সেই বয়েস নিয়ে পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে আড্ডা হচ্ছিল। প্রায় সকলেরই গল্প – আহা, আমরা কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। অথচ আমার সেই বালক থেকে কিশোর, থেকে তরুন হওয়া এক দু:সহ ইতিহাস। সুকান্ত ঠিকই বলেছিলেন, সে সময় বড় যন্ত্রণার ক্ষতচিহ্নে ভরা। একটা কাহিনী বলি-
একদিন স্মৃতির অ্যালবাম খুঁজতে খুঁজতে একটা ছবি উজ্জ্বল হয়ে কোনা থেকে বেরিয়ে এল। আমার ছোটবেলার পাড়ায়, বীরেন্দ্রনগরের রাস্তার মোড়ে, অনিরুদ্ধর বাড়ির সামনে দিয়ে ভিলার পশ্চিম প্রান্তের শেষ রাস্তা দিয়ে বেরোলেই, মিল্ক কলোনির রাস্তা পেরিয়ে অন্য কোণে একটা দোকান হয়েছিল, ‘রাজার দোকান’।
এই দোকানটা হওয়া মাত্রই আমার পরিবারের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর বাড়ির দোকান রেশন, দুধ আনার দায়িত্ব আমার ছিল, তাই আমারও প্রিয়। এই ভালো লাগার কারণ বোধহয় মালিকের ব্যবহার। জনতা স্টোরের গোমড়া মুখের বেচাকেনার চেয়ে অনেক ভালো। আর মালিক এক মধ্য যুবক, সুন্দর চেহারা, আর পাড়ার সবাইকেই চিনত, জিনিস বেচার সাথে সাথে হাসিমুখে সকলের খবরাখবর নিত। অবশ্য আমার বাবার পছন্দের কারণ এখন ঝাপসা ভাবে মনে হয় দোকানদার হাসিমুখে ধার দিত, আর আমরা গরীব ছিলাম।
যাই হোক, ভনিতা ছেড়ে আসল কাহিনীতে আসি। একদিন রাজার দোকানে গেছি পাঁউরুটি কিনতে। ভিড়ের ভেতরে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছি কাউন্টার ধরে, কখন মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো। তখন বোধহয় ১১তে পড়ি, বেশ একটা কেউকেটা অনুভূতি নিয়ে আছি। আগেই বলেছি, আমার যেখানে সেখানে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার অভ্যেস ছিল। কাউন্টার ধরে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, ‘জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার, হৃদয়ে আমার চড়া/ চোরাবালি আমি, দূর দিগন্তে ডাকি, কোথায় ঘোড়সওয়ার’’….!
এর সঙ্গে মনে করিয়ে দিই, তখন আসামে ‘বাঙালী খেদাও’ চালু হয়েছে। রোজকার আনন্দবাজারে ভয় দেখানো লোটাকম্বল সম্বল করে দলবদ্ধ পালিয়ে আসার খবর।
হঠাৎ চমক ভাঙলো, আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ক্রেতারা কেনাকাটা করে প্রায় চলে গেছে, বেশ ফাঁকা হয়েছে। এক কিশোরী, আমার পাশে কাউন্টারএ পৌঁছেছে। দোকান মালিকের সরাসরি প্রশ্ন, মুখে মৃদু হাসি নিয়ে- ‘ তুমি এখানে নতুন এসেছ? আগে তো দেখিনি?’
মুখ নীচু লজ্জিত কিশোরী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ করলো, দ্বিতীয় প্রশ্ন, অবশ্যই হালকা হাসির সাথে, দোকানদারের- ‘কার বাড়িতে?’
মেয়েটি বীরেন্দ্রনগরের কোনো পুরনো বাসিন্দার নাম করল। তৃতীয় প্রশ্ন- ‘বেড়াতে?’ ছোট্ট লাজুক উত্তর- ‘হ্যাঁ’, তারপরেই সেই অমোঘ প্রশ্ন, যা সব কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিল- ‘কোথা থেকে এসেছ?’ উত্তর এল ‘আসাম’। দোকানদার উচ্ছল হয়ে উঠল, যেন বিরাট তামাসা করেছে প্রশ্ন করল- ‘ও, তুমি আসামী, ওই যেখানে তোমরা বাঙালী পেটাচ্ছ, এখানে আমরা যদি এখানে তোমাদের পেটাই?’……
ক্ষণকালের নীরবতা, কিশোরীর বিব্রত ঘাড় আরো নীচু! আমার আর সহ্য হ’ল না, যে এক অদৃশ্য রেখা তৈরী হয়েছে, যেখানে এই হালকা চালের বিদ্রূপ ঘন হয়ে মোটা দাগের হয়ে উঠেছে! আস্তে করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে দোকানদারকে বললাম- ‘ওদেশে তো এরাই মার খাচ্ছে, এখানেও ওদের মারবেন?’
…..এক ধাক্কায় ভেঙে গেল এক অসহ্য চাপা অবস্থা! দোকানদার সহকারীদের দিকে ব্যস্তভাবে তাকিয়ে মেয়েটিকে জিনিস দিতে বললো, আর আমাকে বলল-‘ কি চাই? পাঁউরুটি? এই যে!’
কিন্তু যা হবার তা এর মধ্যেই হয়ে গেছে! সচকিতা কিশোরী চোখ তুলে আমার দিকে চেয়েছে! সে কি প্রেক্ষণা! কৃতজ্ঞ, মায়াময় হরিণী আঁখি। কত মুহূর্ত! জানি না! সে তার জিনিস নিয়ে রওনা হল, আমি আমার সকালের জলখাবার, কোয়ার্টার পাউন্ড নিয়ে!….
আর কিছুই নেই এরপর, সেই ক্ষণিকের স্মৃতিচিহ্ণ, সেই আঁখিপাত ছাড়া। একলা নির্জন গলিপথ ধরে, রাস্তার এবড়োখেবড়ো নকশায় জীবন খুঁজতে খুঁজতে আমি ফিরছি। মনে ভেসে উঠছে এক উপলব্ধি। আমি জানি, খুব জানি, প্রেমের কবি ‘তুমি’ লিখলেও সে ‘’আমি’ – ‘যে পথে যেতে হবে, সে পথে *আমি* একা/ নয়নে আঁধার র’বে, ধেয়ানে আলোকরেখা….!’
তবু আজও – , সে মুখ মনে পড়ে না – কিন্তু সেই ক্ষণিকের চাওয়া – প্রথম বিদ্যুৎস্পৃষ্টতার মতো স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
ভুলি নাই, ভুলি নাই….. ভুলি কি করে?
Well come to our restored website.
Thanks to all of you for posting.
Thanks Rohirjee, CEO, web manageme.