Part 4
( Continued from part 3)
অরণ্য উঠায়ে লক্ষ শাখা মর্মরিছে মহামন্ত্র
৯
পাহাড়ে রাতের চলতে থাকা অন্ধকার বড়ো রহস্যময়ী, বড়ো সুন্দরী। একপাশে খুব উঁচু পাহাড়ের আবছা বিশাল অবয়ব, অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, একটা বিরাটত্বের আভাস যেন। উঁচু উঁচু গাছের ঘন সারি রাতের অন্ধকারে দেখায় কালো, যেন ভুতেদের মিছিল। দূরে পাহাড়ের কোলে বসা কোনো গ্রামের টিমটিমে আলো উচ্চতার ধারণা দেয়। আর আরেক পাশে গভীর খাদ। সেখান থেকে কোনো বয়ে চলা নদী বা স্রোতের শব্দ কানে আসে। পৃথিবীটাকে মনে হয় হয় যেন গাড়ির হেডলাইটের চলতে থাকা আলোর বৃত্তের একটা ভূখণ্ড, এর বাইরে আর কিছু নেই। ওখানেই ফুরিয়ে গেছে। বেশ গা ছমছম করা অনুভুতি বড়োদের পক্ষেও। বাচ্চারা কি এরকম অবস্থায় গাড়িতে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে ? কে জানে।
গাড়ির ড্রাইভার সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। তিনি কথা টথা বেশি বলেনও না বেশি শোনেনও না। চুপচাপ নিজের পছন্দ মতো কাজ করে চলেন। ঘন্টা খানেক চলার পর, তখন প্রায় রাত আটটা বাজে, তিনি গাড়ি থামালেন। একটা ছোটো বসতি। সামনে একটা ঢাবা, টিম টিম করে আলো জ্বলছে। খদ্দের বা ঢাবার কর্মচারিদেরও দেখা যাচ্ছে না। তারা বোধহয় খদ্দের নেই বলে ভেতরে কোথাও বসে আছে।
ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে কিছু একটা যেন বলে চলে গেলেন। সাথের লোকটাও নেমে গিয়ে নজরের বাইরে চলে গেল। ড্রাইভার এর বলা কথা ম্যানেজার সাহের কিছুই ধরতে পারেন নি। সেটা দৈববাণীর মতো এমন হঠাৎ করে একবারই মাত্র বলা হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন এরা বোধহয় বাথরুমে গেছে। কিন্তু এখনও ফিরছে না ! কি ব্যাপার ? গাড়িতে বসে থেকে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়েও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
আবার ভয়ের আনাগোনা। শেষে কি এখানে এতদূর অবধি এসে আমার চোখে ধুলো দিলো !
তখন গাড়ির জানলার সামনে এক মুর্তির উদয়। তার কথা অতি কষ্টে পাঠোদ্ধার হলো – রাত্তিরে গাড়ির এখানেই হল্ট। ড্রাইভার এখন আর যাবে না। ঐ দেখো, ওরা ভেতরে খেতে বসেছে। খেয়ে রাতে এখানেই ঘুমোবে। কাল ভোরে ফের যাত্রা সুরু হবে। তুমিও এখানে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এখানে ‘আরাম করার’ জায়গা আছে।
ওরে বাবা। এত সব খবর ড্রাইভার সাহেব তার দু লাইনের দৈববাণীতে সেরে দিলেন ! তা আর আমি কি করে বুঝতে পারবো ? অগত্যা ম্যানেজার সাহেব গাড়ি থেকে নেমে খাওয়া সারলেন। ততক্ষণে ড্রাইভার আর সেই মুর্তিমান খাওয়া শেষ করে নজরের বাইরে চলে গেছে। ম্যানেজারকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঢাবার সেই ছোকরাই বাৎলে দিলো, এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যান, ওপরে বিছানা পাতা আছে।
বাহ্, ভোর থেকে এত দৌড়ঝাঁপ করে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে। এখন একমাত্র নিশানা – বিছানা।
কিন্তু সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এক সত্যিকারের চমক ! ওপরে যে জায়গা সেটা একটা Attic। পুরো মেঝেটা জুড়ে একটানা চৌকির মতো একটা প্লাটফর্ম। কাঠেরই তৈরী হবে। তার ওপর পুরোটা জুড়ে গোটা কুড়ি বিভিন্ন কাপড়ের তোষক ছড়িয়ে রাখা। সেই সঙ্গে কিছু লেপও, কতগুলো বিছানার এক জায়গায় ডাঁই করে রাখা, কতগুলো কিছু তোষকের ওপরে অবহেলায় ফেলে রাখা। লেপরাও কাপড়ের রঙে অতীব বৈচিত্রময়। যদি কাউকে ১০ নম্বর তোষকে শুতে হয় আর তার আগে যদি ৯ জন আগের নটা তোষকে শুয়ে থাকে তবে শেষ জনকে এক নম্বরের জায়গায় চৌকিতে উঠে, মেসির দক্ষতায় পা টিপে টিপে প্রথম শুয়ে থাকা নজনকে কাটিয়ে তবে তার বরাদ্দ ১০ নম্বর তোষকে পৌঁছবে। এক অভিনব ঢালা বিছানা। বিছানার চাদর বা বালিশের ওয়ারের কোনো পাট নেই। মনে হলো, কাচাকুচির ঝাামেলা না রাখতেই এই ব্যবস্থা। এরা হাউসকিপিঙের ধার ধারেন না। গেস্টরা ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছেড়ে চলে যান। লেপ তোষকের ওপর এলোমেলোই পড়ে থাকে। পরের গেস্ট এসে নিজেই কোনো খালি তোষক বেছে নেন, সাথে ডাঁই থেকে একটা লেপ তুলে নেন। এভাবেই হাউসকিপিঙ চলে। ব্যবস্থাটা অভিনব।
দূরের দুই তোষকে দুজন ঘুমিয়ে আছে – মুখ দেখা যাচ্ছে না। এরা আমার দুই মক্কেলই হবে ভেবে ম্যানেজার সাহেব তার ক্লান্ত দেহটাকে চৌকিতে এলিয়ে দেন, সাথে সাথে গভীর ঘুম তাকে ঘিরে ধরে। নিখোঁজ সেই লোক যদি রাতের অন্ধকারের আড়ালে পালিয়েও যায় তাহলেও তার কিছু করার নেই এখন। তিনি তো আর পুলিশ নন যে আসামীকে বেঁধে রাখবেন। এমনিতেই তিনি অনেক ঝুঁকি নিয়ে, অনেক কষ্ট সহ্য করে, নিজের কাজের আওতার অনেকটা বাইরে গিয়ে এতদূর এগিয়েছেন। তার দাম চুকোতে হচ্ছে এই রেন-বসেরার মতো জায়গায় রাত কাটিয়ে। এর বেশী আর নয়।
এখন পর্যন্ত পাওয়া সফলতাকে ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।
১০ এতো বড় রঙ্গ জাদু
পরের দিন খুব ভোরে খুটখাট আওয়াজের মধ্যে তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি জায়গায় ম্যানেজারের চোখ একটু খোলে। শুয়ে থাকা দুজন আর জায়গায় নেই। ম্যানেজার আশঙ্কা নিয়ে দৌড়ে নীচে নামেন। চারদিক অন্ধকার, ভোর চারটে প্রায়। ড্রাইভার তৈরী হয়ে গাড়ির কাঁচ মুছছে, সাথীটি তৈরী হয়ে সিটে বসা। ধড়ে প্রাণ আসে – অঘটন ঘটে নি। তিনি চুপচাপ গাড়িতে এসে বসেন। গাড়ি চলতে শুরু করে সেই অন্ধকারের মধ্যে। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে আবার।
ঘন্টা খানেক চলার পর অন্ধকার যেন একটু ফিকে হয়। গাড়ি হঠাৎ রাস্তার ধারেএকটা চালার সামনে থামে। দুই মূর্তি গাড়ির বাইরে আসে। বোধহয় এটা চায়ের দোকান, এখানে চা খাওয়া হবে। কিন্তু চালাতে বা দোকানে কেউ তো নেই। চার পাশে কোনো ঘরবাড়িও দেখা যাচ্ছে না। সবটাই পাহাড়ের মিছিল। অরণ্য উঠায়ে লক্ষ শাখা, মর্মরিছে মহামন্ত্র। সবই দেবতার সামগীতি। ম্যানেজার সাহেব গাড়িতে বসেই সেই অপরুপ দৃশ্যান্তর – অন্ধকারের নামাবলি ফেলে দিয়ে আবছা আলোর ওড়না জড়িয়ে নেয়া – দেখতে থাকেন। এত উঁচু পাহাড়ে, এত জনমানবহীন জায়গায়, এত ভোরে পৃথিবীর বুকে সকাল হবার দৃশ্য দেখার পরিস্থিতি এর পরে আর কখোনোই হবে না।
মিনিট তিনেক কেটে যায় এভাবে। না তো দোকানদারের পাত্তা, না সেই যুগলের। তিনি গাড়ি থেকে বাইরে আসেন। প্রকৃতির সেই বিশালত্বের মাঝে, ব্রাহ্ম মুহূর্তে চেতনার উদয়ের সময় উন্মুক্ত আকাশের নীচে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, একদম একা – কেউ কোথাও নেই। সে এক গায়ে কাঁটা দেয়া অনুভব। ব্যাঙ্কের কাজের ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি।
তারপর আবছা আলোয় ভালো করে নজর করে দেখেন একটা বারো তেরো বছরের ছেলে পাহাড়ের পাকদন্ডী পথ ধরে নীচে থেকে উঠে আসছে, মাথায় শুকনো ডালপালার একটা বোঝা। এসেই সে বোঝার ডালগুলো দিয়ে চালার উনোন ধরিয়ে ফেললো। যাক, চা হচ্ছে। এবার নন্দী ভৃঙ্গীর হিসেব।
আরে, অনেকটা দূরে পাহাড়ের আরেকটা rise এ গাছের ফাঁক দিয়ে একটা জামা দেখা যাচ্ছে না ? ওটা তো নড়ছে, ওটা নিশ্চয়ই কোনো লোক। আরে, ওটাই তো ড্রাইভার ! কিন্তু ওর প্যান্টটা হাঁটুর নীচে নামানো কেন ? ফুল মন্টি ? ও ওভাবে যাচ্ছে কোথায় ? আরে, এর পেছনে ২০ মিটার দূরে তো ভৃঙ্গীও। তিনিও ফুল মন্টি ! ও, এতক্ষণে বোঝা গেল। তারা ভোরে ওপন এয়ারে প্রাত্যকৃত্য সারতে গিয়েছিলেন। এখন যাচ্ছেন একটু এগিয়ে এক ঝোরায় ধোয়ার কাজটা সারতে। হ্যাঁ, একটা ঝোরার আওয়াজ যেন দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ।
তারা ফিরে এলেন এবং বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে উপদেশ দিলেন – আপনিও ‘ফ্রেস’ হয়ে আসুন। এর পর গাড়ি আর দাঁড়াবে না। বলার টোনটা ছিল take it or leave it ধাঁচের। প্রাত্যহিক কর্মপদ্ধতির সেটাই দস্তুর হবে।
ম্যানেজার সাহেবও মহাজ্ঞানী মহাজনের গমন পথ অনুসরণ করলেন। তাকেও একই ভাবে বেশভুষার আবরণের বাইরে আসতে হলো। সে সময়ে মোবাইল না থাকায় একটা মজার ফটো পাহাড়ের কোলেই হারিয়ে গেল।
সেসব শেষ করে চা খেয়ে আবার একটানা যাত্রা শুরু। যেতে যেতে প্রথমে রোদ উঠে সকাল হলো, তারপর বেলা হলো, পাহাড়ের উচ্চতা কমতে থাকলো, তার রাজকীয় বিশালতাও কমতে থাকলো। ক্রমে বেলা গড়িয়ে দুপুর এলো, গাড়ি পাহাড় ছেড়ে সমতলে চলে এলো, আশেপাশের দৃশ্যপটের আবার পরিবর্তন। বেলা ২ টোয় গাড়িকে থামানো হলো মাঝামাঝি এক জায়গায় যেটা সেই ব্রাঞ্চের এডমিনিসট্রেটিভ কন্ট্রোল অফিস। এখান থেকে ব্রাঞ্চ আরো দেড় ঘন্টার রাস্তা।
নিখোঁজ বরোয়ারকে নিয়ে সেই অফিসে পৌছতে এই রোমহর্ষক সন্ধান অভিযানের খবর অফিসে বেশ শোরগোল ফেলে দিলো। তারপর সেখানে কর্তাদের সাথে বরোয়ারের মিটিং করিয়ে অবশেষে ক্লান্ত দেহে আর হ্রিষ্টচিত্তে নিজের জায়গায় ফিরে আসা।
Best reward for a good job is the feeling of having done it.
তারপর তার থেকে পাওনা আদায় – সেও এক লম্বা কাহিনী।
(সমাপ্ত)
খুব ভাল ভাষা, টান টান কাহিনী, ধরলে ছাড়া যায় না। এমন লেখা উপহার দেবার জন্য লেখককে অজস্র ধন্যবাদ। এই লাইন গুলো ভোলা মুশকিল – “পাহাড়ে রাতের চলতে থাকা অন্ধকার বড়ো রহস্যময়ী, বড়ো সুন্দরী।….. পৃথিবীটাকে মনে হয় হয় যেন গাড়ির হেডলাইটের চলতে থাকা আলোর বৃত্তের একটা ভূখণ্ড, এর বাইরে আর কিছু নেই। ওখানেই ফুরিয়ে গেছে।” তবে একটু হিসেবের গরমিল মনে হচ্ছে- রাজাখালে গেল তিন জন- ড্রাইভার, ম্যানেজার ও বড় ভাই। ফেরার সময় ছোট ভাই যোগ দেওয়ায় চার জন হবার কথা। কিন্তু তিন জন ফেরার কথা হচ্ছে কেন? তাছাড়া, মে’র লেখার শেষে ‘সমাপ্ত’ কী করে এল? এ তো গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার মত স্যাক্রিলেজ। সম্পাদক ফতোয়া দিন- টাকা আদায়ের কী হ’ল তা খোলসা না করে কীবোর্ড থেকে হাত তোলা যাবে না।
পড়ে ভাল লেগেছে জেনে লেখক খুব খুশী।
গোঁজামিলের ব্যাপারটা এই রকম, লেখকের বক্তব্য মতো :
1. ফেরার পথে তিন জনই ছিলেন। বড় ভাই নিজেদের গ্রামের বাড়িতে পৌছে ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন, ম্যানেজার সাহেবদের সাথে ফেরত আসেন নি। তার যেচে পথপ্রদর্শক হওয়ার (রামনগর থেকে অতটা দূরের রাস্তা অবদি)বোধহয় সেটাই ইনসেনটিভ ছিল।
2. পর্ব ৩ এর শেষে ‘সমাপ্ত’ লেখা সম্পাদকিয় ত্রুটি। আঁটসাট মাপদন্ডের বদলে সম্পাদক মহাশয় ‘গোপন প্রাণের পাগলাকে তোর, বাইরে দে আজ প্রকাশি’ খাতেই জীবন-তরী বাইছেন। বড় মুস্কিল সেই অভিমুখ পাল্টানো।
৩. ব্যাঙ্কের কাজের নিয়মে এই অভিযানের দিন পনেরো পরে আমাদের ম্যানেজার সাহেব বদলী হয়ে পৌঁছেছিলেন অন্য এক প্রদেশে। সেখানে নতুন যুদ্ধ, নতুন নিরূদ্দেশের খোঁজ। আগের জনের থেকে টাকা আদায় তখন সেখানকার নতুন ম্যানেজারের কাজ। আমাদের ম্যানেজারের কাছে সে কাহিনী তখন নিরূদ্দেশ।
এ লেখা ভাল না লেগে উপায় নেই। সংখ্যার পাটিগ্ণিত মিলে যাওয়ায় খুশি হলাম। কাহিনীকে বেজায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দায়ে পাঠকদের তরফ থেকে বদলিকর্তাদের অন্ততঃ একদিন নরকবাসের আর্জি করা থাকলো।
বেশ লেখা। বর্ণনায় খুব মুন্সিয়ানার পরিচয়। সাসপেন্স তৈরী করে অবশ্য গাছে তুলে লেখক মই কেড়ে নিলেন। সবটা জানা হল না। এএর একটা সিকোয়েল দাবী রইল।
ধন্যবাদ।
এ কী? এরকম ভাবে পাঠককে উত্তেজনার আবহাওয়া থেকে ‘ছুটী’ করিয়ে দেওয়াটাই তো একটা বড় রকমের ‘ত্রুটি’ হিসাবে দেখবে সবাই।
তবে, ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’টাই তো ছোট গল্পের আসল চরিত্র। পাঠকের মনে ‘জিজ্ঞাসা’র দীপটা জ্বালিয়ে রাখার কৌশলটাও রপ্ত করে ফেলেছেন আমাদের ম্যানেজার বাবু।
খুব ভাল লাগল। আমাদের মধ্যে একজন এত সুন্দর লিখতে পারে জানাছিল না। খুবই ভাল লাগল।
এখন তো সময আছে -‘ লেখ না ?”
রণবীর।
ধন্রবাদ প্রশংসা বাক্যের জন্য।