ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 

রবীন্দ্রনাথ পাঁচ স্তবকের জনগণমন গানটি লেখা শেষ করেন ১১ই ডিসেম্বর, ১৯১১। সেটির প্রথম স্তবকটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের ঘোষণা মোতাবেক গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারী। জন্মলগ্ন থেকেই গানটি কি উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক যে মাঝে মাঝে উঠতেই থাকে, তার একটি প্রধান কারণ গানটি যখন লেখা হয় তখন সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রতি ভারতের করদ রাজাদের আনুগত্য জ্ঞাপনের জন্য ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীর করোনেশন পার্কে দিল্লী দরবার-এর প্রধান কার্যক্রমটি অনুষ্ঠিত হয় আর সেখানেই বঙ্গভঙ্গ রদ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

নানা রাজনীতিক ছাড়াও প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু গানটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে কোন বড় মানুষ ভুল করতে পারেন, তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি অস্বীকার করলেও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে তা যথেষ্ট হতে পারে না, বিশেষতঃ তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী-ই পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি করে একটি কবিতা/গান লেখার প্রস্তাব তাঁর কাছে এসেছিল। ১৯৩৭ সালে একটি চিঠিতে তিনি পুলিনবিহারী সেন’কে লেখেন- “সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সেকথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেননা  তাঁর ভক্তি যতই প্রবল থাক  বুদ্ধির অভাব ছিল না।” 

এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়, কোন সম্রাটের সভায় নয়, ঐ বছরের কংগ্রেস অধিবেশনে (২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৯১১)। তার আগে দিল্লী দরবারে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দ্য ইংলিশম্যান এবং দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল যে  জনগণমন ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তির উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। বার বার নানা জায়গা থেকে অভিযোগ উঠেছে। এ রকম ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে সম্রাটস্তুতির অভিযোগ মেনে নিয়ে গানটির ছত্রে ছত্রে আর কবির তৎকালীন মানসিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে (সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স) সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজে দেখা বিধেয়। 

অভিযোগ- কবি গানটি অন্তরের প্রেরণায় লেখেন নি, লিখেছেন ফরমায়েশ মানার তাগিদে।

উত্তর- ১৯১১ সালে, তাঁর নোবেল পাওয়ার দুবছর আগে, কবির কোন ‘অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া বলিলেই লিখিয়া দিব’ ধরণের অবস্থায় থাকার বাস্তব কারণ ছিল না। ১৯০১ সালে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পুরোধা, ১৯০৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সভার সভাপতি রবীন্দ্রনাথের ওরকম চাপল্যের কোন যুক্তিসম্মত কারণ পাওয়া মুশকিল।

এবার প্রত্যক্ষ গানটিতে যাওয়া যাক।

প্রথম স্তবকঃ

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উত্‍‌কল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে,    তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

মন্তব্য- সবাই জানে কবিরা অতিশয়োক্তির জন্য বিখ্যাত, বিশেষতঃ যখন তারা প্রশস্তি করেন। এ ক্ষেত্রে, যাঁর সাম্রাজ্য প্রায় পাঁচটি মহাদেশে বিস্তৃত এমন এক সম্রাটের স্তুতিতে বিশ্বভাগ্যবিধাতা একবারও না বলে পুরো পাঁচটি স্তবক জুড়ে তাঁকে ভারতভাগ্যবিধাতা বলে কবি সম্রাটের প্রাপ্য গৌরবকে সংকুচিত করে রাখায় অন্য রকম সন্দেহ ঘনিয়ে ওঠে। মনে হয়, তিনি যাঁর কথা ভাবছেন তিনি সেই রাজার রাজা, যাঁর   বিস্তৃত মহাবিশ্বলোকে এসব তুচ্ছ ভাবনা ঠাঁই পায় না। কবির ভাবনায় তিনি এই রকম-

“তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে

তবু আমার হৃদয় লাগি

ফিরছ কত মনোহরণ বেশে

প্রভু, নিত্য আছ জাগি।“

অভিযোগ- তিনি যে রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটেনের নিরঙ্কুশ শাসন তাদেরই উল্লেখ করে কাশ্মীর, অন্ধ্র, কেরল, রাজস্থান, মহিশূর ইত্যাদি প্রধান দেশীয় রাজ্যগুলির নাম অনুল্লেখিত রেখেছেন।   

উত্তরঃ এই অভিযোগটির ভিত নড়বড়ে। এ কবিতায় অন্ধ্র সহ দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্য ‘দ্রাবিড়’ কথাটির মধ্যে ঢুকে যায়। তা ছাড়া যাঁরা কবিতা লেখেন তারা জানেন ইচ্ছে থাকলেও কিছু কিছু বাদ না দিয়ে ছন্দ-মেলানোয় কত বাধা। ভাল কবিতা পরিমিত শব্দবিন্যাসে পূর্ণতার স্পর্শ এনে দেয়। এই কারণে গঙ্গা, যমুনা ছাড়া তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বহমান ব্রহ্মপুত্র, নর্মদা, তাপ্তি, মহানদী, কৃষ্ণা, গোদাবরীও যে বাদ পড়ে গেছে তা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় । 

দ্বিতীয় স্তবকঃ

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে   তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে॥

মন্তব্য- ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৮-৫৯ সালে নীল দর্পণ প্রকাশিত হবার পর স্তুতি বা অন্য কোন অজুহাতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে উদার বাণী বা প্রেমহার গাঁথা’র কথা যে কোন ভারতীয় সাহিত্যিকের পক্ষেই কষ্টকর ছিল। তাঁরা, বিশেষতঃ অতি প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথ, এ কথাগুলি বাদ দিয়েও প্রশস্তি রচনা করতে পারতেন। তা করেন নি বলেই সন্দেহ হয় কবিতাটির লক্ষ্য সম্রাট ছিলেন না। তার চেয়েও বড় কথা, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি বাংলাকে ভাগ করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রয়াস করে। গানটি যে দিন রচনা হয় তখনও বঙ্গভঙ্গ রদ হয় নি। সেই বিভাগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের নেতা রবীন্দ্রনাথ কি সম্রাটকে জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক বলতে পারেন? কিছুতেই পারেন না। স্তুতি যে ব্রিটিশ সম্রাটের নয় তা শুধু ‘ঐক্য-বিধায়ক’ বিশেষণটিতেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

তৃতীয় স্তবকঃ

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

মন্তব্য- গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথ মানুষের মরণশীলতা, ব্যক্তিবিশেষের অনিত্যতা নিয়ে সচেতন ছিলেন না ভাবলে অবিচার হবে। সে জন্যই ‘চিরসারথি’ বলে তাঁর কোন মানুষকে সম্বোধন করা অবিশ্বাস্য মনে হয়। তা ছাড়া, অত্যাচারী, সাম্রাজ্যবাদী শাসককে রবীন্দ্রনাথের মত একজন সংবেদনশীল মানুষের জনগণপথপরিচায়ক বলে সম্বোধন করাও বিশ্বসনীয়ের সীমানা পেরিয়ে যায়।  

চতুর্থ স্তবকঃ

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে      রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

মন্তব্য- অন্য কথা বাদ দিলেও পশ্চিমের সম্রাটকে নারী হিসেবে বর্ণনা করার ভয়ঙ্কর ব্লাসফেমি কাব্যিক স্বাধীনতার আড়ালে ঢাকা যাবে-পরাধীন দেশের কবি নিশ্চয় সে আশা করেন নি। আবার মনে হয়, যাঁকে উদ্দেশ্য করে গানটি লেখা তিনি পুরুষ পঞ্চম জর্জ নন, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের অর্ধনারীশ্বর যাঁর মধ্যে মাতৃভাব আর পুরুষকার একাকার ।

পঞ্চম স্তবকঃ

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে   নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

মন্তব্য- ব্রিটেন ভারতের পশ্চিমে জানার পরেও সেখান থেকে আগত সম্রাটের স্তুতিতে পূর্ব দিকে সূর্যোদয়ের কথা দেখলে কবির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ গাঢ়তর হয়। প্রথম দুটি লাইন সামান্য অদলবদল করে এরকম লেখাই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল-

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল নবীন রবি আজি পশ্চিম গগনে—
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনসৌরভ আনে।

পাঠক পুলিনবিহারী সেনকে লেখা কবির পত্রটি বিবেচনা না করলেও জনগণমন গানটির ছত্রে ছত্রে সম্রাটের চেয়ে অনেক ওপরে এক কল্যাণময় প্রায় শাশ্বত অস্তিত্বের ঘোষণা দেখতে পাবেন। একটু খোঁজ নিলে এও জানবেন, তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে অনেক বেশী পরিচিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের স্থাপনা উপলক্ষ্যে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেন। 

তথ্য না দেখলেও খোলা মনে জনগণমন গানটির পাঁচটি স্তবক পড়লে বোঝা যায় ধীমান, অলোকসামান্য প্রতিভার অধিকারী এক কবি তাঁর রচনাকে মহিমায়, দার্শনিকতায় সকল দিগ্বিজয়ী, সব সম্রাটের আয়ত্তাতীত এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। 

বাকি সব কথার কথা…

১৩ই মে, ২০২৩                                                                          -অরিজিৎ চৌধুরী

তথ্যসূচী

রবীন্দ্রগানের অন্তরালে- পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, আনন্দ পাবলিশার্স,২০২৩

Does India’s national anthem extol the British? – BBC News

গীতবিতান- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

দ্বন্দ্ব-পুরাণ- সৈয়দ মুজতবা আলি রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ২০০৬

সাগরী- রবীন্দ্র সংখ্যা, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন চেন্নাই শাখা, ২০০৯

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.