‘দূরদর্শনে রায়সাহেব’

কলকাতায় টেলিভিশন এসেছে ৯ই আগস্ট, ১৯৭৫ । সেই বছরই জুন মাসে ইমারজেন্সী ঘোষণা হয়েছে । রাজ্যে ও কেন্দ্রে তখন একই দলের শাসন । ১৯৫৯ সালের ১ই সেপ্টেম্বর অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ছত্রছায়ায় সরকারী টেলিভিশনের যাত্রা শুরু দিল্লীতে । নগরীর আশেপাশে কিছু পল্লীতে তখন টেলিভিশন সেট ছিল ভিজাত্যের প্রতীক । সেই প্রতীকের ছোঁয়া পেল ১৯৭৫ সালে কলকাতাও দেশের আরো নটি শহরের সাথে । 

সত্যজিত – মৃণাল – ঋত্বিক ভারতীয় সিনেমার নতুন তিন সত্যি কাজ করছেন গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাস্তব জীবনকে নায়ক করে, কোন প্রলেপ নয়, অকারণ স্বপ্ন নয়, মায়াবী কাগজে চোখ না রাঙ্গিয়ে জীবনের চালচিত্র তৈরী করতে শুরু করলেন তিনজনই তাঁদের প্রতিটি নির্মিতিতে । সিনেমাবোদ্ধারা পরবর্তীতে তাঁদের কাজকে নানা নামে অভিহিত করেছেন কিন্তু আমরা যাঁরা সাধারণ দর্শক, তাঁদের সব শিল্পকর্মের মধ্যেই নিজেদের আশা-আকাঙ্খা-ভালোবাসা-ভাবনা-দুর্ভাবনা সব খুঁজে পেতাম

শব্দ, প্রতীক, সংকেত, বিশ্বাস, লোকাচার, নিয়ে যে জগতে মানব সভ্যতা দিনে দিনে বিকশিহয়ে উঠেছে, এই তিনজনই সেলুলয়েডে তা প্রকাশ করেছেন তাঁদের সৃষ্টিতে । সেলুলয়েড, এই যেমন সাদা পাতায় কলমের আঁচড়ে এই লেখা লিখছি, সেলুলয়েডও সেই রকম সাদা পাতা যেন, ক্যামেরায় চিত্রনাট্য অনুযায়ী ছবি তুলে তাকে এডিট করে যখন সিনেমার পর্দায় দেখানো হয় তখন সেখানে নানারঙের মাধুর্য যে অনুভূতি দর্শকের মনকে উদ্দিপ্ত করে সেটাই একজন চিত্রপরিচালকের শেষতম চাহিদা । 

সত্যজিৎ রায় একটি বিখ্যাত পরিবারের মানুষ । ঠাকুরবাড়ী ছাড়া নবজাগরণের আধুনিকতায় মোড়া আর যে পরিবারটি বাঙালীর র্বের ঠিকানা সেই মসূয়া পরিবার তারই এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তিনি । চোখের দেখা আর দেখার চোখ যেমন এক নয়, তেমনি মনের দেখা আর দেখার মনও ভিন্ন । সত্যজিৎ রায়-এর এই দেখার চোখ আর দেখার মন  দুটোই ছিল । শিল্প শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতন গেছিলেন মায়ের পরামর্শে, গুরুদেবের আহ্বানে । সেই স্বল্প কিছু বছর, গুরুদেবের মৃত্যুর পরপরই যে জায়গা তিনি ছেড়ে এসেছিলেন, সেখানে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বোস আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ে-এর কাছে । অন্তরজগৎ যে সাড়া দিয়েছিল তার কিছু নমুনা সম্প্রতি প্রকাশিত সন্দেশের পাতায় মাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলিতে আমরা পাই । তারপর তো পথের পাঁচালি, অপুর সংসার, অভিযান, চারুলতা কত কত ইতিহাস । 

অরণ্যের দিনরাত্রি, সীমাবদ্ধ, নায়ক আর প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর অন্য ভাবধারার ছবি । আধুনিক রাংতামোড়া জীবন সব পাওয়ার আকাঙ্খায় ডুবে থাকে, পেয়ে গেলে অসীম শূন্যতা, জীবনের এই মোচড় তাঁর এই ছবিগুলিতে দীপ্যমান । এই ছবিগুলির উল্লেখ এই জন্যই করলাম আগামী দিনে যখন দূরদর্শন তাঁকে সিনেমা বানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাবে, সেই দূরদর্শনে যে তিনি একদম অন্য বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন  সেই বিষয়কে একটু মনের আড়াল থেকে দেখা । কলকাতায় দূরদর্শনের আত্মপ্রকাশ ৯ই আগস্ট, ১৯৭৫ জরুরী অবস্থার সময় আগেই বলেছি । সেই সময় টালিগঞ্জের রাধা স্টুডিওতে যে অপ্রতুল ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত আবেগ সম্বল করে একদল কর্মী বাঙালীর সন্ধ্যেবেলা সাদা-কালোয় আলোড়িত করে তুলতেন আজন্ম কলকাতাবাসী সত্যজিৎ রায় সেই কৌতূহল থেকে দূরে থাকতেন না ।  সেকথা আমার পূর্বজ বেশ কিছু সহকর্মীর কাছ থেকে শুনেছি । এখানে বলে রাখা ভাল সত্যজিৎ রায়-এর সঙ্গে কোন সশরীরি সাক্ষাৎ আমার হয় নি, হওয়ার কথাও নয়, কারণ এই মিডিয়াতে চাকরি আমার হয়েছে বেকারত্ব ঘোচানোর দুর্মর ইচ্ছায় UPSC-র চয়নে । একটা দূর দূর মিল হয়ত আছে আমি আজন্ম কলকাতাবাসী; সত্যজিৎ রায় এবং অন্যান্যদের সিনেমা দেখে বড় হয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করেছি আর ইকনমিক্স নিয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে গেছি যেটা সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে একটু উল্টো হয়েছিল; উনি প্রেসিডেন্সীতে ইকনমিক্স নিয়ে পড়ে শান্তিনিকেতনে কলাভবনে আর্ট শিখতে গেছিলেন।

জরুরী অবস্থার পর জনতা দলের দিল্লীর মসনদে বসা আর তার তিন বছর পরেই ইন্দিরা গান্ধীর পুনরাগমন । ১৯৮০ সালে কলকাতা দূরদর্শন সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে । কথা বলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় । আমাদের এই গল্ফগ্রীণে এক মধ্যবিত্ত আবাসনে তিনি এখনও দিনযাপন করেন এ আমাদের বড় গর্বের বস্তু । এই অনুষ্ঠানটির প্রযোজক ছিলেন সুবিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী; তখন উনি দূরদর্শন কলকাতার এক উচ্চপদাধিকারী আর উনিও আমাদের গল্ফগ্রীণবাসী । এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি কলকাতা দূরদর্শন ছাড়াও দূরদর্শনের জাতীয় চ্যানেলে প্রচারিত হয় আর সেখানেই দূরদর্শন জানতে পারে সত্যজিৎ রায়ের দূরদর্শনের প্রতি কি প্রত্যাশা । এর কিছু বছর আগেই সত্যজিৎ রায় হিন্দীতে একটি ছবি করেন শতরঞ্জ কি খিলাড়ী । এটি প্রেমচন্দের লেখা । বহির্জগতের আমূল পরিবর্তনের শঙ্কাতেও ভারতীয় শাসনতন্ত্র উট পাখীর মতন নিজস্ব নিশ্চিন্তি খুঁজে নেওয়ার যে ভ্রান্তি করে, জরুরী অবস্থার আগে পরে ভারতীয় শাসকের সেই ভ্রান্তির সংকেত তিনি ঐ ছবিতে পরিস্ফুট করেন ।এখানে একটা ঘটনা বলা উচিত ছবিটি  করার জন্য রিচার্ড অ্যাটেনরো সে সময় কলকাতায়।কলকাতা দূরদর্শনের তৎকালীন ডিরেক্টর মীরা মজুমদার চাইলেন ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেবেন সত্যজিৎ রায়।। কলকাতার একটি নামকরা হোটেলে প্রায় মাঝরাতে  এই ইন্টারভিউ এর ব্যবস্থা হয়। সেই রাতে কলকাতা দূরদর্শনের কোন কর্মীর ছুটি  ছিল  না।

১৯৮০ থেকে ১৯৮২ ইন্দিরা গান্ধীর সরকারে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন বসন্ত শাঠে । মূলত: তাঁরই উদ্যোগে দূরদর্শন সত্যজিৎ রায়কে টেলিফিল্ম করার আমন্ত্রণ জানালো । এই সময় সত্যজিৎ রায়ের বড় কোন ছবি শেষ হয়েছে

মাত্র ১৭ দিনের শুটিং শিডিউলে তিনি দূরদর্শনে ছবি করার জন্য গল্প বাছলেন প্রেমচন্দেরই ‘সদ্গতি’ । ব্রাহ্মণ্যবাদের চাতুর্য দলিতকে নিষ্ক্রিয় শোষিত হিসেবে দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টায় জল ঢেলে ব্রাহ্মণের হাতেই দলিতের সৎকার, ভারতীয় সামাজিক বিপ্লবহীন ভূখণ্ডের নিষ্ঠুর শোষণের প্রতি তাঁর ব্যঙ্গ সত্যজিৎ রায় দূরদর্শনের মাধ্যমে জনমানসে পরিস্ফূট করেছিলেন । সম্প্রতি মোহন আগাসে , ঐ ছবিটির ব্রাহ্মণ ভূমিকাধারী চরিত্র, একটি সমাজ মাধ্যমে অনেক কিছু বলতে গিয়ে জানিয়েছেন মহীরুহম মানুষটির বড় মনের কথা। বোম্বে থেকে ট্রেনে শুটিং স্থল রায়পুর-এ এসে স্টেশনে নেমে দেখেন তাঁকে আর ওম পুরীকে রিসিভ করতে এসেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় সদ্গতি ভারতীয় চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিল। সেসময়ের রাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনের অভিমুখও স্পষ্ট করেছিলবহুজন সমাজ পার্টি, তৎকালীন মণ্ডল কমিশনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, এবিরাটসংখ্যক মানুষ নিজেদের অধিকার প্রকাশ করার ভাষা পেয়েছিল । সিনেমা তৈরী হয় সিনেমা হলে নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শকের কথা মাথায় রেখে । দূরদর্শন কিন্তু গণমাধ্যম । তাই তার শক্তি অনেক বেশী । হিন্দীতে হওয়ার জন্য ‘সদ্গতি ’ অনেক মানুষকে ছুঁতে পেরেছিল । একটি গল্প এখানে নিশ্চয়ই করতে হবে।

দূরদর্শনের জন্য এই ছবি কমিশন্ড প্রোগ্রাম বিভাগে তৈরী হয়েছিল । এখানে পরিচালকদের দূরদর্শন ছবি করার জন্য টাকা দিত । সত্যজিৎ রায় সদ্গতি নির্মাণের পর বেঁচে যাওয়া টাকা দূরদর্শনকে ফিরিয়ে দেন, বলেন, এই টাকা দূরদর্শনের নয়, জনগণের টাকা । 

কিন্তু এরপর সত্যজিৎ রায় সরাসরি দূরদর্শনের জন্য কিছু করে ওঠেন নি। ৮০র দশকেই তিনি আরো বড় পর্দার ছবি করার দিকে মন দেন এবং তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে । কয়েকটি ছবি তাঁর প্রায় Indoor-এ শুটিং করে তৈরি হয়েছি। এই সময় সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস ,নামে দুটি দূরদর্শন নির্ভর ছবি তৈরী হয় । কিস্সা কাঠমান্ডু কা ওঁরই গল্প । সন্দীপ রায় পরিচালনা করেন । এরপর সত্যজিৎ রায়ের ১৩টি গল্প নিয়ে  ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’-এর দ্বিতীয় কিস্তি । পরিচালক সন্দীপ রায় । সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায় । 

এই গল্পগুলিই দুরদর্শনের জাতীয় কার্যক্রমে হিন্দীতে প্রচারিত হয়েছিল । শশীকাপুর ছিলেন অন্যতম অভিনেতা ।

দূরদর্শনের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের নাম একবার প্রস্তাহয়েছিল কিন্তু তার কোন প্রামান্য নথি হাতে নেই ।

বিভাস চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়-এর গোকধাম রহস্য আর ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা কলকাতা দূরদর্শনের জন্য বানিয়েছিলেন । ২০২০ সালে লকডাউনে প্রথমটি পুরুদ্ধার হয় এবং ডিজিটাইজ করে আমরা সেটি দেখাই । 

পৃথিবীর খুব কম বড় চিত্র পরিচালকই টেলিভিশনের জন্য কাজ করেছেন । এদিথেকে সত্যজিৎ রায় অনন্য । যদি দূরদর্শনকে আর একটু সময় দিতেন আমরা নিশ্চয়ই এমন কিছু পেতাযা লিগ্যাসি হতে পারত । 

শেষে বলি, সন্দীপ রায়ের সাক্ষাকারের জন্য বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে গেছিলাম । সেই বড় চেয়ারটি এক বিশাল শালপ্রাংশু পুরুষকে মনে করায় ।  

 

About the author

Arunava Roy,a retired Group A officer from Doordarshan had studied Economics in Santiniketan,Visva-Bharati commenced his career with ISI,Kolkata,worked as Statistician,Labour Dept. Govt of West Bengal joined Akashvani through UPSC in 1991.Worked at Agartala,Panaji,Kolkata,Port Blair AIR kendras.He experienced Tsunami 2004 as broadcaster.Later he worked for Marketing wings of Prasar Bharati.In 2016 Sri Roy joined Doordarshan kendra Kolkata as Head of Programme.He also looked after the East Zone.During this tenure Sri Roy was instrumemtal to augments the viewrrship of this PSB Channel manifold.He introduced the Live Bengali commentary of Puri Rathayatra.Sri Roy is associated with different Universities as guest lecturer on media sciences. Sri Roy retired from service on 30.09.2022.