কবিতাতে খুব অল্প পরিসরে ধরতে হয় “সীমার মাঝে অসীম”এর বিস্তার-এক পংক্তিতে এক আকাশ। তার জন্য রূপক, উপমা, শব্দাবলী আর লেখকের পছন্দমত ছন্দ বা মিল-এর ব্যবহারে ফুটে ওঠে কাব্যগুণ। আগে খুব বলা হতো মেয়েটির ‘শ্রী’ আছে অথবা ভদ্রলোকের ‘গ্র্যাভিটি’। এগুলোর ঠিক সংজ্ঞা দেওয়া শক্ত, যেমন শক্ত ‘সত্ত্বার গভীরে নাড়া দেওয়া’ ঠিক কি ব্যাপার, তার বর্ণনা। কবিতার ক্লাস-এ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘ঘুঁষি বলিতে বদ্ধমুষ্টির দ্বারা প্রযুক্ত এক প্রকারের আঘাত বোঝায়’ না বলে একটি ঘুঁষি মেরে দেওয়া ভাল। তাঁর কথা মেনে কাব্যগুণের মায়ায় কবিতা কিভাবে কোন বিশেষকে নির্বিশেষ করে, সাদামাটাকে মহিমায় মুড়ে দেয় তার উদাহরণ নীচে থাকলো।

ক) মুখোমুখি লড়াই করে বীরশ্রেষ্ঠ-বীরবাহু

যখন অকালে মারা গেলেন,

বল দেবি মিষ্ট-ভাষি, কোন বীরকে সেনাপতি করে

রামের শত্রু রাক্ষসরাজ যুদ্ধে পাঠালেন?

খ) “সম্মুখ সমরে পড়ি বীর-চূড়ামণি

বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,                                                                               

     কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,                                                                             

     পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষকুলনিধি রাঘবারি?” (মাইকেল মধুসূদন)

২ ক) বাংলার মুখ আমি দেখেছি তাই আর,

ইচ্ছে হয় না,পৃথিবী ঘুরে সৌন্দর্য খোঁজবার।

খ) “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,

তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।” (জীবনানন্দ)

৩ ক) দারুণ এক আলোর নীচে ওদের দেখেছি,

জুটি ওদের মানানসই, স্বীকার করেছি।

ভাল লাগলো দেখে, তবু চোখ গিয়েছে জ্বলে,

বলেছিলাম খুশী হব ওদের ভাল হ’লে।

খ) “দেখেছিলাম আলোর নীচে- অপূর্ব সে আলো,

     স্বীকার করি দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো।     

 জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ,   

   বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।” (জয় গোস্বামী)

৪ ক) সেটাই তবে ভাল হবে, তুমি আসবে একা,

ফিসফিসিয়ে বলবে বাতাস তোমার আসার কথা।

নির্জন কোনো স্তব্ধ-বেলায় দু’জনাতে দেখা,

সন্ধ্যাতারার আলো তখন শিরীষ ডালে মাখা।

খ) “সেই কথা ভালো, তুমি চলে এসো একা,

বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে-

স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা,

সন্ধ্যাতারাটি শিরীষ ডালের ফাঁকে।” (রবীন্দ্রনাথ)

৫ ক) সুরটা এখন বদলাও হে, আলাদা গান গাও;

ফুলগুলোকে পাল্টে এখন অন্য মালা বানাও।

খ) “এখন এল অন্য সুরে অন্য গানের পালা;

এখন গাঁথো অন্য ফুলে অন্য ছাঁদের মালা।” (রবীন্দ্রনাথ)

ছিন্নপত্র থেকে এই অংশটি দেখুন। কেমন করে রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের ছোঁয়ায় গদ্য-ও কবিতা হয়ে যায় –    “প্রতিবার এই পদ্মার উপর আসবার আগে ভয় হয় আমার পদ্মা বোধ হয় পুরনো হয়ে গেছে—কিন্তু যখনি বোট ভাসিয়ে দিই, চারিদিকে জল কুল কুল করে উঠে—চারিদিকে একটা স্পন্দন কম্পন আলোক আকাশ মৃত্যু কলধ্বনি, একটা সুকোমল নীল বিস্তার ………… বর্ণ এবং নৃত্য এবং সঙ্গীত এবং সৌন্দর্য্যের একটি নিত্য উৎসব উদঘাটিত হয়ে যায় তখন আবার নতুন করে আমার হৃদয় যেন অভিভূত হয়ে যায়।“

প্রথমে কবিতার বিশ্বজনীনতার কথা লিখেছিলাম। প্রেম মানুষের একটি হৃদয়ের একূল ওকূল দুকুল ভাসানো অনুভুতি। সারা পৃথিবীতে মানুষের প্রেমের প্রকার এক রকম নয়। তবু তার তীব্রতা প্রায়ই এক রকম। প্রেমের অঙ্গীকার পেলে তরুণ মনে যে আনন্দের ঢেউ ওঠে তাকে এভাবে বলা যায়,

সে আমায় ভালবাসে জেনে চাঁদটি হাতে পেলাম,

দুঃখ-কষ্ট যা যা ছিল সবই ভুলে গেলাম।

মনে হ’ল হঠাৎ যেন গ্রহরা থেমে গেল,

হাজার পাখীর ডাকে তখন আকাশ ভরে এল,

দখিন বাতাস হঠাৎ যেন ডালগুলোকে ছুঁয়ে

চাঁপার যত কলি ছিল দিলো ফুটিয়ে।

আর এভাবেও বলা যায়,

“সহসা থামিয়া গেল সৌর আবর্তন,

সহসা সহস্র পক্ষী তুলিল গুঞ্জন,

সহসা দখিনা হাওয়া শাখা দুলাইয়া

সব ক’টি চাঁপাফুল দিল ফুটাইয়া।” (মণীশ ঘটক)

শেষের কথা হ’ল, যেমন করে কোন ভদ্রলোকের গ্র্যাভিটি আছে কি না তার কোন সংজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও

আমাদের মন বলে দেয়, কোন লেখা কবিতা কি না তাও বলে দেবে পাঠকের মন আর পাঠপরবর্তী ‘চিন্‌

চিন্‌’ করা ‘রিন্‌ রিন্‌’ করা অনুভূতি। ছড়া-নো উপসংহারটি এইরকম-

শব্দবিহীন ক্ষণটি দাঁড়ায় ছড়াটি হলে শেষ,

কবিতাখানি গুঞ্জরিত- ফুরায় না তার রেশ।।

অরিজিৎ চৌধুরী

 

 

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.