।।১।।
বহুদিন আগে ট্রেনে এক যুবকের গলায় রবিঠাকুরের গান শুনেছিলাম। সে কথা আজ মনে পড়ছে। বলি।
বোলপুর থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম, রামপুরহাট যাব। প্রবল গ্রীষ্মকাল। মে মাসের গোড়া।
কামরায় ভিড় মন্দ ছিল না। বসার সিট পেয়ে এই গরমেও চোখ দুটো একটু বুজে এসেছিল।
হঠাৎ হারমোনিয়মের প্যাঁ পোঁ আওয়াজে চট্কাটা ভেঙে গেল। দেখি বছর বিশ-বাইশের এক রোগাটে যুবক। চালু ফিল্মি গান নয়, নিদেন লোকগীতি নয়, পাক্কা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ভিক্ষা মাঙছে।
“আজি বিজন্ ঘরে নিশীথ্ রাতে, আসবে যদি শূন্য হাতে…..”
গাইছে ভালোই, কণ্ঠে দরদ আছে, সুরের লাগ্ও চমৎকার, কিন্তু ঐ ‘বিজন্’ আর ‘নিশীথ্’-এর শেষের হসন্ত দুটি কট্ কট্ করে কানে বাজলো। ‘বিজনো’ আর ‘নিশীথো’—এমন হবে না উচ্চারণদুটি? হেমন্ত বা চিন্ময় তো এইভাবেই গেয়েছিলেন, আবাল্য শুনে আসছি। দেশটা রাঢ় বলে কথা। গায়কের এ’ভুল ধরা পড়তে দেরি হলো না।
গান শেষ হতেই ও’পাশ থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ‘একবার এ’দিকে শোন তো হে ছোকরা…’ বলে টুঙ্কি দিয়ে ডাকলেন সেই যুবককে। ছেলেটি বোধহয় ভালো দেখতে পায়না। চোখের মণিদুটি ঘোলাটে। ভিড়ভাড় ঠেলে কোনক্রমে ওঁর কাছে পৌঁছতে বাবু বললেন,
‘রবিঠাকুরের দেশে গাইছ রবীন্দ্রসঙ্গীত। তা বাপু, সেটা ঠিকঠাক গাইতে হবে না? উচ্চারণটা বিজন্ আর নিশীথ্ হবে কি? হবে বিজনো আর নিশীথো। বুঝলে? যাও, এবার থেকে ঠিকঠাক গাইবে।’
—‘আজ্ঞে, আমাদের মাস্টারমশাই তো এমনটাই শিখিয়েছিলেন। অনাদি ঘোষদস্তিদারের করা স্বরলিপিতে এমনই আছে।’ মিনমিন করে বলে ছেলেটি। ছেলেটি যে শিক্ষিত সেটা বোঝা যায়, নিছক পথের ভিখারি নয়।
তখনই আহমদপুর স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকে পড়ায় ওর বাকি কথাগুলো আর শোনা হলো না। সেই জ্ঞানদাতা প্রৌঢ়ও এখানেই নেমে গেলেন।
উচ্চারণ ভুল না ঠিক সে দ্বিধা সত্ত্বেও যুবকটির কণ্ঠের আকুতিটা বড্ড মন কেড়ে নিয়েছিল। সেই কথাটা আমার পাশে বসা আরেক বৃদ্ধ বললেনও বটে। আর ছেলেটিকে বললেন,
‘গেয়েছ বেশ সরেস হে ছোকরা। গাও দেখি বাপু আরেকটা গান।’
—‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়…..’ নির্দ্বিধায় ধরে ফেলল সে গানখানি, গলায় ঝোলানো হারমোনিয়মটি বাজিয়ে।
‘চমৎকার গায় না ছেলেটি? রেকর্ড করো না কেন ভাই তুমি?’ ঐ সিট থেকে এক ঝাঁকড়া চুলো খদ্দর পরা মোটাসোটা লোক বললে দ্বিতীয় গান শেষ হতে।
—‘আমরা গরীব ঘরের ছেলে স্যার। কে আর আমাদের গান রেকর্ড করবে বলুন? দিন বাবুরা কিছু কিছু দিন। এই গান গেয়েই চলে আমার….’
—‘কেন? ভালো শিল্পীর কদর সর্বত্র। আর, এতে কোনো পয়সাও লাগে না। তুমি এসো তো ভাই আমাদের গণতান্ত্রিক রবীন্দ্রপ্রেমী সঙ্ঘে। এই তো রোববারই আমাদের পূর্ণ অধিবেশন আছে কমিউনিটি হলে। চেনো তো? বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক পেরিয়ে…..’
।।২।।
রবিবারের সেই পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে আমার যাওয়াটাও হঠাৎই ঘটে গিয়েছিল। আমার এক মাস্টারমশাই, এখন ঢাকায় পড়ান, তিনি আসছেন শুনে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম।
ট্রেনের সেই গায়ক-ভিক্ষুটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হলে ঢোকবার মুখে ভিড়ের মধ্যে হারমোনিয়ম কাঁধে তাকে দেখে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আরে? তুমি….আপনি?’
এক গাল হেসে ছেলেটি বললে, ‘এই শুনতে পেলুম মস্ত বড় বড় সব মানুষজন আসবেন। ভালো গান শুনতে পাওয়া যাবে। নতুনদেরও নাকি সুযোগ দেয় এরা গাইবার। তাই…..’
না, যা বোঝা গেল, কোনো গানের আসর নয় এটা। ‘আলোচনা সভা’! “রবীন্দ্রনাথ ও শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম”, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে রবীন্দ্রনাথের পুনর্মূল্যায়ন”---প্রভৃতি ভারিভুরি বিষয়ের আলোচনায় দেশবিদেশ থেকে আসা মোটাসোটা পণ্ডিতগণ মঞ্চ আলোকিত করে বসে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিতে লাগলেন।
সেই গাইয়ে ছেলেটি আমার সামনের রো তে বসেছিল। উসখুশ করছে সে। ‘গান কখন শুরু হবে?’ জনান্তিকে শুধলো সে। ‘গান আজ আর হবে কি? দুপুর একটা তো বেজে গেল।’ বলি। আমার সেই মাস্টারমশাই আসতে পারেননি, জানলাম। এবার তাহলে উঠি।
‘কিন্তু গদা-দা যে বলেছিলেন এখানে নতুনদের গাইতে সুযোগ দেওয়া হয়?’ হাল ছাড়ে না সেই প্রায়ান্ধ গায়ক।
‘আরে ভাই অসীম, তুমি এসে পড়েছ? এসো আমার সঙ্গে।’ বলতে বলতে সেদিনের সেই ট্রেনে দেখা ঝাঁকড়া চুলো খদ্দরপরা লোকটি গায়কের হাত ধরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে চললেন।
আলোচনাদি চলিতে লাগিল। প্রবল গরমে লোকজন হাঁসফাঁস করছে, অনেকে ঢুলছে। হাতের দৈনিক পত্রিকা মুখের সামনে নেড়ে বাতাস খাচ্ছে। মাথার উপরে ঢিমেতালে ঘুরন্ত ফ্যান।
আরেকজন গণ্যমান্য বক্তার বক্তৃতা শেষ হলো। হঠাৎ কানে এলো মাইকে সেই ‘গদা-দা’র ঘোষণা,
‘….এখন আপনাদের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন শ্রীমান অসীম বিশ্বাস। জানিয়ে রাখি, ইনি একজন বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ। আমাদের মানুষের পাশে থাকবার তাগিদে…’
সেদিন কিন্তু ছেলেটি মোটেই ভালো গাইতে পারল না। হয়ত স্টেজে গাওয়ার অভ্যাস নেই বা অত্যধিক গরম বা মাইক-ননফিটিং ভয়েস… কী জানি বাপু। পর পর দুটি গানে জমাতে না পেরে ঘাবড়ে গিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসবার তোড়জোড় করছে সে। আমি পিছন থেকে চেঁচিয়ে ফরমায়েস করলুম,
‘…আছে তো হাতখানি….’
এটি ওর ফেভারিট গান। চমৎকার খোলেও ওর গলায়। ‘আজি বিজন্ ঘরে নিশীথ্ রাতে….’ ধরে ফেলল সেই যুবক।
গান শেষ হতেই বেশ কয়েকটি কণ্ঠ গর্জে উঠল ওর ঐ ‘বিজন্’ এবং ‘নিশীথ্’ এর বিরুদ্ধে।
—‘এই সব বালখিল্যদের তোমরা স্টেজে তোলো কী বলে হে? এখনও উচ্চারণশুদ্ধি হয়নি।’
—‘তোমার পরশ থাকুক আমার হৃদয় ভরা -তে মাত্রাও বেশি দীর্ঘায়িত করেছে। পরশ আর হৃদয় কি অত দীর্ঘ হবে? আরেক পৃথুলা অধ্যাপিকার মত।’
দুপুর দুটো বেজে গেছে। অনুষ্ঠানের ওখানেই সমাপ্তি। ভিড় ঠেলে মঞ্চের পিছনে গিয়ে সেই অসীমের সঙ্গে একবার দেখা করব ভাবলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
একটা রোগা অচেনা ছেলে মাইকের তার খুলছিল। জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘হ্যাঁ, চিনি তো ওকে। ওর তো ধুম জ্বর। গাইবার লোভে শরীর খারাপ নিয়েই এসেছিল আজ। তারপর স্টেজে উঠে ঘাবড়ে গিয়ে টিয়ে…’
।।৩।।
কলেজের কমনরুমে সেদিন কলিগদের মাঝে এ’সব নিয়ে গুলতানি চলছে। ঢং করে ঘন্টা পড়ল। ক্লাসে যেতে হবে। হাজিরা খাতাটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লাম। করিডর দিয়ে হাঁটছি, রুকসানা হঠাৎ দেখি পিছু পিছু আসছে, আর মিন্ মিন্ করে কী যেন বলতে চাইছে।
‘কী রে? কিছু বলবি?’ শুধাই। মেয়েটি কলেজে ঝাড়াই সাফাই করে, আমাদের চা টা এনে দেয়। বুঝলাম, ও’ একটু আগের আমাদের কথাবার্তা পাশ থেকে শুনেছে, আর সেই সূত্রেই কিছু বলতে চাইছে।
রুকসানা বলল, ‘স্যর, আমি ওকে চিনি। আমাদের পাড়াতেই থাকে। আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারি।’
যা হোক্ সেদিন ক্লাসের শেষে সাইকেল চালিয়ে মুসলমান পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। রুকসানাদের বাড়ি সামনেই। বলাই ছিল। ও’ দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির দোরগোড়াতেই।
ওখানেই সাইকেলটা রেখে সরু পায়ে চলা কাঁচা পথ ধরে মহল্লার ভিতর দিকে এগিয়ে চললাম।
‘স্যর, আমি কিন্তু ওদের বাড়িতে ঢুকবো না। ডেকে দিয়েই চলে যাব। কেমন?’
একটা অতি জীর্ণ কুটীরের সামনে দাঁড়িয়ে ‘ওয়াসিম! ওয়াসিম!’ বলে দু’বার চেঁচিয়ে ডেকেই ফুরুৎ করে সরে পড়ল রুকসানা। আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। অন্ধকার হতে চলেছে চারিদিক।
কালো বোরখা পরা এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন, ‘কে? কে? কাকে খুঁজছো বাবা?’
উনি বোধহয় বাইরে কোথাও বেরোতে যাচ্ছিলেন।
‘মানে….ইয়ে অসীম, মানে ওয়াসিম কি ঘরে আছে? একবার ডেকে দিন না মাসীমা।’ বললাম।
‘অ। কিন্তু তার তো বড্ড জ্বর গো। ঐ তো ঘরের মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। যাও না, ঢুকে যাও না বাঁদিকের দরজাটা দিয়ে। জেগেই তো আছে।’
‘কে এসেছে, মা?’ ভিতর থেকে জিজ্ঞেস ভেসে এলো। স্বরটা আমার চেনা।
মাটির উপরে চাটাই পেতে শুয়ে আছে সেই গায়ক। ঘরের মধ্যে কোনো আলো নেই। কোনো ভনিতা না করে ঢুকেই বললাম,
‘তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি ভাই ওয়াসিম। গানটা তুমি ঠিকই গাও, গেয়েছিলে। আমরাই ভুল জেনে হেনস্থা করেছি তোমায়। বিজন্ ও নিশীথ্ উচ্চারণই ঠিক।’
সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে মৃদু মৃদু পরিতৃপ্তির হাসি যেন দেখতে পেলাম ছেলেটির মুখে। বললে, ‘বসুন স্যার। বসুন। কিন্তু কোথায় বসতে দিই বলুন তো আপনাকে? আপনি এই সামান্য কথা বলতে এতো দূরে এসেছেন ভাবতেই সংকোচ হচ্ছে আমার।’
‘আমি আজ আর বসব না ভাই ওয়াসিম। তোমার জন্যে ছোট্ট একটা উপহার এনেছি।’ বইটি হাতে নিয়ে হাসি মুখে পরম মমতায় তার গায়ে হাত বুলাতে লাগল ছেলেটি।
এমন সময়ে তার মা এক লম্প হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন। বইটি চোখের একদম কাছে এনে দেখতে লাগল। কালো মলাট। হার্ড কভার। ‘একাকী এক কবি’। প্রচ্ছদে গুরুদেবের ছবি রয়েছে। বললাম, ‘শীগগির সুস্থ হয়ে ওঠো। একদিন জমিয়ে বসে তোমার গান শুনব।’
‘হ্যাঁ হুজুর। ছেলে আমার এবার সেরে উঠবে। কাল রাতে ও’ যখন গাইছিল এই দরবেশ সাহেব তো এসেছিলেন আমাদের এই কুঁড়ে ঘরে। আগেও এসেছেন কত বার! বেটা গাইলে মাঝেমাঝেই শুনতে আসেন উনি। কাল তো হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছেন ছেলের শিরে; এবার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবেই। দশাসই চেহারা তাঁর। গায়ে কালো আলখাল্লা। একমুখ সাদা দাড়ি গোঁফ। আর ঠোঁটের কোণে তাঁর কী যে মধুর হাসি গো।’
ওয়াসিম গুনগুনিয়ে উঠল, ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’। আর আমি? স্তম্ভিত বেভুল হয়ে বসে আছি এক ‘ম্লেচ্ছে’র কুঁড়েঘরে। কী শুনছি এ’সব? গল্প কথা? বানানো? না, আমার তো আর অত সৌভাগ্য নেই যে দেখব এই ভাঙা কুঁড়ের নিচু দরোজা দিয়ে ঝুঁকে ঢুকছেন কালো আলখাল্লাধারী এক দিব্যপুরুষ! শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুগুম্ফ। সমুন্নত নাসা। উদ্দীপ্ত প্রেমময় চক্ষুদ্বয়। আর এসে হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্রিয় গায়কের দিকে।
পরম ভরোসায় সে গাইছে,
‘জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি।’
।।সমাপ্ত।।
Discover what others are saying and explore articles that deepen your understanding of heritage preservation, community empowerment, and sustainable development across the globe.
Join us in promoting cross-cultural dialogue, preserving heritage, and fostering global collaborations through art, literature, music, and festivals.