর ভুরি ভুরি লাইন পাওয়া যাবে। এক জীবনে সেগুলো ব্যবহার করে উঠতে পারা যাবে না।
রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের ঘনঘটা দেখে মাঝে মাঝে অদ্ভুদ লাগে। মনে হয়ে এ জিনিস তো একা একা বসে একটা একটা করে শোনার জিনিস। সে ভাবে শুনলে হয়তো একটা গানই (বা তার কোন বিশেষ লাইনই) বার বার গুনগুন করতে মন চাইবে। হয়তো তাতেই ” কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে ‘ হবে। সে জায়গায় একটানা ১৫ -২০ খানা শুনে ফেলা! এতো টিকিং দ্য চেকবক্স এর মতো ব্যাপার। নিজের মতো করে রসাস্বাদন তো পালিয়ে পথ পাবে না।
(শেষ)
খুব ভাল একান্ত অনুভূতির কথা। প্রথমে গীতবিতানকে নিজের পাথেয় হিসেবে উপহার দেওয়া আর শেষে রবীন্দ্রসঙ্গীত একা একা একটি একটি করে শোনা- দুটোই বিরল, কিন্তু কোথায় যেন অতি স্বাভাবিক লাগে।