জীবন্ত ভারত মহান

জীবনের বাণী ট্রাকের গায়ে

আমাদের দেশে লরি, বাস বা অটোর গায়ে দার্শনিক, ব্যবহারিক বাণী লেখার চল আছে। তাতে আবার একটি বাক্যের মাঝখানে অন্য শব্দ ঢুকিয়ে মাঝে মাঝে মজাদার বাক্যবন্ধ তৈরী হয়। যেমন, ‘আবার (হর্ন দিন) দেখা হবে’, অথবা ‘পাবলিক (মা) ক্যারিয়ার’। খারাপ নজর দেওয়া হিংসুটে লোকদের অভিশাপবাণীও দেখা যায়। খুশবন্ত সিং এর সংগৃহীত একটি গায়ে কাঁটা দেওয়া শাপ এরকম, “বুরি নজরওয়ালে তেরে বচ্চে জিয়ে, বঢ়ে হো কর তেরা খুন পিয়ে।” (কু-দৃষ্টি ও’লা, তোর সন্তান ভালো থাক,  আর তোরই রক্ত বড় হয়ে চুষে থাক)  

প্রথমবার দিল্লী গিয়ে লরির পিছনে হিন্দিতে ‘মরা ভারত মহান’ দেখে চমকে গিয়েছিলাম, পরে বুঝি হিন্দি মেরা’র ম-এর টিকি উড়ে যাওয়ায় এই ‘চাওয়া হয় নাই’ ফলপ্রাপ্তি (Unitended consequence)। 

লেখাটা ভুল বুঝে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না, আমার দেশ ভুলতে দেয় না। দেখি যে কবি হোন, গণিতবিদ, বা দার্শনিক আমাদের দেশে যে সব বড় মানুষ বেঁচে আছেন বা যাঁদের বেঁচে থাকতে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে আমরা যথেষ্ট গৌরবের কারণ খুঁজে পাই না। যেমন ধরুন, এখনও আমাদের মনে লেখক বলতে বাল্মীকি বা বেদব্যাস রবীন্দ্রনাথ, প্রেমচন্দ কিংবা সাদাফ হাসান মান্টো’র সামনে দাঁড়িয়ে যান, বিভা চৌধুরী বা অর্চনা শর্মার অর্জনকে ঢেকে রাখেন মৈত্রেয়ী ও অরুন্ধতী, সত্যেন বোসকে ভুলিয়ে রাখেন আর্যভট্ট, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অভিজিৎ বা অমর্ত্যের কাজকে আড়াল করে রাখে আর স্যাম মানেকশ আধুনিক লড়াই-এ যত বড় ফিল্ড মার্শাল হোন না কেন, ধনুকধারী রাম-লক্ষ্মণকে অতিক্রম করতে পারেন না। 

এই যে আমরা বর্তমানে দেহ রেখে ইতিহাসের আগে মনকে পাঠিয়ে সেই অতীতের মানুষকে আদর্শ করে রাখছি, তাতে আমাদের জাতির জীবনে এক মহা সঙ্কট ঘনিয়ে উঠছে। আমার এক সময়ের ওপরওয়ালা ভি পি রাও বলতেন, আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আদর্শ দরকার। এঁরা হবেন এই সময়ের রোল মডেল। রাম,  যুধিষ্ঠির, যীশু বা মহম্মদকে সামনে রেখে এ যুগে জীবন কাটানো মুশকিল। আবার ইংরেজ চলে যাবার পর আমাদের অবস্থা এতটাই বদলেছে যে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদেরও জীবনও এই সময়ের যুবকদের দিকনির্দেশ করতে পারে না।

তা বলে কি তেমন মানুষ নেই? আছেন। মনে হয়, কৃষির স্বামীনাথন, কো-অপারেটিভের কুরিয়েন ভারতের খাদ্যসমস্যা প্রায় মিটিয়ে দেবার পর আই টি’র নারায়ণমূর্তি-মোহনদাস পাই-নন্দন নিলেকানি, আজিম প্রেমজি বা শিব নাদার অনেক চাকরি সৃষ্টি ছাড়াও আমাদের কাঁধে জুড়ে দিয়েছেন টেকনোলজির ডানা। নিলেকানির আধার সংক্রান্ত কাজ অতিমারীর সময়ে দেশব্যাপী করোনার টিকা দেওয়া ও তার রেকর্ড রাখা ছাড়াও গরীব মানুষের কাছে সরকারী সহায়তা পৌঁছে দেওয়ায় যে উদাহরণ যোগ্য সহায়তা করেছে তা ঠিকমত কবে স্বীকার করবো আমরা? যে আই টি’র কাজ শুরু হয়েছিল বিশ্বায়নের স্বর্ণযুগে, সে-ই ক্রমশঃ জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের সময়ে কী ভাবে আমাদের সহায়তা করতে পারে সে আলোচনা না হয় হবে কখনো। সস্তার প্লেনে উঠলেই এয়ার ডেকান-এর ক্যাপ্টেন গোপীনাথ আর তাঁর ট্যাগলাইন ‘সিমপ্লিফ্লাই’ মনে পড়ে না কি!

 

পুরস্কৃত, তথাপি বিস্মৃত

এঁরা না হয় বিখ্যাত মানুষ, দেশ দেখতে না চাইলেও বিদেশ সম্মান দেয়। আমরাও দিই…পদ্মশ্রী ইত্যাদি। তবে অনাদি অতীতের কেউ না হলে অতি দ্রুত ভুলে যাই। যেমন ধরুন, আউশগ্রামে দু’টাকার শিক্ষক সুজিত চট্টোপাধ্যায় যিনি গরীব ছাত্রদের সদাই ফকিরের পাঠশালায় ক্লান্তিহীন ভাবে তৈরি করে চলেছেন বাঙলার…ভারতের ভবিষ্যৎ। অথবা, লাক্ষাদ্বীপের আলি মাণিকফান যিনি প্রত্যন্ত দ্বীপে বসে প্রথাগত শিক্ষার সহায়তা ছাড়াই বারোটি ভাষা  শিখে ফেলেছেন। তা ছাড়সমুদ্র, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি ও পুষ্প গবেষণায় তাঁর অবদান রেখে চলেছেন।

আর সেদিন পর্যন্ত ছিলেন চেন্নাই-এর দু’টাকার ডাক্তার তিরুভেঙ্কটম ভীররাঘবন। তিনি মাঝরাত অব্দি জেগে গরীব মানুষের চিকিৎসা করতেন। 

এঁরা তিনজনই গত বছর পদ্ম-পুরস্কৃত আর এ বছর বিস্মৃত। অবহেলায় এঁদের তুচ্ছ করে জীবনের রোল মডেল খুঁজতে অতীতের ঝাপসা হয়ে যাওয়া রাজা-মহারাজ-গুরুর পিছনে ধাওয়া করতে করতে আমরা জাতি হিসেবে যে অবস্থায় পৌঁছচ্ছি তাকে বলে শিকড়বিহীনতা।

 

ব্যাধির চেয়ে আধি যবে হয় বড় 

ভারতকাননে কত অগণন গোলাপ যখন ঝরে,

অতীতবিলাসী জাতিটি অলীক পারিজাত খুঁজে মরে।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখন যাঁরা ইতিহাসের বিচ্যুতি ঠিক করার কথা বলছেন, তাঁদেরও নজর বেশিরভাগ অতীতের রাজারাজড়ার দিকে, আধুনিক কালের, ডাক্তার, কবি, স্থপতি, শিক্ষক, সমাজসেবীরা তাঁদের মানসিক পাদপ্রদীপের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। 

জার্মানির একটি ছোট শহরে হাঁটতে হাঁটতে নজরে পড়ছে বহু বাড়ির গায়ে সেখানে যে যে বড় মানুষ ছিলেন তাঁদের নাম আর থাকার সময় লেখা। ইয়োরোপের শহরে শহরে সিটি মিউজিয়মে সেই শহরের ইতিহাস ধরা  থাকে। গোয়ার বিগ ফুট-এ এরকম একটা চেষ্টা দেখেছিলাম, কিন্তু ভারতবর্ষে তার ধারাবাহিকতা নেই। আমাদের ছোটরা সাধারণতঃ নিজের গ্রাম-শহরের ইতিহাস, সেখানকার বড় মানুষদের সম্পর্কে কিছু না জেনেই বড় হয়।

সুদূর অতীতের মানুষ অনেকটা এখনকার ভাল-মন্দয় মেশা মানুষজনের মত হওয়ার সম্ভাবনা খুব। আমাদের মনে শুধু ‘মৃত ভারত মহান’ নয়, ‘বহুকাল আগে মারা গেলে তবেই মহান’ এই ভাবনা গেড়ে বসে আছে। তাকে উৎখাত করে ‘প্রাচীন ছাড়াও সদ্যমৃত এবং এখনও জীবন্তরাও মহান’ এই ভাবনা ঢোকাতে হবে। না হ’লে অতীতের সাথে তুলনা করে অধমানুভূতি (Inferiority complex) ও ভবিষ্যতের অধোগতি হয়তো আটকানো যাবে না।

 

                                                                                       -অরিজিৎ চৌধুরী

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.