কেন যে মন ভোলে

পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন কাগজে বা অন্য রকম খবরে প্রকাশ হয় প্রতারিত হবার ঘটনা। শুধু ব্যক্তিগত স্তরে নয়, গোষ্ঠীগত  এমন কি একটা গোটা জাতিও ঠকে যায় বিশ্বাস করে । নতুন কিছু নয়, অনাদিকাল ধরে এ খেলা চলছে নিরন্তর। তবু, প্রশ্ন ওঠে একবার নয়, একই লোক বা একই জাতি বার বার কেন ঝাঁপ দেয় একই ফাঁদে? অর্থাৎ ন্যাড়া এক বার যাক না, কিন্তু মাথায় বৃন্তচ্যূত বিল্বফল পতিত হবার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বার বার কেন যাবে বেলতলায়?

প্রথম কারণ নিজের অভিজ্ঞতার চেয়ে ম্যাজিকে বিশ্বাস – নম্বর তারাই পায় যারা পড়াশোনা করে, এ সত্য বারম্বার প্রত্যক্ষ করার পরও আমি ভাবতাম পরীক্ষার আগের দিন প্রাণীহত্যা (প্রধানতঃ মশা) না করলে ভাল হবে রেজাল্ট । এক বাংলাদেশী ছাত্র ইউটিউবে বলছিল, অঙ্কে খারাপ নম্বরের প্রতিকার হিসেবে তার বাবা বলেন দিনে কয়েক বার কোরানের একটি আয়াত আবৃত্তি করতে, পরে দেখা গেল সে ফেল করলো আর একটি হিন্দু ছেলে, যে আয়াতের খোঁজ রাখে না আদৌ- পেল ফুল মার্কস। সে ছেলেটি চরিত্রবলে আয়াতের মাধ্যমে অঙ্ক সাধনার পথ ত্যাগ করতে পারলেও আমি পারি নি। সারা স্কুলজীবন পরীক্ষার আগের দিন সমস্ত জীবের প্রতি করুণাসিন্ধু হয়ে থেকেছি।

দ্বিতীয় কারণ আলস্য। অন্য কেউ কাজটা করে দিক না- এই ভাবটি প্রবল হলে মানুষ প্রথমে ভগবান তার পরে তাঁর নীরবতায় সন্দেহগ্রস্ত হয়ে জোর গলায় কেউ ‘তোকে রক্ষা করব’ বললে তাকে ধরে ঝুলে পড়ে। সে রকম কেউ কাছাকাছি না থাকলে অনেক সময় মহাপুরুষ বা মহামানবী নিজেরাই তৈরি করে তার শরণ নেয় তাঁর।  

এ কথা সত্যি ‘কেউ শুনতে চায় না গর্ভযন্ত্রণার গল্প, সকলেই দেখতে চায় শিশুটিকে’। আটপৌরে হয়ে যাওয়া গাড়ী, প্লেন, প্রেসার কুকার, মুঠোফোন যখন পেয়ে যাই, তার পেছনে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম মনে পড়ে না। এমন কি  কেউ তা মনে করালে বিরক্ত হই না-হক। আস্তে আস্তে মনে হতে থাকে এগুলো অতি সহজ, তুড়ি মেরে করা যায় । 

সেখানেই শেষ নয়, আরো একটু সময় গেলে সুযোগসন্ধানীরা যখন বলে ‘কিস্যু হয় নি, এর চেয়ে অনেক ভাল হতে পারত।’ তাদের প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। যেমন ধরুন, ১৮৮৫ কার্ল বেঞ্জ-এর প্রথম মোটর গাড়ি, তার আঠারো বছর পর ১৯০৩ সালে রাইট ভাইদের প্রথম এরোপ্লেন শুনে ভাল কাপড় চোপড় পরা ডিগ্রিধারী বা সাধুবেশী ডিগ্রিবিহীন কেউ যদি বলে একটু অন্য ধরণের স্ক্রু ব্যবহার করলে এই আঠারো বছরের ব্যবধান আট দিনে নামিয়ে আনা যেত, তাকে বিশ্বাস করে হয়তো ‘ধীরে’ কাজ করে কোন নতুন আবিষ্কারের মুখে দাঁড়ানো কোন ইঞ্জিনিয়ারকে বিতাড়িত করে ওয়ার্কশপ সঁপে দিই তার হাতে। এর পর ঊর্ধমুখী আশা আর নিম্নগামী অর্জনের মধ্যে ফারাক যখন অতি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়, তখন অনেক দিন গত হয়েছে, পিছলে গিয়েছে অনেক সুযোগ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি বা বহু প্রজন্ম। 

তৃতীয় কারণ, আত্মপ্রেম। নিজে যা ভাবি তার ওপর আমাদের ভালবাসা আর আসক্তি তুলনারহিত। ‘সব কিছুরই ভাল-মন্দ  আছে’ মুখে বললেও, কোন কিছু পছন্দ হ’লে আমরা তার অ-পছন্দের দিকগুলো দেখতে পাই না।  একটু  ভাল’র আভাস পেলেই, ‘দ্যাখো কি দারুণ পছন্দ আমার’ ভেবে আত্মগর্ব অনুভব করি। এ রকম করতে করতে বিপদের জল গলা অব্দি ঊঠে গেলে ডুবতে ডুবতে বলতে থাকি, এটা সাময়িক ব্যাপার, শিগগির-ই ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু।

খুব ক্ষতিকারক “যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়”-ধরণের অন্ধ আনুগত্য। মহামানবদের এমন কি নিজের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ওপর একটু দ্বিধা, অল্প সন্দেহ জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। আইনস্টাইন অনিশ্চয়তা তত্ত্ব মানেন নি, নিউটন ইথারে বিশ্বাস করতেন আর, এক সময় মারী ও পিয়ের কুরি এক্স-রে আর তেজস্ক্রিয়তার অদৃশ্য বিকিরণ দেখে অদৃশ্য আত্মা ডাকার প্ল্যাঞ্চেট সভায় যেতেন। আমরা কি তাঁদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান?   

ন্যাড়া বেলতলায় যাওয়া ছাড়ে না, আমরাও চিরকালীন রাধা-কৃষ্ণের গান শুনি, বার বার একই স্বপ্ন দেখতে চাই। টিভি অ্যাংকর পাল্কি শর্মা উপাধ্যায় বাচ্চাদের প্রসঙ্গে বলছিলেন, ওরা রোজ  শোবার সময় একই কাহিনী শুনতে চায়। বলছিলেন আকর্ষণটা কথার চেয়ে বেশী কথাকারের প্রতি, তাঁর বলার স্টাইলের প্রতি। ঐ সব জায়গায় ঠিক আছে, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক ন্যাড়াদের কাজের প্রশ্ন শিকেয় তুলে স্টাইল-মুগ্ধতা বেলতলা গমনের রাজপথ।   

আসলে দিবাস্বপ্ন কেউ দেখায় না। আমরা দেখতে চাই বলে পর্দা, প্রোজেক্টর, সাউন্ড বক্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করে কিছু উপার্জন করে, কখনও পথে বসিয়েও বিদায় নেয়। রামপ্রসাদ তাঁর নিজের জন্য নয়, আমাদের জন্যই গেয়েছিলেন, “দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।“ 

    

About the author

Arijit Choudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.