অস্তি থেকে নাস্তি আনুন, তাতেই প্রাণের সার্থকতা*

অনেক পরের কথা ভেবে বৃথাই বকে মরো-                                                                                       মগজ নিয়ে জন্ম যখন আজকে কিছু করো।

অনেকেই বলেন, ‘আমার বিশ্বাস কুড়ি বা দুশো বছর পরে পৃথিবী ঠিক এই রকম হবে’, অনেকে আবার বলেন যুক্তি বলছে, ‘এই রকম নয়, পৃথিবী হবে ঠিক ওই রকম’। এই নিয়ে ঝগড়া বাধে। দুর ভবিষ্যতে কি হবে সে ব্যাপারে যুক্তি আর বিশ্বাস দুটিকেই সমান তাচ্ছিল্যে সরিয়ে না ‘এই’ হয়ে, না ‘ওই’ হয়ে পৃথিবী তার নিজের পথে চলে। এ লেখা দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তি আর বিশ্বাসের অন্তহীন কাজিয়ার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে। 

কোন অদৃশ্য বা অল্প দৃশ্যমান প্রাকৃতিক বিষয়কে সামগ্রিক ভাবে বুঝতে গেলে অনেক সময় মডেলিং করতে হয়। ইদানীং করোনার প্রভাব কী ভাবে ছড়াবে বা কমে যাবে সে ব্যাপারে এই কাজটি করা হয়েছে। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে,  মডেলিং-এ কোনো বিষয় যেখানে দেখা গেছে তার ছবি মনে বা কম্পিউটারে গেঁথে নিয়ে তার মত জায়গার খোঁজ করা হয়। সেটা করতে করতে গিয়ে যখন মহাপণ্ডিতের মহানিশ্চিন্ততা আমাদের গ্রাস করে, তখন…তখনই প্রকৃতিদেবী হঠাৎ থাপ্পড় মেরে চিন্তার সীমাবদ্ধতাটি ধরিয়ে দেন। এটা তিনি করতে পারেন তার কারণ লক্ষ লক্ষ বিষয়কে যুগ যুগ ধরে জুড়ে আর বাদ দিয়ে যেটি তিনি বানিয়েছেন সেগুলিকে কাটছাঁট করে আমরা ভাবি (তথাকথিত) ‘মূল বিষয়’গুলি ধরে ফেলেছি । তার পরেই পরম বোদ্ধার আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে আমরা বোঝার জিনিসটিকে শুধু বর্তমানে বাগিয়ে ফেলা নয়, তার গতিপ্রকৃতি ভূ-গোলে বা ভবিষ্যতে (space or time) কী হবে তা বলে ফেলি। এবার সে বলা’র একটি-দুটি ঠিক হয়ে গেলে (“ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে”) যখন মহাজ্ঞানীসুলভ আত্মপ্রসাদ লাভ করি, তখন-ই একটা বড় ভুল হয়। প্রকৃতিদেবী যেন মনে করিয়ে দেন, পুরো বোঝাটা বাকি রয়ে গেছে।

এই প্রায় চিরস্থায়ী বাকিটুকুর জন্যই অনেক সময় বড় ডাক্তারের বলা বড় অসুখ ‘কিছুই না’ আর সাধারণ জ্বর মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। জিওলজিস্ট হিসেবে আমাদের অনেক সময় মডেলিং করতে হয়। একটু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি-ব্রাজিলের সমুদ্রে প্রায় তিন কি.মি. জলের নীচে আরও তিন কি.মি. পাথর খুঁড়ে দুটি কুয়োতে বেশ ভাল পরিমাণ তেল পাওয়া গেল। তার থেকে সামান্য দূরে ঠিক ঐ রকম দেখতে আরও বড় একটি জায়গা দেখতে পেয়ে ব্রাজিলিয়ান আর ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের দল (আমিও তার মধ্যে) কোম্পানিদের বললেন, ‘খুঁড়ে ফেলুন। তৈলপ্রাপ্তি নিশ্চিত’। প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা খরচ করে পাওয়া গেল নোনা জল। এ সব ঘটলে মনে হয় যদি বুঝতেই না পারি- একটু আধটু না দেখা জিনিষ ঠিক কি রকম বলে দিতে পারি, মগজ নিয়ে করব কি? যেমন ধরুন, এক জ্ঞানী ব্যক্তি ‘নিরামিষই মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য’ বলায় সন্দেহ হয়েছিল আমি ঠিকমত মানুষ কি না- যদি তা হই, মুখের দু’পাশে বিরাজমান দুটি শ্বদন্ত (canine teeth) কোন কম্মে লাগবে!

ভাবতে ভাবতে যেই মনে হ’ল প্রকৃতিদেবী একেবারে উদ্দেশ্যহীন কিছু করেন না, তক্ষুণি আক্কেলের দরজা খুলে গেল। দেখি, আমাদের ভুল হয় যেখানে- তেলের কুয়োর পরিণতি হোক বা দোকানে ডিম পাওয়া যাবে কি না- কাছাকাছি হলে মগজ আর মডেল লাগিয়ে আমরা ঠিকঠাক বলে দিতে পারি। পঞ্চাশ মাইল দূরে তেল থাকবে কি না বা পাঁচ বছর পরে ডিম পাওয়া যাবে কি না সেটাও বলতে ছাড়ি না বটে, তবে প্রায়ই তা ভুল হয়ে লজ্জায় ফেলে। এই ভুলের ময়দানেই শুম্ভ-নিশুম্ভ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর চিরকালীন লড়াই। বিশ্বাসী বলে, ‘আগেই বলেছিলাম নারকোল ফাটিয়ে-লেবু চটকে বা বাইবেল-কোরান-ত্রিপিটক-গ্রন্থসাহিবকে সম্মান না জানিয়ে কাজ করলে সফলতা আসবে না।‘ অবিশ্বাসী বলে, ‘ওসব অমুক অমুক জায়গায় করেও কিছু লাভ হয় নি।‘ 

জন্ম থেকে শুনে আসছি, কলিযুগ শেষ হয়ে সত্যযুগের পুনরাবির্ভাবের আর দেরি নেই (বিশ্বাসীর ভবিষ্যদ্বাণী), আর তার কয়েক বছর পর থেকে মোহময় ‘অমোঘ’ দেওয়াললিখন- ‘পুঁজিবাদের পতন অবশ্যম্ভাবী’ (অবিশ্বাসীর ভূয়োদর্শন)। দুটোর একটাও ঠিক হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আসল কথা হ’ল, বিশ্বাস করি বা না করি, দু’ক্ষেত্রেই বহু দুরের ভবিষ্যৎবাণী যেমন টস-এর ফলাফলের মত অনিশ্চিৎ থেকে যায়, তেমনি কাছাকাছি কি হবে সে ব্যাপারে দু’পক্ষই নিশ্চিৎ সত্য দেখতে পায়, আর বলে। তার মানে, মানুষের মগজ আর মডেল কাছাকাছি বিষয়ে কাজ করে। এই যদি ফল হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশ্বাসী অবিশ্বাসীর ঝগড়া কি নিতান্ত নিরর্থক নয়? আমরা না মানলেও পৃথিবীতে যারা বুদ্ধিবলে (ফলতঃ, অর্থবলেও) সুখে আছে, তারা এ ব্যাপারটা যে ধরে ফেলেছে তা প্রথম বুঝি, ইনভেস্টরদের কাছে তেল-এর কুয়ো খোঁজার টাকা চাইতে গিয়ে। আমাদের মধ্যে কে নারকোল ফাটিয়ে এসেছে আর কে এমনি এসেছে তার তোয়াক্কা না করে দুদলেরই দূরগামী আশা বা নিরাশার বচনকে তারা সমান সন্দেহের চোখে দেখে, পয়সা দিতে চায় না। 

আমরা বরং লড়াই করি মারি’র-অসুর নামলে,                                                                                             গ্যালাক্সি আর নেবুলা যত- ঠাকুর রাখুন সামলে।

ইনভেস্টররা কি চোরা নাস্তিক? ভাবতে গিয়ে দেখি, সাধারণ মানুষও তাই। অতি ভক্তও এটিএম-এ আর বাজারে টাকা গুনে নেন। ভগবান তুমি দেখে নিয়ো বলে নিশ্চিন্ত থাকেন না। আর এখানেই মগজ দেবার সুফলপ্রাপ্তি ঘটে ঈশ্বর বা প্রকৃতির। তাঁরা যেন বলে দিয়েছেন, ‘বুদ্ধির চর্চা করো আর যত এগোবে ততই খুঁটিনাটি কাজ থেকে আমাদের মুক্ত করো।‘ মানুষ, আস্তিক-নাস্তিক, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে জেনে বা না জেনে এই নির্দেশ পালন করে চলেছে। যেমন ধরুন, আগে মায়েরা বলতেন, ছেলে নিরাপদে কর্মস্থলে পৌঁছলে যেন জানতে পারি, ঠাকুর। কায়মনোবাক্যে এমন চাইলে দেবতা কখনো স্বপ্নের মাধ্যমে কখনো দৈববাণীতে কাজটা করে দিতেন। টেলিফোন, বিশেষতঃ সেলফোন হবার পর থেকে ভক্তরা সেই কাজ থেকে দেবতাদের স্বেচ্ছায় ছুটি দিয়েছেন, তাঁরা ফ্রি হয়ে মহাজগৎকে ম্যানেজ করার দিকে আরও সময় আর মন দিতে পারছেন বলেই হয়তো বুড়ো চাঁদ বা দুষ্টু গ্রহাণু পৃথিবীর সাগরে পর্বতে চরম টান মেরে মহাকালের হিসেব লেখার খাতার পাতা জুড়ে একটা বড় সড় শূন্য এঁকে দিতে পারছে না।

আগের একটা ব্লগে (মেকি-মুগ্ধ) তে লিখেছিলাম, নীল আকাশের নীচে প্রায় কোন শুদ্ধ বস্তু-ই টেঁকসই হয় না, বিশুদ্ধ হলে আমরাও টিঁকব না। এটি স্বীকার করা ভাল যে আমরা ক্ষেত্রবিশ্বাসে নাস্তিক (অবিশ্বাসী) বা আস্তিক (বিশ্বাসী)। স্ববিরোধীর আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বাসীদের বুঝতে হবে যে ঈশ্বর বা প্রকৃতি মগজ দিয়েছেন সাধ্যের মত কাজগুলো যাতে তাঁদের ঘাড়ে না ঠেলি। এই আয়ত্ত্বের পরিধিটা ক্রমাগতঃ বাড়িয়ে চলাই তাঁদের ইচ্ছাপালন। সবচেয়ে বেশি ধার্মিক লোক আফ্রিকাতে, তবু তাদের তেমন উন্নতি হচ্ছে না, পরীক্ষার আগে পড়াশোনা না করে শুধু প্রার্থনা করে পাস করা সম্ভব হচ্ছে না, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নিয়ম না মানলে নারকোল ফাটিয়ে, বয়েৎ আউড়ে পুল বানালেও তার অতি দ্রুত ভেঙ্গে পড়া আটকানো যাচ্ছে না- এ সব সেই ইচ্ছারই পরোক্ষ প্রকাশ। ঈশ্বর বা প্রকৃতি চান বিজ্ঞানের ল্যাবে বিশ্বকর্মার পূজাপদ্ধতি নয়, আমরা যেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ঠিক করে পালন করি; গাড়ী চালানোর সময় ড্যাশবোর্ডের গণপতিতে নয়, সামনের রাস্তায় মন রাখি। 

কড়া যুক্তি মানা ভবিষ্যদ্বাণীর বিফলতায় ম্রিয়মান অবিশ্বাসীদের বুঝতে হবে যুক্তিবাদ আর অবিশ্বাস তাদের দিগন্তদর্শনে তেমন কোন বিশেষ ক্ষমতা দিচ্ছে না। বিশ্বাসীদের সাথে তাঁরা এ ক্ষেত্রে একই নৌকোর যাত্রী যখন, কিসের এত ঝগড়াঝাঁটি, কিসের এত রাগ? মহা অবিশ্বাসী স্লাভোজ জিজেক-ও বলছেন, ,লম্বা লম্বা ভবিষ্যদ্বাণীতে ভরসা রাখতে পারি না’। কাছের জিনিষের জন্য মোদ্দা কথা বলে গেছেন বিবেকানন্দ, ভগবানের ভরসায় না থেকে ‘ওঠো জাগো, নিজের প্রাপ্যটি অর্জন করো’, শ্রীআরবিন্দ বলেছেন, ‘বেঁচে থাকা মানে প্রতিদিন নিজের ক্ষমতাসীমার বেড়াটিকে একটু করে বাইরে ঠেলা’- মানে, দেবতাদের প্রয়োজনকে কমিয়ে আনা…নিজেদের চেষ্টায় অস্তি থেকে নাস্তি আনা, আর সেটুকু করার পর…… 

না হয় গেলেন গুরু-গৃহে, না হয় খেলেন পান                                                       হোয়াটসঅ্যাপে ডাকিয়ে দিলেন ফরোয়ার্ডের বান,                                                                                 লোকে তাতে খুশী-ই র’বে, বিরাগ হবে কার?                                                                                দেবতারাও তুষ্ট হবেন, কমলে তাঁদের ভার।।                                                                                                

                                                                -অরিজিৎ চৌধুরী

*শিরোনামটি সম্পূর্ণ আমার নয়, তাতে ওমর খৈয়ামের এই মায়াময় কবিতাটির ছোঁয়া (তর্জমা-শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

ঐখানে তাঁর গোপন সফর সৃষ্টিপথের সড়ক দিয়ে,                                                                                                তোমার ব্যথা বিষণ্ণতা ভোলান তিনি হাত বুলিয়ে,                                                                                                                     নাস্তি থেকে অস্তি আনেন- ঐখানে তাঁর সার্থকতা,                                                                                                                                                             কিন্তু তিনি একাই থাকেন সঙ্গী-সাথীর সাধ ঘুচিয়ে।

 

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.