গল্প নিয়ে গল্পগাছা
তোমার মতন এমন টানে কেউ তো টানে না- আদ্যিকাল থেকে মানুষের গল্পের প্রতি টান। বাস্তব, অবাস্তব, রাজা-রাণী, মুটে-মজুর, ডিটেকটিভ, এমন কি পরী, ডাইনী আর রাক্ষস- নির্বিচারে গল্প গেলা জাতিধর্ম নির্বিশেষে মানুষের অভ্যাস। কখনো কখনো শিকারী শিকার হয়ে যায় জানা ছিল, কিন্তু গল্পরাও উল্টো প্যাঁচে যে তাকে গিলতে থাকা মানুষকেই গিলে ফেলে, সে উপলব্ধিটি নতুন। উদাহরণস্বরূপ, একটু খোলা মনে ভাবলে দেখবেন যে অ্যান্টিবায়োটিক, কার্ডিয়াক কেয়ার, এরোপ্লেন, ইন্টারনেট, মরুভূমিতে নানা ফসল ফলানো গণতান্ত্রিক বর্তমানের চেয়ে উটের পিঠে চড়ে নানা উপজাতির সাথে লড়াই করা রুক্ষ জীবন ভাল ছিল- এই গল্প পুরো আরব দুনিয়া আর আফগানিস্তানের একদা উজ্জ্বল গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা আর স্থাপত্য সহ মেধাকে হজম করে ফেলেছে।
গল্পে ভাসি, ডুবেও মরি- ‘কিছু স্বপ্নে দেখা, কিছু গল্পে শোনা’- ছোটবেলায় এ রকম একটা গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি বলেন নানা রকম গল্প নিয়েই মানুষের জীবন। নোয়া হারারি’র আগে কথাটা এ ভাবে কখনো ভাবি নি। আর শোনার পর মহর্ষি সুকুমার রায়ের প্রদর্শিত পথে ‘পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়’ খেয়ে হারারিকে চিন্তা দৌড়ে অনেক পেছনে ফেলে অনুভব করলাম, ‘গল্প নিয়ে’ নয়, আমরা পছন্দসই গল্পের মধ্যেই বেঁচে থাকি। নিজের কথাই বলি- ছোটবেলায় বাবা প্রকাশ্যে আমার দ্বারা যে কিছু হবে না তা বারম্বার ব্যক্ত করতেন, শিক্ষককুল ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের ভাবে-ভঙ্গীতে সে বাণীর সাথে ভয়ানক দ্বিমত হবার লক্ষণ প্রকট না হওয়ায় আমি ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’ শীর্ষক গল্পটির মধ্যে বাঁচতে শুরু করি। বড় আনন্দে উজ্জ্বল বর্তমানের অতি আকর্ষণীয় খেলাধুলোয় প্রাণ ঢেলে দিই।
সব গল্প অবশ্য আনন্দের হয় না। তাদের অনেকে তো অতীত বা ভবিষ্যতের মরীচিকা দেখিয়ে বর্তমানের যেটুকু স্বস্তি- তাও কেড়ে নেয়। আরবের উদাহরণ আগে দিয়েছি। অনেক প্রতিভাবান নেশা করেন (ইউরোপের বুদ্ধিজীবিমহলে এক সময় কোকেন নেওয়া বেশ ফ্যাশনেবল ছিল), অতএব নেশা করলে প্রতিভা বিকশিত হয় এই গল্প প্রতিদিন অগুন্তি তরুণ প্রাণ খেয়ে ভূরিভোজ সেরে নিচ্ছে।
কাল, আজ পরশু’র গল্প– আজকের দিন হ’ল সাদা পাতা বা প্রকাশমান পান্ডুলিপি- দৃশ্যমান, অগোছালো। মনোমুগ্ধকর গল্পের প্রিয় ক্রীড়াভূমি সুদূর অতীত বা অদেখা ভবিষ্যৎ।
অতীতে দিন কাটত সুখে, আজকে আছ বড়ই দুখে। আমার পথে চললে পরে, সাঁতার দেবে সুখসায়রে।।
এ গান শুধু দুষ্টু মানুষে নয়, কি করে কি করা যায় সে সম্পর্কে জ্ঞানবিহীন ভাল মানুষও জোর গলায় গান। মানুষের আকাঙ্ক্ষা রকেট-এর চেয়ে দ্রুত ওপরে চড়ে। সাইকেল থেকে মোটরগাড়ি, মোটরগাড়ি থেকে এরোপ্লেনে ঝটিতি উঠে যাওয়া আজ সম্ভব দেখে চাকা আর জুতা আবিষ্কার করতে তথাকথিত সোনালী অতীতে কত শতাব্দী লেগেছে, গল্পের সেই ফাঁক নিয়ে ভাবতে রাজী নয় কেউ। বাস্তবে জীবন ঘষ্টে চললেও, গল্পে না উড়লে সহ্য হ’তে চায় না।
গল্পের ফাঁদ– সাবধান না হ’লে বহু গল্প অসহায় করে দেয়। তাদের ছাঁদে নিজেদের ঢালাই করার চেষ্টায় মানুষ আর দেশ কখনো উড়ান দেয়, কখনো তলিয়ে যায়। আবার প্রিয় গল্পগুলো ঠিক শূন্যে ঝুলে থাকে না, তাদের শিকড় থাকে বাস্তবের জমিতে। যেমন ধরুন, রবি-শরৎ-সুকুমার-নজরুল-বিভূতিভূষণ-সত্যজিৎ পড়ে বাংলার বাইরে অনেকের ধারণা, প্রতিটি বাঙ্গালীই সংস্কৃতিবান। সে কথা শুনে, ‘সংস্কৃতি’ শব্দের ‘স’-টি কেমন দেখতে তা নিয়ে ধন্দ বুকে নিয়েও নিজেকে একটু অন্য রকম দেখাতে চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ না-ই বা হলাম, তাঁর মত জোব্বাটি পরতে দোষ কি? উঠতি যৌবনে আমার জেঠতুতো দাদা বেশ কনভিনসিং স্বরে বললেন, বাঙ্গালী পুরুষমাত্রই কবিতা লেখে। সেই গল্পটি শুনে বাঙ্গালী-পুরুষত্ব অর্জনের নিভৃত প্রচেষ্টায় বহু দিন নষ্ট হয়েছে আমার।
মজার কথা হ’ল, যাঁরা গল্প ছড়িয়ে নিজেদের ঐহিক-পারত্রিক উদ্দেশ্য সাধন করতে চান, তাঁরা জানেন সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে না পারলে গল্প বড় হয় না, এগোতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাধারণ জার্মানরা বিশ্বাস করেছিল, সত্যিই তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাত, আর তাদের তাঁবে থাকলেই বাকি সব মানুষের কল্যাণ। বিশ্বাস প্রথমে নম্র থাকলেও অনেক মানুষ তার পেছনে জুটে গেলে মারকুটে হয়ে ওঠে। এখনকার শিয়া-সুন্নী লড়াই, সপ্তদশ শতকে তিন দশক ধরে ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট যুদ্ধ তার প্রমাণ। এই দুটি এবং আরও বহু ক্ষেত্রে মানুষ বিশ্বাস করেছে ঈশ্বর তাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁরই সৃষ্টি করা অন্য মানুষদের ধ্বংস করার জন্য। এ গল্পে বিশ্বাসের আরেকটি স্তর হ’ল ঈশ্বর নিজে পাপীদের শাস্তি দিতে অক্ষম, তাঁকে সাহায্য করা প্রয়োজন। মানে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান আখ্যাটি মুখে উচ্চারণ করে কাজে সেই গল্পটিকে অস্বীকার করা। দেশ পর্যায়ে এখনকার রাশিয়ানরা পুটিন-এর নেতৃত্বে পিটার দ্য গ্রেট-এর সাম্রাজ্য পুনস্থাপনের গল্পে মজে যা করছে তাতে এ পর্যন্ত প্রায় চার লক্ষ রাশিয়ান যুবকের প্রাণ গিয়েছে।
তারই মধ্যে মন্দ-ভালো- গল্পের ভাল-মন্দ আছে। আবার ভাল গল্প চলতে চলতে মন্দ হয়ে যায়। মন্দও ভাল হয়। যেমন ধরুন, আগে গল্প ছিল জনসংখ্যা বাড়ছে, খাবার-থাকার সংস্থান থাকবে না। দ্বিতীয়টি ঘটে নি, কিন্তু প্রথমটি- লোক কমলে জীবন ভাল হবে বিশ্বাস করে দেশ চালাতে গিয়ে জাপান, ইতালি, স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার জনগোষ্ঠী আজ বিলুপ্তির মুখোমুখি। তারা এখন তাদের বয়স্কদের দেখভাল করা থেকে ল্যাবরেটরি চালানোর জন্য ভারতের মত দেশগুলির দিকে যতটা তাকিয়ে আছে, ইয়েমেন, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের দিকে ততটা নয়। গোষ্ঠী নিরপেক্ষভাবে ভারতীয়দের সম্পর্কে চালু গল্প হ’ল- ওরা শিক্ষিত, নরম প্রকৃতির, নানা সম্প্রদায় প্রতিবেশী হয়ে থাকে, অন্যদের মত উগ্র নয়, মানিয়ে চলতে পারে। এই অবস্থাতে ভারতীয়দের এক গোষ্ঠী আবার উল্টো আর এক গল্পে বিশ্বাস করে বসেছে। তাদের মতে এই শান্তিতে থাকাটা দুর্বলতা- আত্মপ্রবঞ্চনা ধরণের কিছু। মারামারি করে তা থেকে বেরোতে না পারলে দীর্ঘস্থায়ী স্বস্তি অসম্ভব।
অতঃ কিম- একই বিষয়ে সোজা, উল্টো আর বিমিশ্র গল্পের মধ্যে কোনটাতে বাঁচব তা বেছে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবন। গল্পের বাইরে বাঁচা অসম্ভব। তাই, হারারি উপদেশ দিচ্ছেন, চলতে থাকা গল্প অসুবিধেজনক হলে তাকে বদলে অন্য গল্পে ঢুকে পড়তে হবে। আফ্রিকার দেশ রোয়ান্ডা গল্প বদলানোর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯৯৪ সালে হুটু আর টুটসি উপজাতির মধ্যে লড়াই-এ ওই দেশে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আর এখন রোয়ান্ডা আফ্রিকার শান্তিপূর্ণ আর প্রগতিশীল দেশগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য।
আগে…আম্বেদকরেরও আগে গল্প ছিল (এখনও চলছে সে আখ্যান) নীচু জাত আর মেয়েদের পড়াশোনা হবে না। বিধবাদের বিয়ে হ’লে শুধু কেলেংকারি নয়, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি হবে। ইংরেজরা ভারতীয়চরিতমানস গেয়ে বলেছিল, নেটিভদের দ্বারা দেশ চালানো সম্ভব হবে না- এসব গল্পকে বদলাতে বদলাতেই ভারতের প্রগতি। ওন্য দিকে দাড়ি-আলখাল্লা পরা লোকেরা সান্ত্রী-মন্ত্রী হয়ে মেয়েদের ঘর বা বোরখাবন্দী করে নিলেই মহাসুখে ঐক্যবদ্ধ কালাতিপাত…ইত্যাদি গল্পে সামূহিক বিশ্বাস আফগানিস্তানের মত দেশের অধোগতির কারণ।
শুধু দেশ নয় গল্প বদলানোর ব্যক্তিগত উদাহরণ ভূরি ভূরি। সর্বভারতীয় চাকরিতে জয়েন করার পর কিছু দপ্তরী পণ্ডিত বললেন- শিখ পাঞ্জাবীরা যেমন ভাল, অ-শিখ (মোনা) পাঞ্জাবীরা তেমনই খারাপ। ক’দিন আগে মারা গেলেন রমেশ কালরা। মুম্বই-এর বিপিসিএল-এ জয়েন করার পর থেকে দিল্লি অফিসের হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের কালরাসাহেব নিজে থেকেই বন্ধু হয়ে গেলেন। পরে দেখি উনি গোটা অফিসের ভরসা। ন’বছর দেশে-বিদেশে যখন যেখানে গেছি, কালরাসাহেবের অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করেছি। তাঁর জীবন উল্টে দেয় মোনা পাঞ্জাবীরা খারাপ হয় আর পাবলিক সেক্টরের মানুষ অফিসের কাজের ব্যাপারে উদ্যমহীন হ’ন এই দুই বিপরীত হীনমন্যতার গল্প ।
আবার হারারির কথা- মানুষ বাঘ, সিংহ, গন্ডার, জিরাফ এমন কি গরু-ঘোড়ার চেয়েও শারীরিকভাবে এত দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর বাকি সবার ওপরে ছড়ি ঘোরাতে পারার কারণ বাড়িতে, পাড়ায়, দেশে, বিদেশে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি। কিন্তু, মাথায় নড়তে থাকা পোকা বলতে থাকে আণবিক বোমাগুলো পড়ে আছে, কাজে লাগালে ঝটপট আরও বড় হবি।
এই তাড়াতাড়ি আরও বড় আর ভাল হওয়ার ‘হঠাৎ নবাবী’ গল্প শুনলেই নিজেদের আজকের জমিটা আঁকড়ে ধরা ভাল। সেটা করতে ভুলে গিয়েছিল আফগানরা।
ওমর খৈয়াম সাবধান করেছেন, “পাচ্ছো যাহা নাও বাপু রে, কান দিও না স্বর্গসভার বাজনাতে যা বাজছে দূরে।”
আগামী দিনের অনেক ভয় আর একটু আশা মেশানো এক বন্ধু’র গল্প এই রকম- যে দিন পৃথিবীর কোথাও যেতে কিংবা বসত করতে ভিসার প্রয়োজন হবে না আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি । সে দিনটি আসবেই… ওরা (তথাকথিত শক্তিধর মানুষ) নিউক্লিয়ার যুদ্ধে পৃথিবীর বেশীর ভাগ জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে ফেলার পর ভাগ্যবান যে ক’জন বেঁচে থাকবে তারা আবার চিন্তায় যুক্তি আর পারস্পরিক সম্প্রীতি ফিরে পেয়ে আনন্দে বেঁচে থাকবে।*
সেই ভয়ঙ্কর বিশ্বব্যাপী ধ্বংসের অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে কি? পৃথিবীতে আজ খাদ্য, ওষুধের অভাব নেই। সহযোগিতার গল্প লেখার এই তো সময়। নববর্ষে বিশ্বময় নানা ভাষায় সেই কাহিনী লেখা হতে থাক।
৩রা জানুয়ারী, ২০২৪ -অরিজিৎ চৌধুরী
*I am wishing for a day when no Visa would be required for travelling and settling in any part of the world. It will certainly happen oক্লne day Chaudhuri Saab…. They will destroy most of the population waging nuclear wars and the few lucky ones to survive will start to think logically and live in harmony. -D. Rajeshwaran, Geophysicist, Company Director
About the author
Arijit Choudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
Congratulations on scribbling a wonderful script for a peaceful New Year. Maintaining a good and constructive relationship, especially with our neighbours is important to preserve peace in the region. The concept of shared prosperity may be added to our foreign diplomacy. The philosophy is that no one can be happy to live comfortably when her neighbours are in distress..
.
Very well said. There is no alternative to friendship.
Thanks for liking the blog