অরিজিৎ কথঞ্চিৎ/ অরিজিতের কলম

সারোগেসি আর দেহব্যবসা

(বেশী পড়তে ইচ্ছে না থাকলে শেষের দু’ লাইনে চলে যান)

ক’দিন আগে হোয়াটসঅ্যাপে তসলিমা নাসরিন-এর নাম নিয়ে একটি মেসেজ মনে মিশ্র অনুভূতির ঢেউ তুললো। নাসরিনের প্রতি গভীর সম্ভ্রমের ভাবনা পোষণ করি, বিশেষতঃ তাঁর সাহসের জন্য। বক্তার ভালোমন্দ বিচার করতে গেলে খেই হারিয়ে যায়, তাই তসলিমা স্বস্থানে বিরাজ করুন, আমরা শুধু সারোগেসি আর দেহব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন তোলা লেখাটি নিয়ে ভাবি। লেখাটিতে আছে, “সারোগেসি বিজ্ঞানের চমৎকার একটা আবিস্কার বটে। সারোগেসি ততদিন টিকে থাকবে, যতদিন সমাজে দারিদ্র্য টিকে থাকবে। দারিদ্র্য নেই তো সারোগেসি নেই। দরিদ্র মেয়েদের জরায়ু টাকার বিনিময়ে ন’মাসের জন্য ভাড়া নেয় ধনীরা।“ এই কথাটির নিশ্চয়তা ধাক্কা দেয়। কারণ অভিজ্ঞতা বলে, পৃথিবীতে যা যা আবিষ্কার হয়েছে – যেমন মোবাইল ফোন, হার্ট অপারেশন, মোটর গাড়ী বা এরোপ্লেন চড়া সবই একটু দেরীতে হলেও গরীবের কাজে লেগেছে। গরীবের প্লেন চড়া নিয়ে যাঁদের সন্দেহ, তাঁদেরকে এই উপমহাদেশ থেকে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যের উড়ানগুলি একবার দেখতে বলব।

অর্থাৎ, প্রথম বিরোধ বিজ্ঞানের আবিষ্কার সব বড়লোকেরা লুটে নেবে এই ভাবনায়। মানুষ তৈরী করলেও ওষুধ বা অ্যাটম বোম গরীব-বড়লোক বিচার করে কাজ করে না। জমির সার, মশা মারার ওষুধ কিছুই তেমন একচোখো নয়। এই কথাটি  না বুঝে দরিদ্ররা বিজ্ঞানবিরোধী হয়ে উঠলে সকলের ক্ষতি। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি তাঁদেরই। খাবারের জন্য, বাসস্থানের জন্য লড়াই, যাতে বিখ্যাত রাজা-রাজড়ার চেয়ে অনেকগুণ বেশী প্রাণ যেত নামহীন গরীবের; তা কমিয়ে এনেছে বিজ্ঞান। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার মানুষের গড় আয়ু প্রায় দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে আর বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এই ভারতবর্ষে একই জমিতে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা গত ষাট বছরে প্রায় চারগুণ বেড়ে যাওয়ায় মা ষষ্ঠীর কৃপাধন্য, লাগামছাড়া বংশবৃদ্ধি করা  দেশগুলোতেও সকলেরই খাওয়ার যোগান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

গরীবের জন্য যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁরা দয়া আর সহানুভূতির নেশায় (ছদ্মবেশী ঔদ্ধত্য) নিজেদের দূরদৃদ্টির অভাব আর নিষ্ঠুরতা (এ প্রসঙ্গে পরে আসছি) দেখতে পান না। পড়েছি, বিবেকানন্দ একবার বিদেশী ভক্তদের মধ্যে পৈতে বিলি করছেন দেখে এক দেশী ভক্ত বলে ওঠেন, ‘কী করছেন স্বামীজি? ওরা যে ব্রাহ্মণ নয়।‘ বিবেকানন্দ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করে জানলি?’ এই লেখাটিতে সারোগেসি গরীবের শোষণ ছাড়া কোন কাজে লাগবে না পড়ে আমারও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘কী করে জানলি?’ তাছাড়া, যে মেয়েটিকে আমরা অন্য রোজগারের সুযোগ দিতে পারি নি, তার কাছ থেকে তার শেষ উপায়- নিজের শরীরের অর্জন কেড়ে নেবার কোন অধিকার কি আছে আমাদের? ‘ভাত কাপড়ের কেউ নয়, কিল মারবার গোঁসাই’ –এর নিষ্ঠুরতা কি আমাদের সহানুভূতির আড়ালে উঁকি দিচ্ছে না?

যিনি লিখেছেন তিনি বোধ হয় জানেন না, নিবিড় সহযোগিতা ও সাহচর্য গরীবের বিলাস নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজন। তা ছাড়া, এ উপমহাদেশে ভিখারি শুধু ফুটপাথের সঙ্গীকে নয়, নিজের খাবার সময় কাছের কুকুর বেড়ালকেও কিছু দিতে চেষ্টা করে। এখনও অনেক মা তাঁর একাধিক বাচ্চার একটি-দুটি ভাই বা বোনের সন্তান-আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য দত্তক নিতে দেন। তার জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোন টাকাপয়সার লেনদেন হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতে বাড়ির বা আত্মীয়-স্বজনের কেউ তাঁর জরায়ু ব্যবহার করতে দেবেন না-এ নিশ্চয়তার উচ্চারণে আবার বুঝি কেন সমানুভূতি (empathy) আর সহানুভূতি (sympathy) সম্পূর্ণ আলাদা জিনিষ- প্রথমটি এক জমিতে দাঁড়ানো বন্ধুর প্রসারিত বাহু, দ্বিতীয়টি উচ্চকোটির করুণাবর্ষণ। আর একটি কথা হ’ল, সমাজের উঁচুতলায় অর্থলিপ্সা অতি প্রবল হওয়ার কারণে তাঁদের মেয়েরা উচিৎ দাম পেলে জরায়ু ভাড়া দেবেন না- হলফ করে এ কথা বলার ঝুঁকি অনেক।

একই লেখাতে দেহব্যবসা সম্বন্ধেও সহানুভূতির লহর। তথাকথিত দেহবিক্রয়কারিণীরা কেমন অত্যাচারের শিকার- গরীবের মেয়েরা বাধ্য হয়ে করে, বড়লোকের মেয়েরা করে না, ছেলেরা করে না…ইত্যাদি বলে, এটি না হলেই ভালো এমন কল্যাণকারী চিন্তা। আশপাশের একথা-সেকথা সেরে নিয়ে আসল কথায় ফিরব। প্রথমতঃ, বিষয়টির যাঁরা খোঁজ রাখেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, এ ব্যবসার শাঁসালো বড় কাজগুলো যাঁরা করেন, যাঁরা মহার্ঘ পাঁচ তারা/সাত তারা হোটেলে সঙ্গদান করেন অথবা প্লেনে বিজনেস ক্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস-এ ওঠেন এসকর্‌ট হয়ে, দারিদ্র্যের থেকে বহু দূরে তাঁদের অবস্থান। পুরুষ দেহব্যবসায়ীও খোদাতালার দুনিয়ায় বিরল নন। পৃথিবীতে যে জিনিষের চাহিদা থাকবে, যতই অন্তঃসারশূন্য হোক না কেন, তার যোগান দেবার লোকের  অভাব হবে না। আর একটা জিনিষ নজর দেবার মত- জীবনের সব উপাদান সর্বস্তরেই ব্যবহৃত হয়। বড়লোক ফল খায়, গরীবও খায়, বড়লোক চুল কাটান, আয়না কেনেন- কিছুটা নিরেস হলেও গরীব মানুষও তা করেন। কাজেই দেহব্যবসা ‘শুধু গরীবের’ বলে মার্কা মেরে দেওয়া না-হক অবিচার মনে হয়।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই, আমরা সবাই- বাঘ, সিংহ, পাখী, প্রজাপতি, মাছ বা মানুষ- প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি মা সবাইকে একটি শরীর দিয়ে বলেন, ‘যা চরে খা।‘ সে জন্যই বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড নয়, দেহই হ’ল আদি ও অন্তিম সম্পত্তি। আমদের জন্মের সাথে সাথে এ সম্পত্তির পত্তন, আর মৃত্যুর সাথে বিলয়। দাস ব্যবসা নৈতিকভাবে অতি খারাপ কারণ এই আদি সম্পদের অধিকার সে ছিনিয়ে নেয়। দাসকে মুক্ত করার মানে শরীরের অধিকার আসল মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া।

বুদ্ধিজীবিরা সবাইকে ভাবতে অভ্যস্ত করে দিয়েছেন যে তাঁরা দেহের ঊদ্ধে অন্য কিছু করেন। বুদ্ধি, শিক্ষা বা পয়সা কম হলে লোকে যে দৈহিক শ্রম করে তা তাঁদের করতে হয় না । কিন্তু, এমন কোনো শ্রম আছে কি যা দৈহিক নয়- মস্তিষ্ক কি দেহের অংশ নয়? স্বচ্ছল বুদ্ধিজীবির আরো টাকার জন্য কাগজে অনৈতিক লেখা ছাপা, অফিসে অসদুদ্দেশে নোট শীট লিখে বাজে লোককে টাকা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করার জন্য মাথা ব্যবহার করলে যেটুকু দোষ, কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্য দেহ ভাড়া দেওয়া কি তার চেয়ে বড় নৈতিক স্খলন? সোজা উত্তর- ‘না’।

এ অব্দি একমত হ’য়ে আমরা ‘পাপা, ডু নট প্রীচ’-এঁর সমভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখি সমস্যাদুটো কিন্তু তেমন জটিল নয়, আলাদা করে কিছু করার দরকারও নেই।

দেশের একটি প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের যোগাড় করা। সেটা না পারলে তারা যাতে নিজেরা কাজ করে সেটুকু জুটিয়ে নিতে পারে তার পরিবেশ অন্ততঃ বজায় রাখা, পারলে উত্তরোত্তর উন্নত করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব, মানুষের  ওপর যাতে কেউ জবরদস্তি করতে না পারে, তার ওপর কড়া নজর রাখা। এটি পালন করলে কারো অন্য কাউকে সারোগেসি বা দেহবিপণনে বাধ্য করার প্রশ্ন উঠবে না। আর প্রথমটি পালন করলে অভাবের দায়ে কাউকে শরীর ভাড়া দিতে হবে না। নীতিবাদীদের মনে রাখতে হবে যেহেতু দেহের চাহিদা আছে, এঁর পরেও ইচ্ছুক বিক্রেতা আর গ্রাহকরা সর্বস্তরে সারোগেসি আর দেহব্যবসা টিঁকিয়ে রাখবেন……রাখবেনই। দেশের সে ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকাই ভালো।

অনেক সময় সিনেমা মানুষের চোখ খুলে দেয়। বিদ্যা বালন-এর ‘বেগম জান’ আর কৃতি সানন-পঙ্কজ ত্রিপাঠির ‘মিমি’ দেখে নিন।

 

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.