
।।১।।
"এই দিদি। বাবা কখন আসবে বল না।"
"চুপ করে বসে থাক। আমি কি করে বুঝবো কখন আসবে।"
"আমার ক্ষিদে পেয়েছে দিদি।"
"জল ঢালা ভাত আছে, দেবো?", মিনতি তার পাঁচ বছরের ভাই সন্তুকে বলে। সন্তু দৃষ্টিতে দিদির দিকে চেয়ে থাকে। মুখে কিছুই বলে না।
"তাহলে দুটো রুটি বানিয়ে দি? খাবি?"
"বাবা কখন আসবে, বল না দিদি।" সন্তুর চোখে জল।
"আমি সত্যি জানি না রে ভাই বাবার এত দেরি হচ্ছে কেন? ........ছবির বই টা দেখবি? নিয়ে আসি?"
"না থাক। বাবা আসলেই তিনজন এক সঙ্গে খাবো। দিদি, তোর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকি?"
মিনতি একটা সেলাই মেশিনে বাজারের থলি সেলাই করছিল। আজকাল প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ হওয়াতে এই কাপড়ের থলি গুলো খুব চলছে। বাবার বন্ধু শঙ্কর কাকু, যে একটা বড় ঝাঁ চকচকে মুদির দোকানে কাউন্টারে বসে, বাবাকে দিয়ে তাকে বলিয়ে, মিনতি এই থলি সেলাই এর কাজটা জোগাড় করেছে।
আজ আরো আট দশটা মতো থলি বানাতে পারলে খুব ভালো হতো। ভাইয়ের আবদার শুনে, মেশিন ছেড়ে মিনতি ভাই এর কাছে খাটে গিয়ে বসে। মনে মনে ভাবে, আজ একটু বেশিক্ষন কাজ করে না হয় আরো কটা থলি বানিয়ে নেবে।
সন্তু দিদির কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে পড়ে। মিনতি ভাইয়ের চুলে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটে।
"সত্যি তো, বাবা তো বলেছিল আজ দুপুর দুটো আড়াইটার মধ্যে চলে আসবে। সাড়ে তিনটে বাজে এখনো আসছে না কেন?" মনে মনে ভাবলো মিনতি।
।।২।।
ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর প্রায় আট মাস বাড়িতে বসে ছিল স্বপন। মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়তো কাজের খোঁজে। সে এক সময় গেছে বটে। কি ভাবে যে কেটেছে সেই দিন গুলো। আর বাড়িতে নিত্য ঝামেলা, ঝগড়া।
"বাড়িতে এমন ভাবে বসে থাকো যেন ব্যাংকে গাদা গাদা টাকা। একটা চাকরি জোগাড় করতে হলে, ওই সপ্তাহে একদিন দু ঘন্টার জন্য বেরোলে হয় না, বুঝেছো? লেগে থাকতে হয়।"
"আর রোজ রোজ বেরোলে যে বাসের টিকেটে গাদা গাদা টাকা যাবে সেটা কি তোমার বাবা দেবে?", বউ এর রোজকার খোটা মুখ বুজে সহ্য করতে পারে না স্বপন।
সেই সময়ের কথা ভাবলে মাথা হেঁট হয়ে যায় স্বপনের।
আবার ওই সময়েই মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে দেয়। কি বা করবে? জমানো টাকা দিয়ে কোনোরকম খাওয়া জুটতো দুই বেলা।
"থাক না। না হয় আমাদের পুজোতে নতুন জামা কাপড় হবে না। মেয়েটা এত মন দিয়ে পড়াশোনাটা করছে।" বউ একটু হলেও বোঝাতে চেষ্টা করেছিল।
"যা বোঝো না তা নিয়ে এত জ্ঞান দিতে এসো না তো।", মনে মনে বেশ জানে ব্যাপারটা ভুল হচ্ছে, তাও এমনভাবে বলতে বাধ্য হয় স্বপন।
"থাক না মা। বাবা ঠিকই তো বলছে। আমি কিছুদিন নিজে বাড়িতেই পড়াশোনা করি। তারপর যখন সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার ভর্তি হবো।" ক্লাস ফোরে পড়া মিনতি নিজের বয়সের তুলনায় অনেকটাই পরিণত।
পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিল মিনতি। স্কুলের দিদিমনিরা খুব ভালোবাসতো ওকে। স্কুল ছাড়ানোর সময় এক দিদিমণি বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। স্বপন ভাবতো একটা চাকরি পেলেই আবার মেয়েকে ভর্তি করবে স্কুলে।
তারপর এক বন্ধু খোঁজ দেয় যে "উনিভার্সাল মানুফ্যাকটুরিং কোম্পানি" ছ'মাসের কন্ট্রাক্টে লোক নিচ্ছে। সেই থেকে কন্ট্রাক্ট রিনিউ হতে হতে প্রায় চার বছর হয়ে গেল স্বপনের এখানে। অথচ মেয়েকে আর ভর্তি করা হয়ে ওঠে নি। ও যে এখন সেলাই করে মাসে পাঁচ ছয় হাজার আনে, সেটাও তো ছেড়ে দিতে ভয় হয়।
উত্তর নেই তার কাছে। মেয়ের জন্য কিছু না করতে পারা স্বপনের ভিতরটা তোলপাড় করে দেয়।
।।৩।।
আজ ওদের কোম্পানির ফাউন্ডেশন ডে। ফ্যাক্টরি তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাবে। মিনতি কে বলে এসেছে যে তাড়াতাড়ি ফিরবে আর এক সাথে খাবে তিনজনে।
কাজ শেষ করে বয়লার-সুট ছেড়ে, নিজের জামা কাপড় পরে কনটেইনার এর ভিতর ওদের বসার জায়গায় বসে সেই পুরোনো কথা ভাবছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপন ব্যাগ থেকে খাতা-পেন্সিল বের করে আঁকিবুকি কাটতে থাকে। ফ্যাক্টরিতে ও ওয়েল্ডিং এর কাজ করে। আগেও তাই করতো। ওর অনেকদিনের ইচ্ছে একটা ছোট্ট জায়গা নিয়ে নিজে কিছু করবে। আর এই খাতাতেই, ওর ভাবনা থেকে ফুটে ওঠে নানান রকম গেট, গ্রিলের ডিজাইন।
একটা নতুন ধরনের গেট আঁকছিলো এই মুহূর্তে স্বপন। সম্বিৎ ফেরে কান্তির ডাকে, "কি রে স্বপন, বাড়ি যাবি না? সবাই চলে গেল তো।"
খাতা থেকে মুখ তুলে স্বপন বললো, "কখন দেবে রে?"
"কি দেবে? ....... ও, ওই বিরিয়ানির আর মিষ্টির প্যাকেট?....... যা তারা। তুই এর জন্য বসে আছিস? শুনিস নি? এবার কোম্পানি অর্ডার কম পাওয়ায়, কন্ট্রাক্ট ওয়ার্কারদের প্যাকেট দেবে না।"
Discover what others are saying and explore articles that deepen your understanding of heritage preservation, community empowerment, and sustainable development across the globe.
Join us in promoting cross-cultural dialogue, preserving heritage, and fostering global collaborations through art, literature, music, and festivals.