অণু সন্ধান 5
শেফ।
টেবিলে রাখা একটা চৌকো কাঠের বাক্স। সামনে দাঁড়িয়ে যে, তার চোখে কৌতূহল, ঔৎসুক্য আর স্বপ্ন। মাস্টার শেফ হবার। আর বাক্সের নাম রহস্যপেটি। তার ভিতরে রাখা আছে আজকের রান্নার সামগ্রী। কি যে আছে কেউ জানে না। বারামুন্ডি মাছ, গালাংগল, কোলরাবি, ট্রাফল থেকে শুরু করে গাজর, কুমড়ো থেকে ক্যান্গারু। দেড় ঘন্টা সময়। তার মধ্যে রান্না করতে হবে শ্রেষ্ঠ সুস্বাদু সব ডিশ।খাবেন তিন বিচারক। যে শ্রেষ্ঠ সে পাবে পুরস্কার। যে সবচেয়ে নিরেস, তার কপালে তিরস্কার। এমনকি বহিস্কার।
অন্নপূর্ণাকে সীমা একবার দেখিয়েছিল একটা এপিসোড। ওর চোখ তো বড় বড় হয়ে গেল। পুরোটা শেষ হলে বলল, বৌদি কতরকম রান্নার জিনিষ দেখলে? কত রকম মশলা। ধনেপাতা কারিপাতা পুদিনা যা চাও। আমি যদি পেতাম।
অন্ন ওদের বাড়ীর তিন দশকের রান্নার মাসী। রোজ সকালে বাজার করে আনেন বড়বাবু। রহস্য পেটি। কোনদিন শাক কোনদিন সব্জির, কোনদিন ইলিশ তো কোনদিন পার্শে। দেড় ঘণ্টা সময়। তার মধ্যে হয়ত রান্না করতে হবে লাউ চচ্চড়ি, ফুলকপির ডালনা, ঊচ্ছে ভাজা, আলুভাজা, ভিন্ডি আলু মশালা, টক ডাল, মাছের ঝোল। তার সংগে থাকবে ১৬টা পরোটা, বাইশটা রুটি, বড়মার জন্য একবাটি ক্ষীর।
সব ঐ সময়ের মধ্যে। তিন বিচারক বিচার করবেন খেয়ে। বহিস্কার নেই কিন্তু তিরস্কার চলতেই থাকে। মাস্টার শেফে সবাই আসে মারসিডিসে চেপে। অন্নদি ভোর চারটের ট্রেন ধরে সুন্দরবন থেকে। বাড়ী বাড়ী রান্নার রহস্যপেটি থেকে বেরিয়ে আসে কুমড়ো থেকে ক্যান্গারু না হলেও কাঁকরোল হতেই পারে।
তুমি যদি বিদেশে জন্মাতে ঠিক মাস্টার শেফে চ্যামপিয়ন হতে। সীমা বাড়ির বৌ, মিষ্টি স্বভাব না হলে চলে না। ও অন্নদির সংগে বকবক করে যখন ওর রান্না চলে। মিষ্টি কথার প্রতিদানে একটা গ্যাস খালি করে দেয় অন্ন সীমার মেয়ের জন্য পাস্তা বা স্যান্ডউইচ বানাবার জন্য।
-তুমি না এলে যে কি হবে? এত রান্না কে পারবে বল তো?
-তা তো ঠিক বৌমণি, একটু মাইনে বাড়াতে বল না গো বড়মাপের তাহলে
সীমা চুপ করে যায়। মনে পড়ে একবার এ নিয়ে কোথা বলতে গিয়ে কি ধমক খেয়েছিল।
-কতগুলো বাড়ি ও রান্না করে জানো বৌমা? রান্না করে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে। আর রান্নার তো ঐ ছিরি পুরনো লোক বলে ছাড়াই না। ও তো আমাদের থেকেও বড়লোক।
একবার মনে হল বলে তাহলে আমি ওর বাড়ীতে একটা কাজের জন্য বলব?
সাহস হয়নি। সীমা জানে সাহসকে টুঁটি টিপে রাখার নামই জীবন। অন্তত মেয়েদের। এই ২০২২ সালেও।
দিন এগোয়। মাস্টার শেফের প্রতিযোগিতা আরো কঠিন। শেষ পর্যন্ত তিনজন। অন্ন বলেছিল ও ফাইনালটা দেখবে। আর সব কাজের লোকেরা সিরিয়াল দেখার জন্য কাজ ফেলে বসে যায়। অন্ন কেমন অন্যরকম।
ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেল।
ঝড়ে ধসে গেল অন্নর পাঁচ ইন্চি দেওয়ালের দোতলা বাড়ি। ট্রেন বন্ধ। নোনা জল ঢুকে যা ক্ষেত ছিল সব গেল ডুবে। বাঘেরা ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে খাবারের খোঁজ করতে লাগল। দু চারজন তাদের পেটেও গেল।
অন্ন পড়ল জ্বরে।
শহর কলকাতার সম্ভ্রান্ত গৃহেও এসে লাগল ঝড়ের ধাক্কা। রান্নার লোক নেই। সীমা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রান্না করছে। অন্ন একদিন দুদিন তিনদিন কোন খবর নেই। এবারে বার মাথা গরম হতে লাগল।
বড়মার ক্ষীর না হলে রাতরাশ হয় না। পরোটা না হলে মেজবাবুর চলে না। আর বড়বাবুর চাই রুটি আর মাছের ঝোল।
অন্নর দুদিন ১০৩ জ্বর। ছেলে আর বৌ বাড়ী ভেন্গে যেতে রাজডান্গার বস্তিতে চলে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে অন্ন একটু রুটি আর গেঁড়ির ঝোল বানাব বলে ঠিক করে। মাথা ঘুরে যায়। সারা দিন না খেয়ে ঘোরের মধ্যে ওর মনে পড়ে আজ মাস্টার শেফের ফাইনাল। বাইরে সমুদ্রের হাওয়া ঘুরতে থাকে। সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় স্যামন মাছ বেক হয় মাস্টার শেফের রান্নাঘরে।
সীমা টিভি চালিয়ে দেখে। মনে পড়ে অন্নদির কথা। বড়মার কথা ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে ।
-কিরকম শয়তান দেখেছো আমাদের অন্ন। একবার মনেও পড়ল না আমাদের কথা। এবারে আসুক। টিভি দেখা বন্ধ করে দেব। মাস্টার শেফ। হুঁ। লাউ চচ্চড়ি রাঁধত পারে না। ঘেঁটে ফেলে।
সীমা বন্ধ করে দেয় টিভি।
About Author
বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং
খুব ভালো, আধুনিক গল্প।