ভারতের জাতীয় সঙ্গীত
রবীন্দ্রনাথ পাঁচ স্তবকের জনগণমন গানটি লেখা শেষ করেন ১১ই ডিসেম্বর, ১৯১১। সেটির প্রথম স্তবকটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের ঘোষণা মোতাবেক গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারী। জন্মলগ্ন থেকেই গানটি কি উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক যে মাঝে মাঝে উঠতেই থাকে, তার একটি প্রধান কারণ গানটি যখন লেখা হয় তখন সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রতি ভারতের করদ রাজাদের আনুগত্য জ্ঞাপনের জন্য ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীর করোনেশন পার্কে দিল্লী দরবার-এর প্রধান কার্যক্রমটি অনুষ্ঠিত হয় আর সেখানেই বঙ্গভঙ্গ রদ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
নানা রাজনীতিক ছাড়াও প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু গানটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে কোন বড় মানুষ ভুল করতে পারেন, তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি অস্বীকার করলেও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে তা যথেষ্ট হতে পারে না, বিশেষতঃ তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী-ই পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি করে একটি কবিতা/গান লেখার প্রস্তাব তাঁর কাছে এসেছিল। ১৯৩৭ সালে একটি চিঠিতে তিনি পুলিনবিহারী সেন’কে লেখেন- “সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সেকথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেননা তাঁর ভক্তি যতই প্রবল থাক বুদ্ধির অভাব ছিল না।”
এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়, কোন সম্রাটের সভায় নয়, ঐ বছরের কংগ্রেস অধিবেশনে (২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৯১১)। তার আগে দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দ্য ইংলিশম্যান এবং দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল যে জনগণমন ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তির উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। বার বার নানা জায়গা থেকে অভিযোগ উঠেছে। এ রকম ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে সম্রাটস্তুতির অভিযোগ মেনে নিয়ে গানটির ছত্রে ছত্রে আর কবির তৎকালীন মানসিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে (সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স) সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজে দেখা বিধেয়।
অভিযোগ- কবি গানটি অন্তরের প্রেরণায় লেখেন নি, লিখেছেন ফরমায়েশ মানার তাগিদে।
উত্তর- ১৯১১ সালে, তাঁর নোবেল পাওয়ার দুবছর আগে, কবির কোন ‘অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া বলিলেই লিখিয়া দিব’ ধরণের অবস্থায় থাকার বাস্তব কারণ ছিল না। ১৯০১ সালে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পুরোধা, ১৯০৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সভার সভাপতি রবীন্দ্রনাথের ওরকম চাপল্যের কোন যুক্তিসম্মত কারণ পাওয়া মুশকিল।
এবার প্রত্যক্ষ গানটিতে যাওয়া যাক।
প্রথম স্তবকঃ
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উত্কল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥
মন্তব্য- সবাই জানে কবিরা অতিশয়োক্তির জন্য বিখ্যাত, বিশেষতঃ যখন তারা প্রশস্তি করেন। এ ক্ষেত্রে, যাঁর সাম্রাজ্য প্রায় পাঁচটি মহাদেশে বিস্তৃত এমন এক সম্রাটের স্তুতিতে বিশ্বভাগ্যবিধাতা একবারও না বলে পুরো পাঁচটি স্তবক জুড়ে তাঁকে ভারতভাগ্যবিধাতা বলে কবি সম্রাটের প্রাপ্য গৌরবকে সংকুচিত করে রাখায় অন্য রকম সন্দেহ ঘনিয়ে ওঠে। মনে হয়, তিনি যাঁর কথা ভাবছেন তিনি সেই রাজার রাজা, যাঁর বিস্তৃত মহাবিশ্বলোকে এসব তুচ্ছ ভাবনা ঠাঁই পায় না। কবির ভাবনায় তিনি এই রকম-
“তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তবু আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ বেশে
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।“
অভিযোগ- তিনি যে রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটেনের নিরঙ্কুশ শাসন তাদেরই উল্লেখ করে কাশ্মীর, অন্ধ্র, কেরল, রাজস্থান, মহিশূর ইত্যাদি প্রধান দেশীয় রাজ্যগুলির নাম অনুল্লেখিত রেখেছেন।
উত্তরঃ এই অভিযোগটির ভিত নড়বড়ে। এ কবিতায় অন্ধ্র সহ দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্য ‘দ্রাবিড়’ কথাটির মধ্যে ঢুকে যায়। তা ছাড়া যাঁরা কবিতা লেখেন তারা জানেন ইচ্ছে থাকলেও কিছু কিছু বাদ না দিয়ে ছন্দ-মেলানোয় কত বাধা। ভাল কবিতা পরিমিত শব্দবিন্যাসে পূর্ণতার স্পর্শ এনে দেয়। এই কারণে গঙ্গা, যমুনা ছাড়া তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বহমান ব্রহ্মপুত্র, নর্মদা, তাপ্তি, মহানদী, কৃষ্ণা, গোদাবরীও যে বাদ পড়ে গেছে তা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় ।
দ্বিতীয় স্তবকঃ
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥
মন্তব্য- ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৮-৫৯ সালে নীল দর্পণ প্রকাশিত হবার পর স্তুতি বা অন্য কোন অজুহাতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে উদার বাণী বা প্রেমহার গাঁথা’র কথা যে কোন ভারতীয় সাহিত্যিকের পক্ষেই কষ্টকর ছিল। তাঁরা, বিশেষতঃ অতি প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথ, এ কথাগুলি বাদ দিয়েও প্রশস্তি রচনা করতে পারতেন। তা করেন নি বলেই সন্দেহ হয় কবিতাটির লক্ষ্য সম্রাট ছিলেন না। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি বাংলাকে ভাগ করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রয়াস করে। গানটি যে দিন রচনা হয় তখনও বঙ্গভঙ্গ রদ হয় নি। সেই বিভাগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের নেতা রবীন্দ্রনাথ কি সম্রাটকে জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক বলতে পারেন? কিছুতেই পারেন না। স্তুতি যে ব্রিটিশ সম্রাটের নয় তা শুধু ‘ঐক্য-বিধায়ক’ বিশেষণটিতেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
তৃতীয় স্তবকঃ
পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
মন্তব্য- গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথ মানুষের মরণশীলতা, ব্যক্তিবিশেষের অনিত্যতা নিয়ে সচেতন ছিলেন না ভাবলে অবিচার হবে। সে জন্যই ‘চিরসারথি’ বলে তাঁর কোন মানুষকে সম্বোধন করা অবিশ্বাস্য মনে হয়। তা ছাড়া, অত্যাচারী, সাম্রাজ্যবাদী শাসককে রবীন্দ্রনাথের মত একজন সংবেদনশীল মানুষের জনগণপথপরিচায়ক বলে সম্বোধন করাও বিশ্বসনীয়ের সীমানা পেরিয়ে যায়।
চতুর্থ স্তবকঃ
ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
মন্তব্য- অন্য কথা বাদ দিলেও পশ্চিমের সম্রাটকে নারী হিসেবে বর্ণনা করার ভয়ঙ্কর ব্লাসফেমি কাব্যিক স্বাধীনতার আড়ালে ঢাকা যাবে-পরাধীন দেশের কবি নিশ্চয় সে আশা করেন নি। আবার মনে হয়, যাঁকে উদ্দেশ্য করে গানটি লেখা তিনি পুরুষ পঞ্চম জর্জ নন, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের অর্ধনারীশ্বর যাঁর মধ্যে মাতৃভাব আর পুরুষকার একাকার ।
পঞ্চম স্তবকঃ
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে—
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
মন্তব্য- ব্রিটেন ভারতের পশ্চিমে জানার পরেও সেখান থেকে আগত সম্রাটের স্তুতিতে পূর্ব দিকে সূর্যোদয়ের কথা দেখলে কবির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ গাঢ়তর হয়। প্রথম দুটি লাইন সামান্য অদলবদল করে এরকম লেখাই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল-
রাত্রি প্রভাতিল, উদিল নবীন রবি আজি পশ্চিম গগনে—
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনসৌরভ আনে।
পাঠক পুলিনবিহারী সেনকে লেখা কবির পত্রটি বিবেচনা না করলেও জনগণমন গানটির ছত্রে ছত্রে সম্রাটের চেয়ে অনেক ওপরে এক কল্যাণময় প্রায় শাশ্বত অস্তিত্বের ঘোষণা দেখতে পাবেন। একটু খোঁজ নিলে এও জানবেন, তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে অনেক বেশী পরিচিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্থাপনা উপলক্ষ্যে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেন।
তথ্য না দেখলেও খোলা মনে জনগণমন গানটির পাঁচটি স্তবক পড়লে বোঝা যায় ধীমান, অলোকসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক কবি তাঁর রচনাকে মহিমায়, দার্শনিকতায় সকল দিগ্বিজয়ী, সব সম্রাটের আয়ত্তাতীত এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।
বাকি সব কথার কথা…
১৩ই মে, ২০২৩ -অরিজিৎ চৌধুরী
তথ্যসূচী
রবীন্দ্রগানের অন্তরালে- পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, আনন্দ পাবলিশার্স,২০২৩
Does India’s national anthem extol the British? – BBC News
গীতবিতান- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দ্বন্দ্ব-পুরাণ- সৈয়দ মুজতবা আলি রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ২০০৬
সাগরী- রবীন্দ্র সংখ্যা, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন চেন্নাই শাখা, ২০০৯
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
Perfectly said
পড়া এবং উৎসাহ যোগানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অরিজিৎ,
অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলাম তার সাথে গভীর শ্রদ্ধা এবং নিষ্পাপ ভালবাসা।
বহুদিন আগে এই ফেসবুক এ একটা পোস্ট দেখেছিলেন যাতে আমাদের গর্বের জাতীয় সংগীত কে হেয় করে লেখা হয়েছিল এটা ব্রিটিশ রাজের বন্দনা করে লেখা।
আজ তার সঠিক জবাব পেলাম।
কে জবাব টা দিল?
আমার বাল্যবন্ধু অরিজিৎ।
ইয়ার তুলে সালাম। ??
অনেক ধন্যবাদ, বিশ্বজিৎ। বিশেষ ধন্যবাদ ব্যক্তিগত ভাবে না পাঠিয়ে এখানেই মন্তব্য করার জন্য। ভালো লাগা যেমন উৎসাহ যোগায়, বিপরীত যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য লেখকের ধারণা শুধরে নিতে সাহায্য করে। তা ছাড়া, মন্তব্য লেখকের সমর্থনে বা বিরোধিতায়- যাই হোক না কেন, প্রমাণ করে কেউ একজন লেখাটা পড়েছেন। সেটি শুধু লেখক নয়, অনেক সময় ও উদ্যম জুড়ে যাঁরা ওয়েবসাইটটি গড়ে তুলেছেন আর চালাচ্ছেন তাঁদের উৎসাহ যোগায়।
সুহৃদ অরিজিত দা,
তোমার আলোচ্য বিষয় “ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কি ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তিগীতি ছাড়া অন্য কিছু?” অতি প্রাসঙ্গিক বিশেষত যখন গান টি রচনার শতবর্ষ কাল পেরিয়ে আসার পরেও আজকের দিনে এটির সততা/অখণ্ডতা/বিশুদ্ধতা নিয়ে কিছু অল্প সংখ্যক মানুষের মনে সন্ধেহ জাগে। তুমি তোমার প্রাজ্ঞতা এবং ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ “ভারতবিধাতা” কবিতাটির চুল চেরা বিশ্লেষণ-ই শুধু করনি, এটা ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তিগীতি যে হতে পারেনা,সেই দিক টাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছ। একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের এর থেকে ভাল প্রয়াস আর কি হতে পারে। আমি এ জন্য অত্যন্ত গর্ব অনুভব করছি।
যে বিতর্ক টা এতদিন পরে আবার মাথাচারা দিয়েছে সেটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত টি কে নিয়ে, অর্থাৎ “ভারতবিধাতা” কবিতাটির প্রথম স্তবক টি কে নিয়ে। সমগ্র “ভারতবিধাতা” কবিতা টি নিয়েও কি বিতর্ক আছে? থাকলে এটা আমার জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার ধারনা হল রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবচেয়ে পঠিত এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে অপঠিত কবি। তুলনামূলক ভাবে অন্যান্য কবি বা লেখক দের থেকে ওঁর লেখা আমরা সবচেয়ে বেশী পড়ি। ওঁ সেই হিসেবে সবচেয়ে পঠিত। আবার সিংহভাগ পাঠক রবীন্দ্রনাথের লেখার ভিতরে ঢুকে বিষয়ের অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ নিংড়ে আনতে পারেনি।তাই অপঠিত থেকে গিয়েছে। তাই আমার মনে হয় জাতীয় সংগীত নিয়ে যে চর্চা আজকে হচ্ছে সেটি অপঠিত ব্যাপারটি থেকে।
‘জনগণমন’ সঙ্গীতটি যে ব্রিটিশ সম্রাটের ভজনা ছিলনা তা স্পষ্ট ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্য বেংগলি, পত্রিকা এবং শিশিরকুমার ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ র সংবাদে। ‘দ্য বেংগলি’ পত্রিকা পাঁচ স্তবকের “ভারতবিধাতা” কবিতাটির ৩১ লাইনের ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশ করেছিল। পরবর্তি কালে গান টি ব্রহ্মসংগীত হিসাবে প্রকাশিত হয় এবং বিভিন্ন উতসবে গাওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ১৯১৯ সালে অন্ধ্রের অ্যানি বেসান্ত কলেজে “দ্য মর্নিং সং” নাম দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে গান টি গেয়েছিলেন।পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ মার্গারেট ওই গান টির স্বরলিপি করেন। এত কিছুর পরেও ১৯৩৭-এর কংগ্রেস অধিবেশনে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির বিরুদ্ধে অনেকেই উচ্চকন্ঠ হন। অবশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের সমর্থনে, দেশের ভাষা বৈচিত্রের মধ্যে সহজগ্রাহ্যতায়,বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে গানটি গাওয়া-বাজানো সহজ হবে—এই সব বিবেচনায় ভারতবিধাতা কবিতাটির কেবল প্রথম স্তবকটি “জনগণমন” ১৯৫০-এর ২৪ শে জানুয়ারি ভারতের জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষিত হয়। বাঙালি হিসাবে আমরা গর্বিত—রবিন্দ্রনাথ এই গানের স্রষ্টা।আরও গর্বিত,স্বাধীন বাংলা দেশের জাতীয় সংগীত এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের সুর রবীন্দ্রনাথ থেকেই নেওয়া হয়েছে। প্রসংগত উল্লেখ্য,সারা বিশ্বে আর এক বিষ্ময়কর প্রতিভা, সুরস্রষ্টা বিটোভেন-এর সিম্ফনি ইউরোপিয় ইউনিয়নের সরকারি সুর,জাপানের নববর্ষ পালনের গানে বিটোভেনের সুর এবং পূর্ব পশ্চিম জার্মানির মিলনের দিনে যে সুর বেজেছিল সেটাও বিটোভেনের।
কাজেই, এ হেন মহামনবের শতবর্ষ আগের সৃস্টি নিয়ে বর্তমানের অমূ্লক সন্দেহ টা আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি অপঠিত সেই কারনেই। আর পরিশেষে যে কথাটি বলতে হয়, ভারতের সমৃদ্ধশালী বৈচিত্রকে ঐক্যবোধের একসূত্রে বাঁধার স্বর্ণসূত্রটি রবীন্দ্রনাথের কীর্তিকোষে রয়েছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে।
খুব ভালো লাগলো এই তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ। আর আপনার লেখার ধরনটিও ভারি আকর্ষণীয়।
ভালো লাগার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
প্রিয় অরিজিতদা,
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ব্রিটিশ সম্রাটের গুণকীর্তনে রচনা-মাঝে মাঝে ই প্রচারের আলোয় আসা,জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা,এই অভিযোগ কতটা অমূলক এবং অসার,তার প্রমানে প্রস্তুত তোমার দলিল এককথায় অসাধারণ ।
পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন,তাঁর প্রশস্তিতে গান রচনার অনুরোধ পাওয়া, এবং একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা গানটির রচনা – এ সবই সমসাময়িক , তাই এক সংযোগ সূত্রে বাঁধা । কিন্ত এই সংযোগ যে কেবল কাকতালীয় , আসলে তা গাওয়াই হয়নি রাজসমক্ষে সে কথা জানা থাকা সত্ত্বেও এবং বিশ্বকবির নিজের লেখায় এর দায় অস্বীকার করার কথা সুবিদিত থাকা সত্ত্বেও বারে বার এ প্রসঙ্গের অবতারণা করা যে কতটা অনর্থক, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
শুধু তাই নয় কবির উদ্দেশ্য এবং অভীষ্ট সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবহিত না হয়ে কেবলমাত্র সন্দেহের বশেই ‘জনগণমন অধিনায়ক ‘ গানটির মত এমন উদাত্ত, দেশবোধে উদ্বুদ্ধ রচনাকে জাতীয় সঙ্গীতের অযোগ্য বলে যারা ঘোষনা করতে চান ,তাদের সমক্ষে তোমার দেয়া ব্যাখ্যা ছাড়া আর কোন নতুন অকাট্য যুক্তিগ্রাহ্য দলিল পেশ করা যায়, তাও বোধ করি বোধের অতীত।
ব্রিটিশ সম্রাটকে ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ মেনে নিয়ে ‘জয় জয় জয় হে ‘ বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখছেন পরাধীন ভারতে, ১৯১১ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বসে, একথা শুধু আমি নয়, স্বাধীন ভারতের যে কোনো নাগরিকের পক্ষেই সহজভাবে মেনে নিতে প্রবল আপত্তি থাকার কথা।
কিন্ত নানা জাতি, নানা ভাষা, নানা পরিধান’ সমৃদ্ধ আমাদের দেশ ভারতবর্ষে অকল্পনীয় বলে অযৌক্তিক কিছু অনেক ক্ষেত্রেই নেই। বিবিধ মত পোষণ করার সুমহান সুযোগে, প্রমাণ থাক বা না থাক, কোনকিছু ধরে নেওয়াতে অথবা সে ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য রাখতে কোনও বাধা নেই। অতএব মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম হিসেবেই হোক অথবা শেষ পর্যন্ত লেখেন নি, কিন্ত লিখতে সম্মত তো হয়েছিলেন গোছের কুযুক্তি দেখানোতে রুচি রাখেন এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের কথায় কবি না হোন,তাঁর আলোচ্য কবিতাটি দোষযুক্ত। অতএব ত্যজ্য।
কিন্ত সঙ্গে সঙ্গেই ভাগ্যবান আমরা এই জন্যে যে, ‘বিবিধের মাঝে’ ,’মিলন মহান’ সেই প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ সমানভাবে আজও উপস্থিত এই দেশে। তাই মাঝে মাঝে বুদ্বুদের মত ফুট কেটে আলোচনার উপরিতলে চলে এলেও, এ প্রসঙ্গ ঠাঁই পায়নি জাতীয় স্তরের আলোচনায় এখনও।
আশার ওপর আশা রাখি,ভরসা রাখতে ভরসা পাই ,যেন এ কথা কেবল কথার কথা হয়েই থেকে যায়।আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের গায়ে আঁচড় না পড়ে।
অরিজিৎদা তোমায় আবার ধন্যবাদ এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে সুন্দর যুক্তিপূর্ণ লেখাটা আমাদের পড়ার সুযোগ করে দিলে।