অহঙ্কারীর খাদ্যবিচার
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। প্রকৃতি যাদের শরীরে মগজ ভরে ‘যা, করে খা’ বলে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েছে, সে সব প্রাণীই সাধ্যমত চিন্তা করে। কিন্তু তাদের চিন্তা নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানুষ ছাড়া কেউই বিশ্ব বা মহাবিশ্বের কল্যাণ নিয়ে ভাবে না, নিজেরটুকু বা নিজের দলটুকু ঠিক থাকলেই হ’ল। ইংরাজীতে একটি সাবধানবাণী আছে, ‘যতটা চিবোতে পারবে তার চেয়ে বেশী কামড়ে ফেলো না‘ (Don’t take a bite more than you can chew)। মাঝে মাঝে ভয় হয়, চিন্তাশীলতার চাপ আর তজ্জনিত ‘ভাল করেই ছাড়বো’ ধরণের তেরিয়া দায়িত্ববোধ ব্যাপারটাকে গুলিয়ে দিচ্ছে না তো!
প্রকৃতিরাণী রহস্যময়ী। কি কার্যকারণ বা উদ্দেশ্যের জেরে যে তিনি এগোন- বাঘ, সিংহ, হরিণ, হাতি, পাখী বা পিঁপড়ে তা নিয়ে ভাবে না। দার্শনিক কবি, “সকালে ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা” নিয়ে বিস্মিত হন, কিন্তু ঠিক বিচলিত হন না। কিন্তু অন্যদের ‘নাল্পে সুখমস্তি’ (অল্পে সুখ নেই)। ‘আমি জানি না’ মেনে নিতে তার ঘোর আপত্তি। প্রথমে সে নিজে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো, তার পর ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ বলে কাজ চললো কিছু দিন, তাতেও ব্যাখ্যা পুরোপুরি না হওয়ায় ‘শয়তানের কারসাজি’ আর গ্রীসে, জাপানে বা ভারতে নানা দেবদেবীর উদ্ভাবন করে তাদের রেষারেষি ঢুকিয়ে বেশ শান্তি। ভাল-মন্দ’র একটি পূর্ণ কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হল (বাঘ-সিংহ-হায়না-শিয়ালের এত চিন্তাও নেই, তাদের পুজো করতেও দেখা যায় না)।
বোকারা বোকামির জন্য মরে, বুদ্ধিমান মরে উচ্চাকাঙ্খা আর আত্মগর্বে। সে জন্যই হয়তো শুধু ব্যাখ্যা করে আর পৃথিবীতে ভাল থেকেই মানুষের ক্ষান্তি হল না, পরকালেও কি করে আরো ভাল থাকা যায় তার জন্য নানা জায়গায় নানা রকম নিয়ম-কানুন সৃ্ষ্টি হল, আর শুরু হল পরকালের শান্তি-চিন্তায় ইহকালে অশান্তি বিস্তার। সে ট্র্যাডিশন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তার প্রভাবে এখনও রক্তপ্রবাহ বিরামহীন।
মহত্ত্বাকাঙ্খায় খোঁচা মারে শুধু নিজের ভুল নয়, প্রকৃতির ভুলও ঠিক করার ইচ্ছে- খোদার ওপর খোদকারি। যেমন ধরুন, চোখ খুললেই দেখা যায়, প্রকৃতি মানুষের আশপাশেই কুকুর-বিড়াল-কাক ইত্যাদি মাংসভক্ষক তৈরী করে রেখেছে। বনে রেখেছে বাঘ-সিংহ-শেয়াল আর জলে হাঙর আর পিরানহা। তবু চাষ-আবাদে বর্ধিষ্ণু হবার পর মনে হয়, আমিষখোর তৈরী করে, তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে মাংস ছেঁড়ার শ্বদন্ত দিয়ে প্রকৃতি ঠিক কাজ করেন নি- শুধরে দিতে হবে, অহিংসক হতে হবে। স্বর্গের জন্য প্রতীক্ষা কেন, এখানেই তৈরী হোক সাত্ত্বিক ভাবের অমরাবতী।
হয়তো সৃষ্টির স্রষ্টাকে শুধরে দেওয়া খোদকারির সম্ভাবনা মাথায় থাকাতেই ঈশ্বর বা প্রকৃতি মানুষকে নিজের সর্বব্যাপী দৃষ্টি ও বিবেচনা দেন নি। তাই তার একদিকের অহিংসা অন্যদিকে হিংসার বান বইয়ে দেয়। ভগবান মূক প্রাণী গাছগাছালির কথা শুনতে পান, কিন্তু মানুষ শুনতে পায় না, সামলাতে না পারার ভয়ে শুনতে চায়ও না । অহিংসক গুচ্ছের শাক- সব্জি উদরগত করতে করতে ভুলে যান যে তাদের মধ্যে আশ্রিত অসংখ্য মাইক্রোবকে তিনি পেটের অ্যাসিডে জ্বলে-পুড়ে শেষ হবার পথে ঠেলে দিয়েছেন। আর তার জন্য সব্জি চাষের জমি তৈরি করতে গাছপালা কাটায় গৃহহীনতা আর অনাহারে মারা গেছে পাখী ও প্রজাপতি, বাঁদর ও বাদুড়। অহিংসক ডাক্তারবাবু রোগীর প্রাণ বাঁচাতে, বেঁচে থাকার জন্য ব্যাকুল, ক্ষতভোগী জীবাণুকুলের উপর ঢেলে দেন ওষুধরূপী মারক হলাহল।
প্রকৃতি শুদ্ধ অহিংসার জায়গা রাখেন নি প্রায় কোথাও। প্রত্যক্ষ ছোট হিংসা বাঁচাতে পরোক্ষ বড় হিংসা ঘটে যায়। স্বামী বিবেকানন্দর বলা একটি কাহিনী এই রকম- বৈষ্ণব বাড়িতে চোর ধরা পড়েছে। ছোট বৈষ্ণবরা তাকে পেটাচ্ছে দেখে বড় বৈষ্ণব বললেন, ‘মারিস নি, মারিস নি। রক্তপাত হবে। রক্তপাতে ঘোর অকল্যান।’
-তবে কি ছেড়ে দেব?
-ছাড়বি কেন? একটা বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দে।
সীমিত ক্ষমতার জন্যই কি অহিংসক মানুষ, ‘যা দেখতে পাচ্ছি না, তা হচ্ছে না’-র রাস্তা নিয়েছে? এক ভেগান উপদেশ দিতে আসায় তাকে বললাম, তোমরা যা করছ গোঁড়া বৈষ্ণবরা তার চেয়ে অনেক বেশী… মরা গাছের শিকড় খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে এখন নরম হয়েছেন। সে সব শিকড় খেয়ে বাঁচে যে পোকা আর ব্যাক্টেরিয়া তারা যে তাতে বঞ্চিত হচ্ছিল সে দিকে তাঁরাও দৃষ্টিপাতে বিরত ছিলেন। উপায় কি?
স্ববিরোধিতা থেকে বাঁচার একটিমাত্র পথ হ’ল, নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে তার মধ্যে কাজ করা, অহমিকাকে নিজের সত্ত্বাকে দখল করতে না দেওয়া। না হ’লে নিজের ছোট কাজকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মহৎ নাম ও বৃহৎ মূল্যের মিথ্যাচারে ফিরি করতে হবে, প্রাণবন্ত গাছকে মেরে তাকে অহিংসা নাম দিতে হবে। বাড়ি করতে গিয়ে পায়রা তাড়িয়ে আর নিজের প্রাণটুকু বাঁচাতে সাপ, ইঁদুর, ব্যাঙ আর ব্যাক্টেরিয়া মেরে পাপবোধে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকতে হয়।
সব প্রাণীই তার অস্তিত্ব রক্ষায় প্রকৃতির কাছে- নিজের কাছে দায়বদ্ধ এই অমোঘ সত্যটি মেনে নিলে শান্তি না হোক স্বস্তি মিলবে। রামকৃষ্ণ মিশনের বন্ধু সন্ন্যাসী অতনু মহারাজ (মন্ত্রজ্ঞানানন্দ) যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘প্রকৃতির কোন নিয়মই কি মানুষ বদলাতে পারে?’ তখন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান মনের মধ্যে আবার বলে উঠেছিলেন, মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের যে চেষ্টা করে চলেছে, তা ভয়ানক রকম সফল হয়েছে এমন নয়, কিন্তু সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে জীবনকে আর একটু সহজ করার মত অনেক কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক প্রকৃতি তার নিয়মে তৈরী করেছেন, সেই নিয়ম মেনে দুনিয়া চলেছে অন্ততঃ ২৫০কোটি (২৫০০ মিলিয়ন) বছর। সেটিকে শুদ্ধ করতে মাত্র ০.২ কোটি মিলিয়ন বছর আগে আবির্ভূত মানুষের চেষ্টার প্রয়োজন আছে কি? কত অসহায় আমরা, শুধু চলতে গেলেই যে “দলতে হয় রে দূর্বা কোমল।” নিরাবেগ বাস্তব দয়াশীলতা প্রয়োজন, আবেগ-অন্ধ, না দেখা নিষ্ঠু্রতা নয়। নিরামিষাশী হিটলার কখনোই নাকি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মারণ যজ্ঞ দেখতে যান নি। সহ্য করতে পারতেন না হয়তো। পাপ তাতে কমলো কি?
-অরিজিৎ চৌধুরী
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.
শেষ প্যারাগ্রাফে দয়া করে ‘০.২ কোটি মিলিয়ন বছর’ এর জায়গায় ‘০.২ কোটি (২ মিলিয়ন) বছর’ পড়বেন।
এত সুন্দর বেঁধে ছেঁদে লেখা। বাঁঘাকপিও হতে পারত আমার মত কপির হাতে। কিন্তু হয়েছে এক পারস্যের গোলাপ। প্রান্জলতার চূড়ান্ত। এত ভাল প্রবন্ধ অনেকদিন পড়িনি।