জুতা পরিস্কার
কলমে : গালিব লেখনিয়াল
বিশ্বকবির এক অনবদ্য কৌতুক কবিতা – জুতা আবিস্কার। লিঙ্ক নীচে। সেই কবিতা যে কোন বয়সের লোক যে কোন সময়েই পড়ুক, অনাবিল হাসিতে মুখ ভরে যাবেই।
কর্মসূত্রে বিমলদা সেদিন এক স্টীল বানানোর প্ল্যান্ট পরিদর্শনে গেছেন। সে জায়গাটায় অনেক মাইনস. আয়রন ওর পাওয়া যায়. স্টীল প্ল্যন্টও অনেক আছে। অনতিদূরে জামশেদপুরের সুবিশাল টাটা স্টীল প্ল্যান্ট।
তা, সেই প্ল্যান্টে পৌঁছে ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে পোর্টিকোতে এলে সেই প্ল্যান্টের এম.ডি সাহেব (মালিক) বিমলদাকে অভ্যর্থনা করে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। তার অফিসে জুতো বাইরে খুলে ঢুকতে হয়, ভেতরে কোন দেবীর মুর্তি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত এবং পূজিত। বোধহয় লক্ষীদেবীই হবেন। মালিক সাহেব হয়তো ধনকে চিরস্থায়ী করার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে চেয়েছেন। তবে বিমলদা অবাক হলেন এই ভেবে যে এম.ডি সাহেব যদি সংলগ্ন দপ্তরের কোন স্টাফকে দরকার পড়লে ডাকেন তবে তাকেও তো জুতো খুলে আসতে হবে। দিনের মধ্যে কবার এরকম আসা-যাওয়া (জুতো খোলাখূলি) চলবে ? তাছাড়া যেসব বাইরের লোক ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে এম.ডির সাথে দেখা করতে আসবেন তাদেরও তো জুতো খুলেই ঢুকতে হবে।
যা হোক, সেই এম.ডির অফিসে ঢুকে দেখা গেলো যে সেটা অদ্ভুদ রকমের প্রকান্ড। এত বড়ো যে ভেতরে এক ব্যাডমিনটন কোর্ট ঢুকে যাবে। দরজা দিয়ে ঢুকে শুরুতে দেবীমুর্তি চোখে পড়ে, দূরে নজর বাড়ালে প্রথমে ঠাহরই হয় না যে ভেতরের মহাশূণ্যে এক মহামন্য মালিক সাহেব অধিষ্ঠিত দেবীর এজেন্ট হয়ে দূরের কোন গ্রহের মতো বসে আছেন। এ এক ডিভাইন সোলার সিস্টেম – কেন্দ্রবিন্দুতে দেবী, মালিক দূরের গ্রহ।
এই অহেতুক বিশালত্বে বিমলদার ড. শুমাকাকে (Dr. E.F. Schumacher, of Small is Beautiful fame) মনে পড়ে যায়। All are looking for efficiency in production. But where is the efficiency in consumption ?
বেলা বাড়ে।সেই অফিসে বসে প্ল্যান্ট সংক্রান্ত কথাবার্তা চলতে থাকে। মালিককে সহায়তা করতে ক্রমাগত আসতে থাকে তার ফৌজ, নানা ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকরা। এবং অবশ্যই জুতো খুলে। কাজ সংক্রান্ত ‘কতো যে “মধুর রাগিনী বাজিল, কত গম্ভীর রাগিনী বাজিল, কত বুদ্ধিদীপ্ত রাগিনী বাজিল (বেশিটাই আধিকারিকরা), কত বেকুব রাগিনী বাজিল (বেশিটাই মালিক সাহেব) “।
এরপর চায়ের আয়োজন। উপচারের বাগাড়ম্বরে আবার শুমাচার এসে পড়েন। খাদ্যসম্ভার এত বেশী যে সেগুলো উপদ্রব মনে হয়। এই উপদ্রবের জোগাড়যন্ত্র শূরু হতেই সমস্ত সহায়তাকারি ডিপার্টমেন্ট আধিকারিকরা চূপচাপ দৃশ্যপট থেকে নেপথ্যে চলে যান – বিমলদার চোখে পড়ে। এ যেন এক তৈরী থাকা চিত্রনাট্ট – কিছু খাবার সময় মালিক আর অতিথিদের জন্য মঞ্চ খালি করে দিতে হবে। নিয়মের জোব্বা পড়া অলিখিত ফিউডালিজম। বিমলদার বেশ অসহনীয় লাগে।
এক সময় চা-পর্ব শেষ হয়। এখন প্রোডাকশন প্রসেস দেখা – মেশিনগুলো চলমান অবস্থায় জিনিস তৈরী করছে নাপে ধাপে, সেইগুলো শেষে গিয়ে তৈরী করছে ফিনিশড গুডস। এম.ডি র অফিসে সামনের দরজা দিয়ে বিমলদা ঢুকেছিলেন। এখন পেছনের দরজা দিয়ে বেরোতে হবে। পেছন দিকে 60-70 ফুট চওড়া একটা টানা রাস্তা – ফ্যক্টরির মাল আসা যাওয়া করার জন্য। তারপর তার ওপাশের গা বেয়ে মেশিনারী শেডের একটানা দেয়াল।
কিন্তু জুতো তো সামনের দিকে ছেড়ে রাখা ! এখন পেছন দিয়ে বেরোলে জুতো কি করে পাওয়া যাবে ?
বিমলদার এতশত জানা নেই। এম. ডির সাথে তিনিও চেয়ার উঠে পড়েন, যথারীতি খালি পায়ে।
আধিকারিকের দল উল্টৌদিকে চলে, বোধহয় নিজেদের জুতোর দিকে।
এমন সময়ে এক সর্দার গোছের আধিকারিক উঁচু গলায় এক হাঁক ছাড়েন – লড়কে, য়ে লড়কে। হিন্দী বলয়ে নগন্য কাজ করার লোককে ডাকার এটা সাধারণ ডাক। যেমন কলোনিয়াল আমলে ছিল – কোই হ্যায় ? নাম জানার দরকারই নেই। খালি অবজ্ঞার পরতটা বিছিয়ে সামনের জনকে হীনমন্যতায়, দাস-মনস্কতায় বিধ্বস্ত করে পদানত করে রাখা। ব্যাপারটা এখনও অনেকটা সে রকমই।
আওয়াজে একটা কমবয়সী ছেলে অনেক কুন্ঠা নিয়ে, অনেক ইতস্তত করে, দরজাটা একটু ফাঁক করে সেই বিভূষিত সৌরজগতে ঢুকে জড়োসরো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্কুলে গেলে হয়তো ছেলেটা এখন ক্লাস ফোরে পড়তো। অপুষ্টিতে চেহারা, হাত-পা সব কাঠি কাঠি। হাফ প্যান্ট আর টি সার্টের বেয়ারা সাইজ বলে দিচ্ছে যে ওগুলো কোন বাবুর বাড়ি থেকে পাওয়া – বাবুর ছেলের ব্যবহার শেষ হবার পর দান করে খ্যাতি কুড়োনোর ফসল। এর বাবা নিশ্চই এই ফ্যক্টরিতে কোন শ্রমিক। বিমলদা মনে ভাবলেন – বেচারা। একটু আগে আমরা যে বিপুল পরিমান খাবারের পিকনিক করছিলাম অফিস ঘরে বসে তার স্বাদ-গন্ধের ছিঁটেফোটা প্রসাদও কি পাবে এ ?
এসবের মধ্যে সেই সর্দার হুকুম দিয়েছেন, সাহাবকো জুতা লাকে পিছে রাখো। সেই ছেলেও বাইরে থেকে জুতো হাতে করে ভেতরে নিয়ে এসে প্রস্তুত – পেছন দিকে যাবার জন্য।
এবার বিমলদা চূপচাপ এক বিস্ফোরণ ঘটালেন। পরিস্থিতি তার সহ্যের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। এক দশ বছরের ছেলেকে দিয়ে হাতে করে জুতো বওয়ানো ! অবস্হার চাপে পড়ে বাচ্চাটা কিছূ বলতে পারবে না। কিন্তূ ওর আত্মমর্যাদা কতটা ক্ষুণ্ন হবে ? ইংরেজরাও তো ভারতীয়দের ওপর এই-ই করেছিলো দুশো বছর ধরে।
বিমলদা একটা অশ্রদ্ধার রোষকষায়িত দৃষ্টি হানলেন। বোধহয় ব্যাবস্থাটার ওপর। তারপর ছেলেটার হাত থেকে নিজেই জুতোটা নিতে গেলেন। তিনি নিজেই বয়ে নিয়ে যাবেন।
বাকিরা তো হাঁ হাঁ করে উঠলো। একি কথা, অতিথি হাতে করে জুতো বইবেন ! কম্পানির বদনাম হবে যে ! কিন্তু বিমলদা অনড়। তিনি নিজে হাতে বয়েই কম্পানির সুনাম রক্ষা করবেন। এরা বূঝতে পারছে না যে বাচ্চাটা বইলেই কম্পানির দূর্নামটা হবে, অন্ততঃ বিমলদার কাছে।
এ নিয়ে ঝুলোঝুলি চলল খানিক। শেষে এক বয়স্ক আধিকারিক ব্যপারটা বুঝে ছেলেটাকে ক্ষমাসুন্দর কন্ঠে বললেন – বচ্চে, তুম আভি জুতে ছোড় দো আউর বাহার যাও। তারপর মালিকের দিকে তাকিয়ে বললেন – সব আপনি আপনি সোচ হ্যায়।
হতভম্ব মালিকের সামনে দিয়ে বিমলদা বীরদর্পে হাতে জুতো ঝুলিয়ে বাইরে আসেন। এর মধ্যে একটা লোকের চিন্তাধারাকেও যদি তিনি কণামাত্র হেলাতে পারেন এই ভাবনায় মশগুল থাকেন তিনি।
এর প্রায় 15 বছর পর বিমলদা কোন এক রাজ্যের এসেম্বলিতে এক মন্ত্রির সাথে দেখা করতে গেছেন। চারদিকে সেপাই-সান্ত্রীর গ্রাম্ভারি চালচলন। বিমলদা মনে মনে সুনীল গাঙ্গুলী আউরান – বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা। পোর্টিকোর ম্যাট পাতা লম্বা করিডোর ধরে তিনি এগোচ্ছেন। উল্টোদিক থেকে এক শিখ ভদ্রলোক আসছেন, হাতে ফাইল-পত্র, বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। কোন আনডার-সেক্রেটারি হবেন হয় তো। সাথে একটি চামর-ধারীও আগে আগে চলেছে।
বিমলদাকে সামনে দেখে সেই চামর- ধারী সবিনয় ইশারায় বিমলদাকে ম্যাট থেকে নেমে গিয়ে সেই রাজপুরুষের জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানায়।
বিমলদা নিজেকে সেই দশ বছরের ছেলেটার জায়গায় আর রাজপুরুষকে সেই ফ্যক্টরীর মালিকের জায়গায় দেখেন। সেই Fountain-head অবজ্ঞা তার শত ধারা উপধারা নিয়ে বয়ে চলেছে।
অন্তর্দৃষ্টি যাঁর আছে সেই লেখকই ধন্য। কত সহজে আসল কথাটা আন্ডারলাইন করে দিলেন। অভিনন্দন।
ধন্যবাদ।
Great composition by the author, very powerful writing capacity that I must admire
ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগলো??
ধন্যবাদ।
কত গভীর অনুভূতি কত সুন্দর ভাবে অভিব্যক্ত । কলমের জোর না থাকলে এ লেখা আসেনা। কবিগুরুর একটি পংক্তি হঠাৎ মনে পড়ে গেল। “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে” । আমরা অনেকেই কি এই পংক্তি মেনেই নেতা মন্ত্রী সান্ত্রী দের চরণ বন্দনায় উদগ্রীব ।
– Samir Das
ধন্যবাদ।
বিষয়টা ভাববার মতো।
ক্ষমতার সামনে চরণ-বন্দনা করা এক ইডিও-মোটর অ্যাকশন হয়ে গেছে।
Great composition
Excellent ?
ধন্যবাদ।
Porei fellam……khub valo hoyeche…..esob kintu ekhono aache with some evolution of course.
??
– Ranadhir Mukhopadhyay
ধন্যবাদ।
লেখাটি কেবল সুন্দর ই নয়,চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটি অমানবিক ছবিকে দেখানো,
লেখককে অভিনন্দন।
– অশোক ঘোষ,
সল্ট লেক, কলকাতা
ধন্যবাদ।
AMIO PORLAM.Ofcoursr with bit difficulty to understand in first reading due to my lack of knowledge of Bangla readings.
Absolutely beautiful way of telling our common mentality of superiority. It’s there, it’s most of the places we see all most everyday and very recently when I was waiting in corridor of Goa Legislation Assembly building.
Such nice articles are enriching our Blog. Keep it up Sir.
Bimalda of Panjim, Goa
Thank you.for your ever-charitable words.
It’s nice that you could connect yourself with the fictional Bimal Da.of the story.
খুব ভালো লাগলো. অতি প্রাঞ্জল ভাবে লেখক তুলে ধরেছেন এখনকার সামাজিক অবস্থা এবং ব্যবস্থা
ধন্যবাদ।
ভাষা আর কাহিনীর ঠাসবুনোট। খুব ভালো লাগলো।
খুব উপভোগ্য ভাবে উপস্থাপিত। যেদিকে তাকাই, এম ডি সাহেব আর আন্ডার সেক্রেটারির দেখা পাই। দুই একটা বিমলদার সাধ্য কি, যে এমন মৌরসিপাট্টা ভেঙে খানখান করেন। বিমলদারা ঐ রিখটার স্কেলের তিন কি চার মাত্রার ভূকম্পের মতো। পরের দিন কাগজে ছাপা হলে তবেই জানা যায়।