যোগ দিবস’ নিয়ে আমাদের ছোটবেলায় এখনকার মত মাতামাতি না থাকলেও বাড়িতে মেজকাকার কল্যাণে নানারকম  ব্যায়াম আর আসন দেখতে পেতাম। তখন তিনি শক্তপোক্ত শরীরে আজীবন ব্যাচেলর থাকারই পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবা জীবিকার জন্য ছুটতেন। ছোটকাকা এবং তাঁর নীচে আমরা তিন ভাই প্রধানতঃ খেলার মাধ্যমে শরীর গঠনের সঙ্কল্পে স্থির ছিলাম। দিন ভাল কাটছিল না বলাটা মিথ্যে হবে। বাড়ীর অন্য দু’জন ক্রীড়াসক্ত (ছোটকাকা ও মেজদা) দৈহিক দীর্ঘত্ব অর্জন করলেন। ক্রীড়া বিষয়ক উন্মাদনা সত্ত্বেও সে ব্যাপারে আমার প্রগতি আটকে থাকতে দেখে এক সিনিয়র দাদা যখন আমাকে স্নেহচ্ছলে ‘বেঁটে পাগলা’ উপাধিতে ভূষিত করলেন, কেউ ঈর্ষান্বিত বা বিস্মিত হলেন না, আমিও ওই ডাকে সাড়া না দেওয়া বা উষ্মা প্রকাশের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। 

 

ঘোর বিপর্যয়-

সব কিছু ঠিকই চলছিল হঠাৎ আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট পিসতুতো বোন ছুটিতে আসায় আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করলাম, যে সে আমার মাথা ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, তখনও পশ্চিমবঙ্গের পুরুষতন্ত্রের বিষদাঁত শিক্ষিত মেয়েদের চাপ আর ৪৯৮ আইনের প্যাঁচে বে-হাল হয় নি। ছেলে বন্ধুদের কাছে হারতে লজ্জা নেই, কিন্তু কোন ব্যাপারেই মেয়েদের কাছে হেরে যাওয়া বড় লজ্জা ও বেদনার ব্যাপার ছিল। তাই, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  

 

প্রতি-আক্রমণ- 

বোনের কাছে হেরে যাবার প্রতিকার খুঁজতে মরীয়া হয়ে উঠলাম। বইয়ের দোকানে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম আয়রনম্যান নীলমণি দাশের লেখা বই ‘উচ্চতা লাভের উপায়’। বইটির মধ্যে ছিল নানা রকম খালি হাতে ব্যায়াম আর অনেক আসন। 

তখন আমার বয়স বোধ হয় ১২-১৩ বছর। বাড়িতে বা বন্ধুদের কাউকে না বলে নিজের জমানো পয়সা দিয়ে কিনতে হয়েছিল। যতদূর মনে আছে তাতে লেখা ছিল, যতই টানাটানি করা হোক না কেন ১৮ বছরের পর আর লম্বা হওয়া যাবে না। সে সময় দুঃস্বপ্ন ও আতঙ্কতাড়িত আমার প্রায় পাঁচ বছরব্যাপী উচ্চতাবর্দ্ধনের যে ঐকান্তিক সাধনা শুরু হল তা থামল সেই ভগিনীটিকে ছাড়িয়ে নিরাপদ উচ্চতায় পৌছনোর পর। শবাসনটা জন্মাবধি আয়ত্তে ছিল। ততদিনে আমি সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসন, ধনুরাসন, ময়ূরাসন, ভুজঙ্গাসন, ঊষ্ট্রাসন এমন কি শীর্ষাসন সহ গুচ্ছের আসন শিখে ফেলেছি। 

 

খেই হারানো-

স্কুল থেকে কলেজে ঢুকে চুঁচুড়া-কলকাতা ডেলি পাষন্ড (প্যাসেঞ্জার) হতে হল, আর আসন ব্যায়ামের পাট চুকিয়ে আমি শরীরের নাম মহাশয় ভাবতে শুরু করলাম। অনিয়মিত খাওয়া, ব্যায়াম বর্জন ইত্যাদি দেখে শরীর কিছুদিন সময় দিল ঠিকই, কিন্তু এক বছর পর ধরলো ফুসফুসের হাঁপানি (ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা)। প্রথমে একটা দুটো ওষুধ, পরে স্টেরয়েড আর সব সময় পকেটে ইনহেলার নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে জীবনের রঙ বদলে সাদা-কালো হবার দিকে এগোল। রোজ রাতের সঙ্কটে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল এমএসসি’র সেকেন্ড ইয়ার-এ। বাড়িতে অবস্হা বেশ খারাপ হওয়ায় দাদা আর বাবা কোথাও থেকে খোঁজ পেয়ে আমাকে এক মাসের জন্য বরানগরে শিবানন্দ যৌগিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন।

 

কী আনন্দে শিবানন্দে-

আমাকে থাকতে দেওয়া হল দোতলায় একটা বড় হলের মধ্যে পাতা বেশ কয়েকটি চৌকির মধ্যে একটিতে। পাশে ছিলেন এক বছর পঁয়ত্রিশ এর দূরের জেলা থেকে আসা একজন। হাড়ের কোন অসুখে তাঁর মেরুদন্ড বেঁকে শরীর গোল হয়ে যাচ্ছিল। আর সঙ্গী হলেন ডায়াবেটিস আক্রান্ত এক ওড়িয়া ভদ্রলোক, আর পরে এল বাংলাদেশ থেকে অ্যাসিডিটিতে বিব্রত একটি‌ সদ্য যুবক।

 

আমি ঢোকার সাথে সাথে হাসপাতাল পরিচালক দু’জন সাধুর মধ্যে একজন অতি সংক্ষিপ্ত নির্দেশে  বললেন, শ্বাসকষ্ট না কমা অবদি আপনি নিয়মমত ওষুধ খেতে থাকুন, সাথে সাথে আমাদের নিয়মগুলোও মেনে চলুন।

 

প্রাত্যহিক নিয়মগুলি হ’ল সকাল বিকাল বেশ কিছু প্রাণায়াম ও নিজের সাধ্যমত আসন। হাসপাতালের তরফ থেকে কোন ওষুধ দেওয়া হয় না। খাওয়া দুপুর ১২টায় ও‌ রাত আটটায়। ছোট দুটি রুটি বা এক বাটি ভাত (এর বেশী নয়)। পেট ভরাতে যত ইচ্ছে ডাল ও তরকারী। একটু দুধ আর যত ইচ্ছে আখের গুড়। বিকেলেও প্রাণায়াম। সকালে ব্রেকফাস্ট বা বিকেলে টিফিন কিছু নেই। খিদে পেলে জল খাও। খিদে পাবেই, কারণ সহজপাচ্য খাবার, ভরপেট খেলেও অতি দ্রুত হজম হয়ে যেত। চা-কফির নামও করত না কেউ। একাদশী তে দুপুরের খাওয়া আর পূর্ণিমাতে নৈশভোজ বাদ দিয়ে আরও বেশী করে জল‌ খেতে বলা হত। 

 

এছাড়া ওষুধের দোকানে গিয়ে রবারের চার নম্বর ক্যাথিটার কিনে সেটাকে ধৌতির টিউবের মত ঠান্ডা করে রাখতে হয়। প্রতি সকালে দাঁত মাজার সময় ওটার সূচালো দিকটা নাক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এবার তার দুপ্রান্ত ধরে টানাটানি করে কথায় কথায় হাঁচতে থাকা নাকটির অতি স্পর্শকাতরতার বারোটা বাজানোর যে চেষ্টা করা হয় তার নাম নেতি।

 

বৃহস্পতি আর রবিবার করতে হ’ত ধৌতি। প্রত্যেকের একটা করে প্রায় এক সেন্টিমিটার ব্যাসের আর চার ফুট লম্বা রবারের পাইপ জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে রাখা হত। আমরা গলা অবদি ঈষদুষ্ণ জলপান করে সারি করে একটি ড্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নিজের রবার পাইপ মুখ দিয়ে পেট অবদি চালান করতেই পেটের জল পাইপ দিয়ে বেরোতে থাকত। প্রথম প্রথম পাইপ ঢোকাতে খুব অসুবিধে হত, বমি পেত, পরে সহজ হয়ে যায়। জল বেরোনোর পর মিউকাস আর পিত্ত বেরিয়ে আসতো। এর‌পর খালি পেটে জল পান করে ১২টা বাজার অপেক্ষা। এ ছাড়াও খাদ্যনালীর নীচের দিক পরিষ্কার করার জন্য কৃত্রিম কলেরা ধরণের পরিস্হিতি তৈরী করা হয় মাসে একবার। এই প্রক্রিয়াটির নাম সহজ বস্তিক্রিয়া। অনেক ভেবেও এত কঠিন জিনিষগুলোকে ‘সহজ’ বলার কারণ খুঁজে পাই নি।

 

সহজ বস্তিক্রিয়ার শুরু সকালবেলায় খালি পেটে লেবু আর নুনের বেশ গরম শরবৎ যথাসাধ্য পান করে। সেটি করতে থাকলে এক সময় টয়লেটে যাবার প্রবল চাপ উপস্থিত হয়।‌ বারম্বার যেতে হয়, শরীরে কলেরার মত ভীষণ অস্হির ভাব আর ঘাম হতে থাকে। যারা সহ্য করতে পারে না, তাদের এক গ্লাস ঠান্ডা জল খাইয়ে দিলেই ম্যাজিকের মত টয়লেটের টান থেমে যায়। যারা পুরোটা সহ্য করতে পারে, তাদের পেট সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন হবার পর উদরগত লেবুর শরবৎ বেরোতে থাকে। সেটি থেমে যাবার পর রোগীদের ঘি সহ সেদ্ধভাত দেওয়া হয় যাতে খাদ্যনালীর নীচের অংশটি একটু তৈলাক্ত হতে পারে।

 

সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আসন-প্রাণায়াম-ধৌতির ত্রিমুখী আক্রমণে মন্ত্রপূত সর্ষের ধোঁয়ায় উৎখাত প্রেতের মত আমার হাঁপানি যখন দিগন্তের ওপারে পালিয়ে বাঁচল আমি হিসেব করতে বসলাম কী চেয়েছি আর কী বা পেলাম? চেতনা হল যে অসুখটি জীবনের রঙ কেড়ে নিয়ে সারারাত আমাকে বিছানায় বসিয়ে রাখতো, সে দূরে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যেতে যেতে খাবলে নিয়ে গেছে আমার জেগে থাকা দিনের ঘন্টা পাঁচেক সময়।এর মধ্যে এক ঘন্টা আসন-প্রাণায়াম (এগুলো করতে করতে তবু অন্য কিছু ভাবা যায়)। বাকি চার ঘন্টার মধ্যে (দুপুর দশটা থেকে বারোটা আর সন্ধ্যে ছ’টা থেকে রাত আটটা) কখন খেতে পাবো এই চিন্তা বার বার ঘড়ি দেখা ছাড়া আর কোন শারীরিক বা মানসিক কাজ করতে দেয় না। 

 

হাসপাতালের মেয়াদ শেষ হবার কাছে আসতে এ সব প্রক্রিয়া করে সভ্য সমাজে বিশেষতঃ ‘আর দুটো মিষ্টি দিই, মিষ্টি খেলে কিছু হয় না।’, ‘চা খায় না। সে আবার কী?’ এ সব প্রশ্নপীড়িত বঙ্গসমাজে কী করে টিঁকে থাকবো সে দুশ্চিন্তাও উঁকি দিতে থাকল। 

 

বাকিদের খবর-

আমার ছাড়া পাওয়ার সময় গোল হতে থাকা ভদ্রলোকের একটু উন্নতি হলেও বাড়ী যাবার মত পরিস্থিতি হয় নি। তিনি খুশী ছিলেন, হাসপাতালের খাতাপত্র দেখাশোনা করতেন। মনে হত, তিনি থেকেই যাবেন। উড়িষ্যার ভদ্রলোকের প্রভূত উন্নতি আমার চোখে দেখা। তিনি প্রতি সপ্তাহে বাইরের প্যাথলজিস্ট ডেকে টেস্ট করাতেন। আমাদের মতই যদৃচ্ছা আলু আর গুড় খেয়েও তাঁর সুগার বাড়ে নি। বাংলাদেশের ছেলেটির অ্যাসিডিটির সমস্যা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সে আগে রুটি খায় নি। হাসপাতালে নিয়মিত রুটি খেয়ে খুশী, সে বলত দেশে ফিরে গমের চাষ করবে। 

 

(প্রসঙ্গের বাইরে একটি কথা না লিখে পারছি না। সন্ন্যাসীচালিত শিবানন্দ যৌগিক হাসপাতালে সন্ন্যাসীরা থাকতেন একতলায়, পুজোও করতেন নিশ্চয় কিন্তু, আমাদের কখনো তাতে যোগ দিতে বলেন নি। বাংলাদেশের মুসলিম ছেলেটি আমাদের সাথেই থাকত। এক সাথেই খেত। তার জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। এই সংস্কৃতিটি সম্ভবতঃ বিশ্বভারতীতে আর নিশ্চিৎভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের বিদ্যায়তনগুলিতে অনুসরণ করা হয়।)

 

যাওয়া তো নয় যাওয়া-

হাসপাতাল ছাড়ার পর চাকরি জীবনেও বহু বছর নেতি-ধৌতি-প্রাণায়াম-আসন চালিয়ে গিয়েছি। সব সময় বাংলার বাইরে থাকার কারণে হাসপাতালে এসে প্রক্রিয়াগুলি ঝালিয়ে নেবার সুযোগ হয়  নি। তাই প্রথম প্রক্রিয়া দুটি ছাড়তে হলেও শিবানন্দের শিক্ষায় আসন-প্রাণায়াম আর খালি হাতের ব্যায়াম থেকে গেছে আমার ভেতরে। তার সুফল এখনও পাচ্ছি। 

কোন অসুখ হলেই আসন খুঁজি। তার জোরে হার্নিয়াকে আটকে রেখেছি। মজার গল্প হ’ল স্পন্ডিলাইটিস-এর। বহু বছর আগে চেন্নাই-এ হাল্কা মাথা ঘোরার মাধ্যমে সে নোটিস দেয়। তক্ষুণি ছুটলাম ডাক্তার দেখাতে চেনা ডাক্তার তেমন কোন ওষুধ দেন নি। জানার পর থেকে কিছুদিন আসনের মাধ্যমে পিঠ বাঁকানো, হাত ঘোরানো অভ্যেস করতেই সে সম্পূর্ণ না হ’লেও আপাত-বিদায় নেয়। দিন পনেরো আসন বাদ দিলে যখন তার উপস্থিতি টের পাই, তখন একই কসরৎ খুব কাজ দেয়-বিশেষতঃ ঊষ্ট্রাসন।

 

আরও কিছু-

বসন্তের দূত কোকিলের মত আমার হাঁপানির দূত হল ঠান্ডা লাগা। শীত হ’ল তার বসন্ত।‌ রোজ সকালে অবিরল‌ হাঁচিতে 

উদ্‌ব্যস্ত হয়ে অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ আর ইনহেলার এর হাত থেকে কী করে নিস্তার পাওয়া যায় ভাবছি, তখন আমার বড়দা বললেন রোজ সকালে ঠান্ডা জলে স্নান করায় ওঁর উপকার হয়েছে। আমিও সেটি ধরলাম। মনে পড়ল শিবানন্দ হাসপাতালে স্নানের নিয়ম- প্রথমে হাত-পা দিয়ে শুরু করে আস্তে আস্তে পেট পিঠ ভেজাবে, মাথায় জল দেবে একেবারে শেষে। 

সেটি ভোপাল আর কলকাতার শীতে প্রয়োগ করতেই সকালে ঠান্ডা লাগা আর হাঁচির উৎপাত গায়েব। আবার দেখুন হাঁটুর ব্যথা, যা আমার মতে মেঝেতে না বসা ও কমোড ব্যবহারের ফল- তারও দুটি ওষুধবিহীন উপায় খূঁজে পেয়েছি মনে হচ্ছে।

 

বিশ্বময় সে গিয়েছে ছড়ায়ে –

ভারতীয় যোগ ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলি যে মহা উপকারী তা সারা পৃথিবীর মানুষ মেনে নিয়েছে। নাস্তিকরা আকৃষ্ট হয়ে ঈশ্বরের নাম না নিয়ে যোগ পদ্ধতিও উদ্ভাবন করে ফেলেছেন। সেই কারণে আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক যে কোন শরীর ও মনের সুস্থতার আলোচনা বা অভ্যাসে আসন প্রাণায়ামের স্থান পাকা। অনেক আগে সাইন্স টুডে পত্রিকায় পড়েছিলাম মহেশ যোগী (১৯৬০ এর দশক) আমেরিকায় গেলে, তাঁর মাথায় সেন্সর লাগিয়ে ধ্যান করলে যে মাথা ঠান্ডা হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিৎ হবার পর সেখানে আসনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা থেকে একটি প্রবন্ধে সেই সময় দু’কোটির ওপর আমেরিকানদের নিয়মিত আসন অভ্যাসের কথা লেখা আছে। পুণের বি কে এস আয়েঙ্গার-এর যোগ কেন্দ্র সরকারী আনুকূল্য ছাড়াই ৭০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কোন দিন ভারতে আসেন নি, এমন এক ইউরোপীয় অধ্যাপিকার কাছে শুনি তিনি রোজ ‘সূর্য নমস্কার’ নামে আসন ও ব্যায়ামের সেটটি অভ্যাস করেন। ব্যাপারটি বিশিষ্ট লাগার কারণ তিনি নিজে বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ও তাঁর স্বামী এলোপ্যাথিক ডাক্তার। এমন কি সৌদি আরবের প্রথম সারটিফায়েড যোগ শিক্ষক শ্রীমতি নউফ মারওয়াই আসনের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আরব যোগ ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তিনি ১০০০০ ছাত্রকে আসন শিখিয়েছেন এবং অন্ততঃ ৭০০ যোগ শিক্ষক তৈরী করেছেন।  

দুঃখের বিষয় হ’ল বহুদিন ভারত আর ভারতীয়দের মধ্যে কিন্তু যোগাসন পূজার্চনার অংশ হিসেবে কিছু ধর্মানুরাগীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই কথাটি প্রবাসী ভারতীয়দের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। এই শূন্যতা পূরণে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন বাবা রামদেব। তাঁর আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও, ইদানিংকার ভারতের মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে যোগাসনকে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

উপসংহার- 

জীবনে যত আশ্চর্য ঘটনার প্রত্যক্ষ করেছি শিবানন্দ যৌগিক হাসপাতালে আলু আর গুড় খাওয়ার পরও ব্লাড সুগার সীমার মধ্যে রাখার অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ১৯৮০ সালে সেখানে খাওয়া-থাকা নিয়ে অতি কার্যকর চিকিৎসার মাসিক খরচ ছিল ৩০০ টাকা (এখনকার হিসেবে ৭৩৪১ টাকা)। এই টাকায় যে কোন ছোটখাটো প্রাইভেট হাসপাতালে খুব বেশী হলে দু’দিন থাকা যায়।  এমন অর্জনের পরেও কয়েক দশক পরে গিয়ে অতি দুঃখের সাথে দেখি শিবানন্দ হাসপাতাল ফাঁকা। ইন-পেশেন্ট চিকিৎসা উঠে গিয়েছে। অথচ, হংকং-এ বছর দুই কাটিয়ে আসা এক গবেষকের মুখে শুনি চীনের পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি সেখানে এলোপ্যাথির পাশাপাশি সসম্মানে অধিষ্ঠিত। 

 

ভারতে তেমন হয় নি কেন বুঝতে গেলে আধুনিক যোগ-ভক্তগণ এবং তাঁদের পুরোধা রামদেবের দিকে আবার তাকাতে হবে। এঁরা দিবারাত্র এলোপ্যাথিক চিকিৎসার বদনাম করে সংকটকালে সেখানেই দৌড়তে থাকায় লোকের বিশ্বাস শক্ত ভিত পাচ্ছে না। যোগ চিকিৎসার প্রয়োগ যে সর্বক্ষেত্রে সুফলপ্রসূ হতে পারে না সেই অমোঘ সত্যটি মেনে নিয়ে যে সব জায়গায় তার জোর সেগুলিকে তুলে ধরতে হবে, মেনে নিতে হবে অন্য ব্যবস্থাগুলির ভাল দিকগুলিকেও। নিজের প্রতিভার সম্মান চাইলে অন্যের মধ্যে প্রতিভা দেখলে তাকেও সেটি জানাতে হয়। পৃথিবীতে নিখুঁত নয় কোন কিছুই। যোগ-ই শ্রেষ্ঠ, সর্বরোগহর, বাকি সবই প্রতারণা- এই অবাস্তব প্রশ্নহীন ভক্তি যোগকে বাস্তবতার জমিতে তার প্রাপ্য স্থান থেকে বঞ্চিত করে রাখছে কি না -সেই কথাটি গভীর ভাবে ভাবার সময় এখন।।

 

তথ্যসূত্র-