কিন্নরী কথা

কলমে – গালিব লেখনিয়াল

স্থান – বম্বে
কাল – সত্তরের দশক
পাত্র – অনুপ ও সঞ্জীব

অনূপ বছর তেইশের তরুন, বছর দুয়েক হোল বাংলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে বম্বেতে এসে চাকরি করছে। সঞ্জীব ওর সহপাঠি, সেও বম্বেতে চাকরি নিয়ে এসেছে। দুজনে একসাথে থাকে, নিজেরাই রান্না করে খায়। খরচের সাশ্রয়ের যুদ্ধ।

এক সন্ধ‍্যেয় দুজনে বাজার করতে এসেছে, সবজি কিনতে হবে। হাতে বাজারের ব‍্যাগ। এগুলো ওদের সাধারণ দিনচর্চার অঙ্গ। কিন্তু মনে, বডি ল‍্যাঙ্গুয়েজে যুদ্ধের প্রস্তুতি। মনে মনে সবাই যেন প্রতিপক্ষ। চাকরির শুরুতে যখন মাইনে পত্র কম থাকে, যখন খরচ নিয়ে বেশ টানাটানি তখন পৃথিবীকে প্রতিপক্ষই মনে হয়। যেন সকলেই ঠকাতে চাইছে। তাদের আটকাতে নিজের মন যেন সব সময়ে ঢাল উঁচিয়ে অতন্দ্র প্রহরী। খরচের প্রতিটা পদক্ষেপে সতর্কতা। ফাঁক ফোকর গলে কেউ যেন ঠকাতে না পারে। প্রতিটা পয়সা হিসেব করে খরচ করার চেষ্টা।

বাজারে ঢেলে রাখা সবজি দেখতে দেখতে অনূপ আড় চোখে দেখলো, অদূরে দুই কিন্নরী তালি বাজিয়ে পয়সা চাচ্ছেন বাজারিদের কাছ থেকে। খুবই সাধারণ দৃশ‍্য। অনেক জায়গাতে, অনেক সময়েই নজরে আসে। তবে সেই উপস্থিতি লোকেদের মনে এক অস্বস্তির উদ্রেক করে। লোকে এড়িয়ে যেতে চায় সেই সংস্পর্ষ। … করে পরিহার, বিষাক্ত তার সঙ্গ. . .

এড়ানোর জন‍্য চোখ সরিয়ে অনুপ ভিন্ডি বাছতে থাকে উবু হয়ে বসে। যখন ওজন করে ভিন্ডি ব‍্যাগে ভরে পয়সা দিতে দাঁড়িয়েছে, হঠাৎ পাশে তালির শব্দ, সামনে বাড়ানো হাত।

হকচকিয়ে অনুপ না দেখার ভান করে। তাতে কিন্নরী যূগল আওয়াজের আর তালির ডেসিবেল বাড়িয়ে দেয়, তাদের অঙ্গভঙ্গির অশালিনতা বাড়ে। দেনেয়ালাদের অপ্রস্তুত করে তাদের পকেট হাল্কা করতে এগূলো বেশ কার্যকরী কৌশল। এবার অনূপ মূখ খোলে – নেহি হ‍্যায়। সেই যূগল আরও মারমুখী হয়ে ওঠে। অনুপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওরা অনুপের বেল্টের বাকলে্ হাত দেয়। অপ্রস্তূত অনুপ নিজের দল ভারী করার জন‍্য তাকায় পাশে, সঞ্জীবের দিকে। ওমা, সঞ্জীব সটকে পড়েছে বেগতিক দেখে, ওকে দেখা যাচ্ছে না। অনুপ এখন একা।

বাজার ভর্তি লোকের সামনে দুই যুযুধান পক্ষ এখন শার্প ফোকাসে। পরিস্থিতি অনুপকে খাদের একেবারে শেষ প্রান্তে নিয়ে আসে। হয় পয়সা দাও নয়তো ওদের থেকেও জোরে প্রত‍্যাঘাত হানো। অনুপ দ্বিতীয়টা বেছে নেয়। রুখে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় বলে – হম নেহী দেঙ্গে। হমারা কামাই তালিয়া বাজাকে নেহি আতা, পাসীনা বহানা পড়তা হ‍্যায়।

সেই কিন্নরী যুগল বেল্টে হাত দেয়াকে উইনিং স্ট্রৌক ভেবেছিল। এরকম মজবুত ডিফেন্স আশা করে নি। এখন এই গোল-লাইন সেভ দেখে তারাও ঘাবড়ে গিয়ে সরে পড়ে।

সময় গড়িয়ে যায় আরও 30 বছর। অনুপ এখন কর্মজীবনে সফলতার উচ্চ সোপানে। সারথি-চালিত গাড়ীর শীতলতায় রাস্তার রেডলাইটে দাঁড়িয়ে দেখে সামনের গাড়ির জানলায় এক কিন্নরীর আবেদন।

এখন অনুপ সহানুভূতিশীল হয়। ওদেরও তো বেঁচে থাকার সাধন চাই। বর্তমান স্বচ্ছলতার প্রলেপে 30 বছর আগেকার তিক্ততা এখন আর নেই। অনূপ ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ওকে দেবার জন‍্য। কিন্তু সিগন‍্যাল গ্রীন হয়ে গাড়ি এগিয়ে যায়, কিন্নরী আসার আগেই। অনুপের মনটা খচখচ করতে থাকে।

এই হলো জীবনের চিরন্তন ওয়ার্ক-ইন-প্রোগ্রেস। মনের নতূনকে গড়া আর পুরোনোকে ভাঙ্গার চিরকালীন খতিয়ান, এক নিরন্তর প্রবাহ।

(শেষ)