বিনি পয়সার ভোজ  

সেই তো চাই, সেই তো চাই- 

বিনামূল্যের (মুফৎ) জিনিষের প্রতি চিরকালের টান আমাদের, এতটাই- যে দোকানদারেরা এক হাজার টাকার অমুক কিনলে ১৫ টাকার তমুক এমনি পাবেন শুনলে মুক্তকচ্ছ হয়ে কিনতে ছুটি। আমার এক সিনিয়র দাদা বলতেন বিনে পয়সায় দিলে ঊনিশ অব্দি কিছু না ভেবেই খেয়ে ফেলি, বিশ (বিষ) দিলে একটু চিন্তা করে সেটাও উদরসাৎ করি। মনের নীতিবাগিশ বলে রোজগার করে খাওয়া উচিৎ, আর সেখানেই আবছায়াতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ছুঁকছুঁকে লোকটি বলে, সেই শিশুকাল থেকে কত উচিৎ মেনেছ হে? চিরকাল বিনে পয়সার ভোজ খেয়ে এখন শ্রমের মূল্য নিয়ে কচকচি করে কি লাভ? যা পাচ্ছ নিয়ে নাও, নয় ঠিক পস্তাবে। 

যত দিকেই চাই মুফতের শেষ নাই-

বেয়াদব ঘুপচিবাসী আমি’টির সাথে কথা এই রকম গড়ালো।

-চিরকাল বিনে পয়সার খাচ্ছি, কি ভাবে বল দিকি? 

– ইস্কুলে মাইনে দিতে মাসে সাড়ে পাঁচ টাকা। তার থেকে মাস্টারমশাইদের দূরের কথা, আর্দালি-দারোয়ানেরও মাইনে হয় না। তার ওপর ওই মাইনে থেকেই রোজ টিফিন- জোড়া কলা, কখনও চারটে বিস্কুট অথবা দানাদার আরও যখন যে রকম। বিনি পয়সা নয়? তার পর কলেজ/ইউনিভার্সিটি তো বারো টাকা/আঠারো টাকা দিয়ে কাটিয়ে দিলে। ওগুলো কি পয়সা দিয়ে পড়া হ’ল?

যে বারম্বার ঠিক কথা বলছে তার সাথে কথা কাটাকাটির মত বিরক্তিকর কাজে আমার আগ্রহ চিরকাল কম, তাই এই সময় আমাদের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। বিনি পয়সার সাহায্য ছাড়া আমার কিছু হ’ত কি না মনের মধ্যে এই চিন্তা ঘুন্‌ ঘুন্‌ করতে থাকে। 

পরে মনটাকে ছড়িয়ে দেখি, সারা দুনিয়ায় মুফতের মেলা।

শিশুকাল থেকে কর্মক্ষম হওয়া পর্যন্ত মুফতের মাল পেটে ঢালা ছাড়া উপায় নেই। তার পরেও নানা পেশায় লাগানোর জন্য পড়াশোনাটা পৃথিবীর অনেক দেশ (আমার ইদানীং দেখা চেক রিপাবলিক) বিনি পয়সায় বা সেটির অন্য নাম স্কলারশিপ দিয়ে ব্যবস্থা করে দেয়। ভারতেও সরকারী স্কুলগুলিতে মুফতে পড়ানো হয়।

পেশাদার জীবনে মুফৎ-

নিজের ব্যবসা না হলে, চাকরি একটি চুক্তি ছাড়া কিছু নয়। তাতে প্রধানতঃ থাকে মাইনে আর চিকিৎসার সীমিত প্রতিশ্রুতি। কিন্তু, প্রায় প্রতিটি চাকুরিজীবি যাতায়াতের সুবিধা, ইউনিফর্ম, ফোন, অফিসে খাওয়া, ছেলেমেয়ের পড়ানোর খরচ, বোনাস, হাতব্যাগ ইত্যাদি যা পান তার অনেকগুলিই ‘মুফতের মাল’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সম্ভব। বিশ্বাস না হলে গরীব সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞাসা করুন, তাদের অনেকের ইউনিফর্মের দাম মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হয়। বহু দশক আগে লেখা অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্র’র বই ‘আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক’ পড়লে মনে হয় মূল মাইনের চেয়ে সংগঠিত ক্ষেত্রের (সে সময় অধিকাংশই সরকারী) কর্মচারীদের প্রতি মানুষের ঈর্ষা এই সব বিনি পয়সার উপরির কারণে।   

 

বুঝলুম, কিন্তু আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা দই, বিনি পয়সার নেপো মারবে কেন-

গরীব মানুষ মরলে বড়লোকদের কোন প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয় না। ইউরোপ-আমেরিকাও হয়তো ভাবতো চীনে আবহাওয়া নোংরা হলে আমাদের কি? পরে তারা বুঝতে বাধ্য হয়েছে যে অন্যদের দুর্দশায় রেখে বড়লোকদের দীর্ঘদিন স্বস্তিতে বাঁচা অসম্ভব। ভারতের উদাহরণ- কাজের লোক বস্তিতে থাকে, ভাল ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই, হাতুড়ের কাছে বা ওষুধের দোকানে নিজে বা বাচ্চাকে নিয়ে যায়। এরা স্টেরয়েড বা দু’একটা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরে শরীরে ড্রাগ রেজিসট্যান্ট অসুখ দানা বাঁধে, যেটি নানা ভাবে মালিকের ঘরে সংক্রমিত হয়। কখনও তা ঘরের বাতাস থেকে শ্বাসনালীতে ঢোকে, কখনো ঢোকে সরাসরি শিরায়-শোণিতে। বাবু-বিবির অ্যানিমিয়া হলে তারা রক্ত দেয় যে।

অমর্ত্য সেন বলেন, একজন লোক অসুস্থ হলে, শুধু সে-ই যে কাজ করা ছেড়ে দেয় এমন নয়, অন্ততঃ আর একটি লোকও তাঁর সেবার জন্য আটকে পড়ে। এরকম হ’লে বড়লোকদের কাজের লোকের টান পড়ে।

বিদেশী পরিস্থিতি- আফ্রিকার বা পূর্ব ইউরোপের একটি প্রতিভাবান মেয়ে বিনি পয়সায় পড়তে বা খেতে না পেরে দেহপসারিণী হয়ে এইডস-এর খপ্পরে পড়লো (সাবধানতার পাঠ কেউ পড়ায়নি তাকে), ইউরোপে ঢুকলো আর অজান্তে সংক্রমিত করে ফেললো অজস্র উন্নত দেশের মানুষকে। 

অতএব নিশ্চিন্তি। পরকালে নয়- যেটুকু করিবে দান, জীবনেই পাবে তাহা ফিরে।

আরও একটি মজার পরীক্ষা হয়েছে রাজস্থানের উদয়পুরে। সেখানে মায়েরা বাচ্চাদের বিনা পয়সার ভ্যাকসিনেশন দিতে চান না, নার্স সারা দিন বসে থাকেন। ঠিক হ’ল এক কিলো ডাল দেওয়া হবে। অর্থসচেতন বললেন খরচা বাড়বে, তা ছাড়া পরিমাণটা বড় কম, আধ দিনের মজুরিও নয়, তাতে কেউ আসবে কি সন্দেহ। নীতিবাগিশের মত- ভাল কাজ লোভ দেখিয়ে করা অনুচিৎ, বুঝিয়ে করতে হবে। কিন্তু এক কিলো ডাল পাশা উল্টে দিল, ভ্যাকসিনেশন-এর হার ৬% থেকে এক ধাক্কায় ৩৮%-এ পৌঁছে যায়। যেহেতু, ভ্যাকসিনেশন-এর বুথ ইত্যাদির খরচ একই থাকে, এর ফলে প্রতি ডোজের খরচও কমে গেল অনেক।   

ওরা অলস হয়ে যাবে যে 

কেনিয়ার পশ্চিম দিকে লেক ভিক্টোরিয়ার পাশে অতি গরীব মানুষের বাস, তাদের ৮৫% ভরপেট খেতে পায় না। ক্যালিফোর্নিয়ার এক এনজিও সেখানকার গ্রামগুলিকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে। ৪৪টি গ্রামের প্রথম গ্রুপকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ১২ বছর ধরে দিনপ্রতি স্থানীয় টাকায় আমেরিকার ৭৫ সেন্ট-এর তূল্যমূল্য দেওয়া হবে, দ্বিতীয় গোষ্ঠীর ৮০টি গ্রামে ঐ পরিমাণ টাকা দু’বছর দেওয়া হবে, এবং বাকি গ্রামগুলিতে কোন টাকা দেওয়া হবে না। দু’বছর পরের প্রাথমিক ফলাফলে, টাকা পাওয়ায় অলস হবার কোন প্রমাণ ফুটে উঠছে না, বরং তারা বেশি কাজ করছে। টাকা পাওয়া গ্রামগুলিতে, না পাওয়াদের তুলনায় চাষ-আবাদের (প্রথাগত) বাইরে কিছু করা যেমন দোকান, পোলট্রি, পশুপালন ইত্যাদি অনেক বেশী গড়ে উঠেছে, সাহায্যের পরিমাণ বাদ দিয়েও তাদের আয় টাকা না পাওয়া গ্রামগুলির তুলনায় প্রায় ২০% বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া দেখা যাচ্ছে যেখানে ১২ বছর টাকা পাওয়ার নিশ্চিন্ততা আছে, সেখানকার মানুষের নতুন উদ্যমে আগ্রহ অনেক বেশী, তারা আগের চেয়ে ভাল খাবার খাচ্ছে, মানসিক ভাবেও তারা বেশি সুখী। কিন্তু, যারা দু’বছর টাকা পেয়েছে তাদের প্রবণতা নতুন কিছু করার চেয়ে টাকা জমানোর দিকে।  

ভারতে আয়বৃদ্ধি

অর্থনীতিবিদ আঙ্কলেশ্বরিয়া আইয়ার লিখছেন, গত দু’বছরে জনপ্রতি আয় ও তজ্জনিত কেনার ক্ষমতা না বাড়লেও তেল, সাবান, বিস্কুটের মত সস্তা ভোগ্যপণ্যের বিক্রি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবারের জন্য মাসে পাঁচ কেজি বিনি পয়সার খাদ্য, কেন্দ্র, অন্ধ্র, ওড়িশা (ও পশ্চিমবঙ্গ) সরকারের গরীবদের হাতে সরাসরি টাকা তুলে দেবার প্রকল্পগুলির ফলে আলস্য বাড়ে নি। গত পাঁচ বছরে কর্মরত পুরুষের শতকরা হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২% থেকে ৭৬%, আর মহিলাদের ২৩.৭% থেকে ৪০.৩%। এর ফলে মাইনে না বাড়লেও পরিবারের আয় বেড়েছে। আইয়ারের মতে করোনা পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ এই মুফতের ওপর ভর দিয়েই সামলে উঠেছে।

আমাদের দেশে সাধারণতঃ পুরুষ-মহিলার মৃত্যুর হার এক রকম হলেও অনাবৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে খাদ্যাভাব ঘটলে তাঁদের কম খেতে দেওয়া বলে হয় মহিলাদের পুরুষদের থেকে বেশি হয়। ভারত প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক অর্থনীতির প্রবন্ধগুলি পড়লে আর স্থানীয় লোকদের সাথে আলোচনা করলে দেখবেন, মেয়েদের জন্য সাইকেল, কন্যাশ্রী’র টাকা, বিনি পয়সায় বাসের টিকিট এই ক্ষেত্রটিতে নীরব পরিবর্তন আনছে। বাস্তব জীবনে কোন কিছুই নিখুঁত হয় না, এ সত্যটি মেনে নিলে বোঝা যায় পূর্ণ সফলতার ধারে কাছে না পৌঁছতে পারলেও কেন্দ্রীয় সরকারের উজ্জ্বলা যোজনা গ্রামের মেয়েদের মধ্যে যে একটু ভালভাবে বাঁচার, সামান্য স্বাচ্ছন্দ্যের যে আকাঙ্খার জন্ম দিয়েছে তার ফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। একই কথা বলা যায় দিল্লীর সরকারী স্কুল বা মহল্লা ক্লিনিক সম্বন্ধেও। 

দেশে-বিদেশে রাজনীতিকরাও এ কথা জানেন, তাই তাঁরা অন্যদের মুফতের নিন্দা করলেও নিজেরা সেই পথেই যাত্রা করেন। আমেরিকা সরকার সাধারণ ভাবে সাবসিডি’র বিরুদ্ধে, কিন্তু দেখছি ২০২০ আর ২০২১ সালে ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে তারা সেখানকার নাগরিকদের সরাসরি ৯৩১ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। শিশু-যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ৩৩৪ মিলিয়ন আমেরিকানদের মধ্যে ভাগ করলে জনপ্রতি অনুদান দাঁড়ায় প্রায় ২৮০০ ডলার (প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা)। 

শেষ কথাটি

বৃক্ষের আসল পরিচয় তার ফলে। তাই ফলটি অভিপ্রেত হচ্ছে কি না নজর রাখতে হবে সেই দিকে। যেমন ধরুন, কেনিয়ার দু’বছর পাওয়া গ্রামগুলিতে টাকা দেওয়ার সময় দীর্ঘায়িত না করলে ঈপ্সিত ফললাভ হবে না। 

মুফৎ কা মাল সব সময় দরিয়াতে লীন হবে এ ভাবনাটি ঠিক নয়। বিশ্বময় ব্যবহারিক অর্থনীতির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এ কথা প্রমাণিত যে, একান্ত গরীবদের অর্থসাহায্য দেওয়ার ফলে গড় হিসেবে তাদের কাজ করার উৎসাহ বাড়ে, সমাজের সকলেরই ভাল হয়। তাই সরকার বাহাদুর যদি গরীবদের কিছু টাকা, ওষুধ কম্বল বা মশারি দেন, ডাকাত পড়িল মোর ঘরে- ধরণের আতঙ্ক নিষ্প্রয়োজন। 

 

২৪শে জানুয়ারী, ২০২৪                                                                   -অরিজিৎ চৌধুরী 

তথ্যসূত্র

  • Poor Economics, Abhijit Banerjee and Esther Duflo, BBS Public Affairs, New York, 2011
  • The Argumentative Indian, Amatya Sen, Allen Lane, 2005
  • Kidhar K-Shaped Recovery- S A Aiyaar, Times of India, 17th January, 2024
  • The Promises of Elusive Maharanis, and no-strings-attached money, Tasting Economics, Abhijit Banerjee, Times of India, 7th January, 2024

About the author

Arijit Choudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.